মতামত

মারামারিতে জয়ী ছাত্রলীগের নির্বাচনে কেন ভয়

২৪ মে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে ছাত্রদলের কর্মীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা
ছবি: প্রথম আলো

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ছাত্রলীগের মধ্যে জোয়ার দেখেছেন। গাজীপুরের শ্রীপুরে ছাত্রলীগের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘জোয়ারের পানি দেখলে উৎফুল্ল হওয়ার কিছু নেই। বরং সতর্ক হওয়ার কারণ রয়েছে। মনে রাখতে হবে, জোয়ারের পর কিন্তু ভাটাও লাগে। আজ জোয়ারের সময় যারা ছাত্রলীগে আসছে, ভাটা লাগলে কিন্তু থাকবে না।’

মন্ত্রী মহোদয় জোয়ার দেখলেও সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের মধ্যে কোনো জোয়ার দেখতে পান না। দেখার কারণও নেই। ছাত্রলীগের তৎপরতা তখনই দৃশ্যমান হয়, যখন নিজ সংগঠনের বিবদমান গ্রুপ সংঘাতে লিপ্ত হয় কিংবা অন্য সংগঠনের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া কিংবা শিক্ষার কোনো বিষয়ে তাদের পাওয়া যায় না। মাসখানেক আগে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন এবং দুই গরিব শ্রমজীবী মানুষ মারা যান। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ছাত্রলীগের হেলমেটধারীরা নাহিদ নামের এক কুরিয়ার সার্ভিস কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করেন। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের কোনো বিরোধ ছিল না। দুই ফাস্ট ফুডের দোকানের কর্মীদের মধ্যকার বিরোধের জের ধরে এক দোকানের কর্মী ছাত্রলীগের হেলমেটধারীদের
‘হায়ার’ করেন।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে যুদ্ধের মহড়া দেখলাম, তাতেও ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে নেতা-কর্মীদের ‘হায়ার’ করেছে। ছোটবেলায় আমরা দেখেছি, নিজ এলাকায় উপযুক্ত খেলোয়াড় না থাকলে অন্য এলাকা থেকে খেলোয়াড় হায়ার করে আনা হতো দলকে জেতানোর জন্য। তাই বলে ক্যাম্পাস থেকে প্রায় বিতাড়িত ছাত্রদলকে মোকাবিলা করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে অন্য এলাকা থেকে ক্যাডার হায়ার করার ঘটনা কোনোভাবে জোয়ারের লক্ষণ নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের সেই সংঘাত আদালত অঙ্গন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। গত বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগের কর্মীরা সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে গিয়ে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালান। এই হামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি বহিরাগত অনেক নেতা-কর্মীও ছিলেন। হামলার সামনের সারিতে ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জুবায়ের আহমেদের অনুসারীরা। জুবায়ের ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। র‌্যাবের ওপর হামলার অভিযোগে জুবায়ের ১৮ মে গ্রেপ্তার হন। এর একদিন পরই তিনি জামিনে ছাড়া পান। এ ছাড়া হামলার সময় ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের শীর্ষ পদপ্রত্যাশী সামাদ আজাদ ও তাঁর অনুসারীরাও বেশ বেপরোয়া ছিলেন। গত এপ্রিল মাসে নিউমার্কেট এলাকায় দোকানমালিক-কর্মচারী ও হকারদের সঙ্গে সংঘর্ষে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের একজন সামাদ। তিনিও ছাত্রলীগের সভাপতির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।

ছাত্রলীগ দাবি করেছিল, ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে গোলযোগ তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। এ কারণে প্রগতিশীল ছাত্ররা তাঁদের প্রতিহত করেছেন। প্রগতিশীল ছাত্র কারা, সেটি তাঁরা বলেননি। অতীতে প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন যখন ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, তখন ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে একযোগে তাদের প্রতিহত করতে দেখা গেছে। সে সময় ছাত্রলীগের নেতারা কিন্তু তাদের প্রগতিশীল হিসেবে রেহাই দেয়নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগের কাছে প্রগতিশীল শব্দের অর্থও বদলে যায়।

অনেক আন্দোলন ও আইনি লড়াইয়ের পর ২০১৯ সালে আরেকবার ডাকসু নির্বাচন হলেও ফলাফল ক্ষমতাসীনদের পক্ষে যায়নি। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নুরুল হকের ছাত্র অধিকার পরিষদ নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। তিনি ভিপি হন। ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদকসহ বেশ কিছু আসন পেলেও আর নির্বাচন করতে সাহস পায়নি। যে সংগঠনের পেছনে আওয়ামী লীগের মতো দল আছে, সরকার আছে, প্রশাসন ও পুলিশ আছে (ছাত্রলীগের হামলায় ছাত্রদলের অনেক কর্মী আহত হলেও মামলা হয়েছে ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের নামেই), সেই ছাত্রসংগঠন একটি নির্বাচন করতে কেন ভয় পায়?

