পিরিয়ড বা মাসিক শব্দটি নিয়ে একধরনের রাখঢাক আছে। তবে শব্দটিকে ঘিরে যে জড়তা বা অস্বস্তি, তা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। টেলিভিশনে নানান স্যানিটারি প্যাডের বিজ্ঞাপন দেখানোর সময় অনেক পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অস্বস্তি কাজ করলেও তা সয়ে গেছে। আর চলতি বছরে ভারতের কেরালায় ঋতুমতী নারীদের মন্দিরে প্রবেশকে কেন্দ্র করে একজনকে প্রাণই চলে গেছে।
ভারতের কেরালা হাইকোর্টের ১৯৯১ সালের নির্দেশ অনুযায়ী, ১০ থেকে ৫০ বছরের ঋতুমতী নারী হিন্দু দেবতা ‘আয়াপ্পা’-র শবরীমালা মন্দিরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল। এই প্রথার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যে মামলা হয়, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সর্বোচ্চ আদালত তাঁর রায়ে সেই বৈষম্য দূর করেন।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রশাসনিক সহায়তায় মন্দিরটিতে মধ্যবয়সী ঋতুমতী দুই নারীর প্রবেশের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজ্যের রাজনীতি ও সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হরতাল, আন্দোলনে মারা যান একজন। আহত হন অসংখ্য মানুষ।
চলতি বছরে গ্রামীণ ভারতের পটভূমিতে নির্মিত ‘পিরিয়ড, এন্ড অব আ সেনটেন্স’ বা ‘মাসিক, বাক্য শেষ’ নামের তথ্যচিত্রটি জিতে নিল অস্কার। ৯১তম একাডেমি অ্যাওয়ার্ডের ‘ডকুমেন্টারি শর্ট’ শাখায় পুরস্কার জিতল তথ্যচিত্রটি। দিল্লির অদূরে হাপুর জেলার কাঠিখেরা গ্রামের নারী ও কিশোরীদের জন্য প্যাড মেশিন স্থাপনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয় ২৬ মিনিটের তথ্যচিত্রে।
শুধু তো কাঠিখেরা গ্রাম নয়, গ্রামটির ২২ বছর বয়সী স্নেহাও এখন পুরো বিশ্বের কাছেই পরিচিত মুখ। স্নেহা নিজের যখন মাসিক হয়, তখন ভয়ে কাঁদতে শুরু করেছিলেন। আর সেই স্নেহাই স্বল্পমূল্যের স্যানিটারি প্যাড তৈরির কারখানায় কাজ করেন এবং অস্কারজয়ী ডকুমেন্টারি ‘পিরিয়ড, এন্ড অব আ সেনটেন্স’–এর প্রধান চরিত্র হিসেবে একাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের আমন্ত্রণে অস্কারের লালগালিচার ওপর দিয়েও হেঁটে আসেন।
গত বছর মুক্তি পাওয়া বলিউড তারকা অক্ষয় কুমারের ‘প্যাডম্যান’ তুমুল আলোচনায় আসে। মুক্তির প্রথম দিনেই ১০ কোটি রুপি আয় করে এ সিনেমা। তবে মুক্তির পরদিনই রিপু দমন জেইসওয়াল নামের এক ব্যক্তি চিত্রনাট্য চুরির দায়ে অক্ষয় কুমারের নামে মামলা করেন।
‘প্যাডম্যান’ ছবির গল্প তামিলনাড়ুর অরুণাচলম মুরুগানান্থম নামের এক ব্যক্তিকে নিয়ে। তিনি গ্রামের নারীদের জন্য স্বল্পমূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করে আলোচনায় আসেন। সিনেমা মুক্তির আগে নায়ক অক্ষয় কুমারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ‘প্যাডম্যান’ ছবির প্রচারণা করেন আসল ‘প্যাডম্যান’ অরুণাচলম মুরুগানান্থাম। সিনেমার আলোচনার পাশাপাশি মানুষ স্যানিটারি প্যাড নিয়েও অবলীলায় কথা বলার পরিবেশ পেয়েছেন।
গত বছর বিবিসি অনলাইনের খবরে জানানো হয়, আন্দোলনের মুখে ভারত সরকার মেয়েদের মাসিকের সময় ব্যবহৃত সব ধরনের স্যানিটারি প্যাডের ওপর ১২ শতাংশ কর বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে।
অন্যদিকে, নারীর অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের সংস্থা ইউএন উইমেন জানিয়েছে, নারীর জীবন বদলে দেওয়া পাঁচটি উদ্ভাবন হলো হিপ্পো রোলার (পানি সংগ্রহের কাজে ব্যবহৃত চাকাযুক্ত একধরনের ড্রাম), বাইসাইকেল, ইন্টারনেট, স্যানিটারি প্যাড ও প্যান্ট। সংস্থাটি বলছে, স্যানিটারি প্যাড উদ্ভাবন নারী ও কিশোরীর স্বাস্থ্যের উন্নতির ঘটায়, স্কুলে মেয়েদের উপস্থিতি বাড়িয়ে দেয়, কাজ ও উপার্জনের সুযোগ বৃদ্ধি করে।
বাংলাদেশেও সরকারি বেসরকারি এবং ব্যক্তি উদ্যোগে নানান কাজ হচ্ছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ষষ্ঠ শ্রেণির শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বইটিতে ঋতুস্রাব বা মাসিককে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, সাধারণত ৯ থেকে ১২ বছর বয়সে মেয়েদের মাসিক শুরু হয়। মাসিক হলে কী ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, স্যানিটারি প্যাড বা কাপড় পরার নিয়ম বলে দেওয়া হয়েছে।
