মতামত

মা–বাবার বিচ্ছেদ: ‘তোমাদের মাঝে আমি কই?’

ব্রোকেন হোম/ অল অ্যালোন/ আই কান্ট সিম টু ফাইট দিস ফিলিংস
আই এম কট ইন দ্য মিডল অব দিস/ অ্যান্ড মাই ওন্ডস আর নট হিলিং
আই এম স্টাক ইন বিটুইন মাই প্যারেন্টস...

মার্কিন রক ব্যান্ড পাপা রোচের জনপ্রিয় একটি গান ‘ব্রোকেন হোম’–এ এভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে মা-বাবার বিচ্ছেদের ফলে সন্তানের যন্ত্রণাদায়ক শৈশব। ভোকালিস্ট জ্যাকোবি শ্যাডিক্সের বুকফাটা হাহাকার প্রকাশ হয়ে পড়ে। ভেঙে সবকিছু চুরমার করে দিতে চান তিনি। গোটা দুনিয়াটাই যেন ছারখার করে দিতে চান। যে ট্রমা নিয়ে তিনি বড় হয়ে উঠেছিলেন, যেটি প্রকাশ করার অনুভূতি এখনো হাতড়ে বেড়ান যেন এই রক গায়ক। মাদকের কাছে আশ্রয় নেওয়া ছাড়াও কী এক ভায়োলেন্ট জীবন পার হয়ে আসতে হয়েছে তাঁকে। কোনো এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন, ‘আমি সেই ভাঙা সংসার আর ভাঙা শৈশবের কালকে পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। আমি বড় হয়েছি ঠিকই, কিন্তু আমি জানতাম না, কীভাবে আমার অনুভূতিগুলোকে, আমার শৈশবের সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন অভিজ্ঞতাকে মোকাবিলা করব।’

২.
মা–বাবার বিচ্ছেদ হতে চলেছে। কিন্তু সন্তানের অধিকার কার কাছে যাবে, এ নিয়ে সরগরম আদালত পাড়া। দুটি শিশু একে অন্যের হাত ধরে ধীরপায়ে আদালতকক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছিল, হতবিহ্বল তারা। গত মঙ্গলবারের সকালের দৃশ্য ছিল এটি। নিরাপত্তা বাহিনীর তত্ত্বাবধায়নে আদালতে হাজির করা হয়েছিল তাদের। দুই বোন একে অপরের হাত ধরে কি তখন মনে মনে গাইছিল, আমরা করব জয়! সেটিই তো হওয়ার কথা। নয়তো মা–বাবার বিচ্ছেদ কোন সন্তানই মেনে নিতে পারে। এর জন্য নিশ্চয়ই আইনি মারপ্যাঁচ বোঝার বয়স কিংবা কথায় প্রকাশ করার সামর্থ্য লাগে না।

আমরা শিশু দুটির নাম জানি না। তবে তাদের মা-বাবা হচ্ছেন জাপানি চিকিৎসক এরিকো নাকানো এবং বাংলাদেশি মার্কিন নাগরিক ইমরান শরীফ। এ দম্পতির মধ্যে বিচ্ছেদ নিয়ে কয়েক দিন ধরে মুখর সংবাদমাধ্যমগুলো। জাপানে এক যুগের সংসারে তাঁদের তিন কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। পরে দাম্পত্যবিরোধে বিচ্ছেদের জেরে সন্তানদের অভিভাবকত্ব হারানের ভয়ে বড় দুই মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন প্রবাসী বাবা। অন্যদিকে করোনাকালের নানা বিধিনিষেধ গণ্ডিয়ে সন্তানের দাবিতে পিছু পিছু বাংলাদেশে ছুটে আসেন পাগলপারা মা–ও। এরপর তো কত কাণ্ড ঘটে গেল! মেয়েদের লুকিয়ে রেখেছিলেন বাবা, তাদের উদ্ধার করে নিরাপত্তা বাহিনী। আদালত তাদের উইমেন সাপোর্ট সেন্টারে পাঠালে অবশেষে মেয়েদের কাছে পান মা। অন্যদিকে সন্তানদের হারানোর আবারও সংশয় দেখা দেয় বাবার মধ্যে। কোনো পক্ষই সমঝোতায় না আসায় জটিল পরিস্থিতিতে বিচারকেরাও। আপাতত দুই বোনেরই জয় হয়েছে। দুই সপ্তাহ পারিবারিক পরিবেশে এক ফ্ল্যাটে মা–বাবার সঙ্গে থাকবে তারা। হয়তো সেখান থেকেই নতুন করে বুনন হতে পারে এমন রেখাচিত্র, ‘অতঃপর তাহারা সুখে–শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল।’