প্রথম আলো বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ ও ছবি বিশ্লেষণ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে হামলায় অংশ নেওয়া আরও ১১ জনের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত করেছে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি রাকিব হোসেন, কর্মসূচি ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন, গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক আবদুল্লাহ হীল বারী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়বিষয়ক সম্পাদক আল-আমিন রহমান, গ্রন্থনা ও প্রকাশনাবিষয়ক উপসম্পাদক আমানুল্লাহ আমান, উপদপ্তর সম্পাদক নাজির আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শহিদুল হক ওরফে শিশির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদা সূর্য সেন হল শাখার নেতা সৈয়দ শরিফুল আলম, স্যার এ এফ রহমান হল শাখার নেতা আবদুর রাহিম সরকার, সালাহউদ্দিন আহমেদ ওরফে সাজু ও আবসার হাসান ওরফে রানা।

বিরোধের সূত্রপাত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদের দেওয়া এক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। সেই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ ২২ মে সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) এলাকায় ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালায়। এর প্রতিবাদ ও সাইফ মাহমুদের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে ২৪ মে টিএসসিতে ছাত্রদল সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিল। ২৪ মে সকালে সেখানে যাওয়ার পথে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে ছাত্রদলের মিছিলে হামলা করে ছাত্রলীগ।

এর অর্থ, ছাত্রদলকে ব্যাখ্যা দেওয়ারও সুযোগ দিতে রাজি নয় ছাত্রলীগ। অন্য সময়ে ছাত্রলীগ হামলা করলে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা পালিয়ে যান। এবার তাঁরা কিছুটা প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নেমেছিলেন। কেবল ছাত্রলীগ নয়, ছাত্রদলও ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে নেতা-কর্মীদের নিয়ে এসেছে। দুই পক্ষের কাছেই লাঠি ও দেশি অস্ত্রশস্ত্র ছিল। ছাত্রলীগ বলেছে, ছাত্রদলের বহিরাগত নেতারা অস্ত্রশস্ত্রসহ ক্যাম্পাসে ঢুকে সংঘাত তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা যদি এ রকম কিছু করার চেষ্টা করে থাকেন, ছাত্রলীগের উচিত ছিল বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানানো। তা না করে তারা নিজের হাতে আইন তুলে নিয়েছে। আর যদি ছাত্রলীগ না-ও জানিয়ে থাকে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন নিজে থেকে ক্যাম্পাসে শান্তি রক্ষার চেষ্টা করল না? তাহলে তারাই কি চেয়েছে ক্যাম্পাস অশান্ত হোক? ক্যাম্পাসে কাকে শায়েস্তা করতে হবে আর কাকে মিছিল-সমাবেশ করতে দেওয়া হবে, সেই সিদ্ধান্ত যদি ছাত্রলীগ নেয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কী প্রয়োজন?

১৫ বছর ধরে ছাত্রদল ক্ষমতার স্বাদবঞ্চিত এবং নেতা-কর্মীরা ভয়ভীতিতে আছেন। গত ডাকসু নির্বাচনে তাদের অবস্থান ছিল চতুর্থ। ফলে তারা ক্যাম্পাসে কোনো মিছিল বা সমাবেশ করতে চাইলে বাইরের নেতা-কর্মীদের সহায়তা নিতে পারে। কিন্তু প্রচণ্ড প্রতাপশালী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ কেন দুর্বল ছাত্রদলকে ঠেকাতে বাইরে থেকে ক্যাডার আনতে হবে? এর মাধ্যমে তো তারা নিজেদের ছাত্রদলের সমান করে ফেলল।

স্বাধীনতার পর থেকে আওয়ামী লীগের সমর্থক ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থন পেয়েছে, এ রকম প্রমাণ নেই। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন জয়ী হয়। ১৯৭৩ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জোট বেঁধেও ছাত্রলীগ জয়ী হতে পারেনি। ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নির্বাচন বানচাল করে তারা। ১৯৭৪ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে তৎকালীন সাত খুনের ঘটনা ঘটে। আশির দশকে ছাত্রলীগ নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ডাকসুর ভিপি হন জোটগত নির্বাচন করে। জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগ থেকে ডা. মোশতাক হোসেন, ছাত্র ইউনিয়ন থেকে নাসিরুদ্দোজা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। পরের বছর ছাত্রদল থেকে ভিপি-জিএস নির্বাচিত হন। কিন্তু স্বৈরাচারের পতনের পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজেদের যতই গণতান্ত্রিক বলে দাবি করুক না কেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে রাজি হয়নি। অনেক আন্দোলন ও আইনি লড়াইয়ের পর ২০১৯ সালে আরেকবার ডাকসু নির্বাচন হলেও ফলাফল ক্ষমতাসীনদের পক্ষে যায়নি। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নুরুল হকের ছাত্র অধিকার পরিষদ নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। তিনি ভিপি হন। ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদকসহ বেশ কিছু আসন পেলেও আর নির্বাচন করতে সাহস পায়নি। যে সংগঠনের পেছনে আওয়ামী লীগের মতো দল আছে, সরকার আছে, প্রশাসন ও পুলিশ আছে (ছাত্রলীগের হামলায় ছাত্রদলের অনেক কর্মী আহত হলেও মামলা হয়েছে ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের নামেই), সেই ছাত্রসংগঠন একটি নির্বাচন করতে কেন ভয় পায়?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.comক