অর্থাৎ, ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে শুরু করে মাধ্যমিকের বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকে মাসিক, বয়ঃসন্ধিকাল নিয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। বেশির ভাগ শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে এ অধ্যায় পড়ান না বলে যে অভিযোগ, তা অবশ্য অন্য কথা।
স্কুলপর্যায়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে ২০১৫ সালের ২৩ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্রে ছাত্রীদের পৃথক টয়লেটে নিরাপদ পানি, সাবান, ঢাকানাযুক্ত বিন রাখতে বলা হয়। পাশাপাশি স্কুলে স্যানিটারি প্যাড রাখতে বলা হয়। এ ছাড়া মাসিক নিয়ে কথা বলার জন্য একজন শিক্ষিকাকে নির্দিষ্ট করে দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য হলো, বর্তমানে সারা দেশে কো-এডুকেশনের (ছেলে ও মেয়ে একসঙ্গে পড়ছে) তিন হাজার বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য নতুন ভবন তৈরি হচ্ছে। চারতলা ভবনের প্রতি তলায় ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা ওয়াশ ব্লক, মেয়েদের ব্লকে মাসিকের স্যানিটারি ন্যাপকিন ফেলার জন্য পৃথক ঝুড়ি (বিন) যাতে রাখা হয়, সে নির্দেশনা দেওয়া আছে। কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
রাজধানীতে বেসরকারি সংগঠন অপরাজেয় বাংলাদেশের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে থাকা কিশোরীরা নিজেরাই বানাচ্ছে স্যানিটারি ন্যাপকিন। এই ন্যাপকিন তারা নিজেরা ব্যবহার করে, বাইরের বিভিন্ন সংগঠন তা কিনেও নেয়। মাসিক নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে বলেই হয়তো এই কিশোরীদের বানানো ন্যাপকিন অন্যরা কিনতে চাচ্ছে।
টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বরগুনা ও লক্ষ্মীপুরে নারীরা স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করছেন। বিভিন্ন স্কুলে বা সংগঠনে স্বল্প মূল্যে ওই স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রি করা হচ্ছে। বেসরকারি সংগঠন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দ্য রুরাল পুওর এ কার্যক্রমে সার্বিক সহায়তা করছে। প্যাড উৎপাদনে গ্রামের নারীরাও পিছিয়ে নেই।
গত মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের নেতৃত্বে পরিচালিত সিলেট ও মৌলভীবাজারে সূচনা প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, প্রকল্পের আওতায় আসা বেশির ভাগ কিশোরী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে। প্রকল্পের কর্মীরা বাড়িতে নিয়ে প্যাড বিক্রি করেন। কিশোরীরা হাঁস-মুরগি পালন, হাতের কাজসহ বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যে আয় করে তা দিয়েই স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সেভ দ্য চিলড্রেন বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার ২০টি উপজেলায় ২ লাখ ২০ হাজার দরিদ্র পরিবারের শুধু বর্তমান মা নন, হবু মা, অর্থাৎ কিশোরী এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী প্রজননক্ষম নারীদের কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়েছে।
মাসিক নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে, কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ভয়, লজ্জা-শরম, সংকোচ একেবারে চলে গেছে, তা বলার উপায় নেই বা বলার সময় আসেনি। রাজধানীর বাউনিয়া বাঁধ বস্তিতে গিয়ে কথা হলো ৩৯ বছর বয়সী শানু বেগমের সঙ্গে। তিনি বারবার বলছিলেন, মাসিকের কাপড় কেউ যদি দেখে ফেলে, তা হবে সবচেয়ে শরমের কথা।
শানু বেগমের ১৪ বছর বয়সী নাতনি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। বাজারে পাওয়া স্যানিটারি প্যাড কেনার সামর্থ্য নেই বলে নাতনিও কাপড় ব্যবহার করে। শানু বেগম বললেন, মাসিকের সময় নাতনি প্যান্টি, টাইটসের ওপরে দুটো সালোয়ার পরে স্কুলে যায়, যাতে কোনোভাবেই মাসিকের রক্ত পোশাকে না লাগে। স্কুলে যতক্ষণ থাকে, বাথরুমে যায় না। কোনো মাসে অতিরিক্ত রক্ত গেলে স্কুল থেকে ফোন দেয়, যাতে তাকে বাসায় আনা হয়। বাসায় থাকলে মাসিকের সময় পারতপক্ষে বাবা বা ভাইয়ের সামনে যায় না। নাতনি মাসিকের সময় খালি রাগ করে আর দিন গোনে কবে এই যন্ত্রণা শেষ হবে।
ভারতে মাসিক নিয়ে এত তোলপাড়, তারপরও ঋতুমতী নারীদের শবরীমালা মন্দিরে প্রবেশের পর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত মন্দির বন্ধ করে ধোয়ামোছার মধ্য দিয়ে ‘অপবিত্রতা’ দূর করেন।