আবার আমরা এ–ও জানি, সব গল্পের শেষ লাইনটি এমন হয় না। সমঝোতা না হলে মা–বাবার বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে যে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় সন্তানদের—কার সঙ্গে থাকতে চাও—বাবা, নাকি মা? ইরানি পরিচালক আসগর ফরহাদির সিনেমা ‘আ সেপারেশন’–এর শেষ দৃশ্যের কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। বিচারকের বারবার প্রশ্নে মা–বাবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ১১ বছরের বালিকা তেরমেহ যখন প্রতিবারই বলছিল, কার কাছে যাবে সে স্থির করেছে, কিন্তু বলতে পারছিল না। একপর্যায়ে গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার। মনোরোগবিদেরা একটা কথা বলে থাকেন, কখনো শিশুকে জিজ্ঞেস করতে নেই—বাবা, নাকি মা—কাকে বেশি ভালোবাসে সে? শিশুর মনস্তত্ত্ব নিয়ে এর চেয়ে নিঠুর খেলা আর হয় না। মা–বাবার বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে পড়লে তেরমেহকে এমন প্রশ্নের সামনেই দাঁড়াতে হয়। কিন্তু পরিচালক তার উত্তর আমাদের জানতে দেন না আর। মা–বাবার বিচ্ছেদের ভয়ে হাসি হারিয়ে ফেলা, শান্ত–চুপচাপ হয়ে যাওয়া, বাবা–মাকে একসঙ্গে পেতে বারবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া মেয়েটির কান্নাই ছুড়ে দেন।

এটা কি শুধু বিবাহবিচ্ছেদ? মা–বাবার সঙ্গে সন্তানদেরও তো বিচ্ছেদ। ভাই বা বোনের সঙ্গে বোনের বা ভাইয়ের, বাদ যায় না ঘরের পোষা বিড়ালটা বা ব্যালকনির টবের ফুলগাছটা, অ্যাকুরিয়ামের মাছটাও যেন বুঝে যায় সবকিছু। আদর, মায়া, ভালোবাসা, মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগ—সবকিছুরই আজন্মের জন্য বিচ্ছেদ।

৩.
ধনী লোকজন বা তারকাদের বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে মানুষের হাসাহাসি বা তিরস্কারের শেষ থাকে না। কিন্তু আধুনিকতার কালক্রমে সব স্তরেই স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ এখন বেশ স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে বলতে গেলে। পরিবার, সমাজ ও ব্যক্তিগত ইচ্ছা–অনিচ্ছার প্রবল বাধা কাটিয়ে বিচ্ছেদের বাস্তবতাকে ঠিকই মেনে নিতে শুরু করেছে মানুষ। যার কারণে ঢাকায় প্রতি ৩৭ মিনিটে একটি বিবাহবিচ্ছেদের খবরও আমরা পাই। নারী বা পুরুষ উভয় পক্ষ থেকেই সেটি ঘটছে। জাত–পাত, বর্ণ–গোত্র, ধর্মের বাধা ডিঙানো ছাড়াও বিশ্বায়নের এ যুগে বিয়ে যখন রাষ্ট্রের গণ্ডিকেও ছাড়িয়ে গেছে, বিচ্ছেদও হাজির হয়েছে সেই বাস্তবতায়।

