বিরোধী প্রার্থী ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহর কাছে মালদ্বীপের কর্তৃত্ববাদী প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের অপ্রত্যাশিত পরাজয় ভারত মহাসাগরের ক্ষুদ্র দেশটির জন্য আশার আলো নিয়ে এসেছে, যার গণতন্ত্রে রূপান্তরের বিষয়টি ছিল কঠিন ও অনিশ্চিত। তবে এখনই এ ধরনের আশা করাটা খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে। অস্থিতিশীল দেশটিতে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো কঠোর রাজনৈতিক ও মেরুকৃত চরিত্রের অর্থ হলো, সেখানে জনপ্রিয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করার কাজ চলছে।
মালদ্বীপের নাগরিকেরা, যাঁদের প্রায় ৯০ শতাংশ নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন, আবদুল্লাহ ইয়ামিনের চরম কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, যা অতীতের রাজকীয় ও একদলীয় শাসনের চেয়েও খারাপ হয়ে উঠেছিল। তিনি শুধু তাঁর উদারমনা বিরোধীদের জেলে বা নির্বাসনে পাঠাননি, তঁার সৎভাই ও সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমের অনুসারীদের ওপরও দমন-পীড়ন চালিয়েছেন।
আবদুল্লাহ ইয়ামিনের এই কর্তৃত্ববাদী কৌশল তাঁর জন্য উল্টো ফল বয়ে এনেছে। তিনি নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন বিরোধীদের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়েছেন। ভোটের আগে বিরোধীদের প্রধান কার্যালয়গুলো ঘেরাও করে তল্লাশি করেছে পুলিশ। মামুন আবদুল গাইয়ুমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়, যাতে ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকা যায়।
স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন অভিজাতদের মধ্যে বিভাজন দেখা দেওয়ার পাশাপাশি যদি জনগণের আন্দোলন হয়, তাহলে যেকোনো স্বৈরশাসককে উৎখাত করা সম্ভব। আবদুল্লাহ ইয়ামিনের পতন এই প্রবণতাকেই নিশ্চিত করেছে। আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের কারণে গণতন্ত্রে উত্তরণের বিষয়টি উৎসাহিত বা বাধাগ্রস্ত হয়। ইয়ামিনের উৎখাতকারীরা চীনের মারাত্মক বিরোধী ছিল। চীন শুধু ইয়ামিনের জন্যই আশীর্বাদস্বরূপ ছিল। ইয়ামিনের পাঁচ বছরের শাসনামলে বেইজিং মালদ্বীপের জমি, অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। মালদ্বীপ বড় প্রকল্পগুলোতে চীনা বিনিয়োগকে স্বাগত জানায়। দেশটি চীনের সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। ফলে আবদুল্লাহ ইয়ামিনের শাসনামলে অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে চীন মালদ্বীপে অধিক প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পায়। চীন ইয়ামিনের পেছনে ছায়া হয়ে দাঁড়ায়, যা তাঁকে বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন চালাতে ও দেশে জরুরি অবস্থা জারি করতে সাহস জোগায়। একই কারণে ইয়ামিন ভারত,
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর চাপ উপেক্ষা করেছেন। কিন্তু নির্বাচনে মোহাম্মদ সলিহর বিজয়ের ফলে চীনের এ আধিপত্য হুমকির মুখে পড়েছে।
শ্রীলঙ্কার মাহিন্দা রাজাপক্ষের সঙ্গে কী ঘটেছিল, তা একবার ভাবুন। আবদুল্লাহ ইয়ামিনের মতো তিনিও ভারত ও পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাব ঠেকাতে চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন কিন্তু ২০১৫ সালের নির্বাচনে তিনিও পরাজিত হন। ইয়ামিন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলকে খেপিয়ে তুলেছিলেন, যারা তাঁকে উৎখাত করার জন্য নীরবে কাজ করেছে।
মালদ্বীপের নির্বাচনের এই ঐতিহাসিক ফলাফল এটা প্রমাণ করেছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ঢেলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা কোনো স্থায়ী সুবিধা দেয় না। ইয়ামিনের অধীনে মালদ্বীপকে ঋণের ফাঁদে ফেলার কার্যকর সমালোচনার ফলে মালদ্বীপবাসীর মনে এই আশঙ্কার জন্ম নেয় যে একসময় হয়তো তাদের দেশটি চীনের নব্য উপনিবেশে পরিণত হবে।
তবে ধারণা করা হচ্ছে, ইয়ামিন পরাজিত হওয়ায় চীন হতোদ্যম হবে না। এখন যিনি ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই উন্নয়নশীল দেশটির ক্ষমতায় আসছেন, তাঁর সঙ্গে চীন সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করতে পারে। চীন এ ক্ষেত্রে বিপুল অর্থ ঢালার নীতি বাস্তবায়ন করতে পারে। এখন মোহাম্মদ সলিহ ও মালদ্বীপের পরবর্তী প্রশাসন নিজেদের চীনের এই লোভের ফাঁদ থেকে মুক্ত করতে পারবে কি না, সেটাই দেখার বিষয়। এটা অনেকটা নির্ভর করবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো থেকে সমর্থন পাওয়ার ওপর।
মালদ্বীপে গণতন্ত্রকে জোরদার করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিচারব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র, নির্বাচন কমিশন এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সংস্কার। ভারত ও পশ্চিমা অংশীদারেরা, যারা একটি মধ্য ও উদার মালদ্বীপের প্রত্যাশা করে, তাদের অবশ্যই সেখানে দীর্ঘমেয়াদি সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করতে হবে। ইয়ামিনের কবল থেকে মুক্ত হওয়াই শেষ কথা নয়, বরং একটি নতুন যুগের ভিত্তি রচনা করতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া থেকে নেওয়া
শ্রীরাম সুন্দর চাউলিয়া জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনালের অধ্যাপক