একই সময়ে আরেকটি ঘটনাতেও আমরা বাংলাদেশির স্বামীর বিপরীতে পাই ভিনদেশি স্ত্রীকে। যেখানে হায়দরাবাদের মেয়ে সাদিয়া শেখকে বিয়ে করে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী সানিউর নবী। ভারত থেকে মালয়েশিয়ায় দাম্পত্যজীবনের কিছুকাল কাটিয়ে যাঁরা ঢাকায় থিতু হন। বিচ্ছেদের জেরে সন্তানের অধিকারের জেরে আদালতে লড়ছেন তাঁরাও। শেষমেশ তিন বছরের অবুঝ শিশু আপাতত মায়ের জিম্মায় গেলেও সপ্তাহে কয়েক দিন বাবার জন্যও নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন আদালত। সন্তান প্রাপ্তবয়স্কে না পৌঁছাসহ আরও নানা কারণে তার আইনি অধিকার মায়েরাই পেয়ে থাকেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। সন্তান যার জিম্মাই যাক, তার জীবনেও যে নির্মম এক বিচ্ছেদ ঘটে যায়, পৃথিবীর কোনো আদালতে কি সেটার সুরাহা সম্ভব?

বিবাহবিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ার পেছনে নানা কারণ ব্যাখ্যা করে থাকেন সমাজবিজ্ঞানীরা, সেসব আমাদের কমবেশি সবারই জানা। কিন্তু এটা কি শুধু বিবাহবিচ্ছেদই? মা–বাবার সঙ্গে সন্তানদেরও তো বিচ্ছেদ। ভাই বা বোনের সঙ্গে বোনের বা ভাইয়ের, বাদ যায় না ঘরের পোষা বিড়ালটা বা ব্যালকনির টবের ফুলগাছটা, অ্যাকুরিয়ামের মাছটাও যেন বুঝে যায় সবকিছু। আদর, মায়া, ভালোবাসা, মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগ—সবকিছুরই আজন্মের জন্য বিচ্ছেদ। যার থেকে বাদ যায় না আত্মীয়স্বজন, এমনকি দেশও। সবকিছুর সঙ্গে তৈরি হয়ে যায় আজন্ম এক বিচ্ছিন্নতা। তারেক মাসুদের ‘অন্তর্যাত্রা’ সিনেমায় আমরা তেমনটিই দেখতে পাই। যেখানে জন্মভূমি, এর সংস্কৃতি, ধর্ম ও নানা ইতিহাসের সঙ্গে সংযোগ ঘটে লন্ডনে বড় হওয়া এক কিশোর সোহেলের, বাবার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। যে বাবার সঙ্গে তার কোনো স্মৃতি নেই। বিচ্ছেদের জেরে মা তার উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে তাকে বিদেশে নিয়ে গেলেও বাবার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এত দিন পর মায়ের সঙ্গে সে নতুন এক বিচ্ছেদ আবিষ্কার করে।

২০১৭ সালের আগস্টে ঢাকার উত্তরখানে মাদ্রাসাছাত্র এক কিশোর তারেক মোল্লার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। মা–বাবার মধ্যে বিচ্ছেদের পর আত্মীয়ের বাসায় ঠাঁই হয়েছিল তার। দরিদ্র পরিবারের বাবা কিংবা মা উভয় থেকেই ছিটকে পড়েছিল সে। কিন্তু ভেতরে বেজে যাওয়া বিচ্ছেদি সুর থেকে মুক্তি পেতে শেষমেশ মৃত্যুকেই বেছে নিল মাত্র ১৪ বছরের তারেক। স্কুল, খেলার মাঠ, অন্যান্য পরিবার বা সমাজের চোখে অচ্ছুত হয়ে ওঠাসহ কত কত যাতনাময় কল্পনাতীত বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তারেকদের, সেটি আমাদের অগোচরেই থেকে যায়। তাদের কান্না আমরা শুনতে পাই না। শ্যাডিক্স চিৎকার করে গানের মধ্যে বারবার সেটিই যেন বলছেন, ‘আই এম ক্রাইং ডে অ্যান্ড নাইট নাও, হোয়াটস ইজ রং উইথ মি?’

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক