গাধা লিখতে দুটো অক্ষর আর মানুষ লিখতে লাগে তিনটা। মানুষের চেয়ে গাধার দু-দুটি পা বেশি, কানও অনেক বড়। সংখ্যা ও মাপে দুয়ের কাউকেও বড়-ছোট ভেবে নেওয়া হয় না। গাধার লেজ আছে, মানুষের নেই বলে মানুষ উন্নত, তা নয়। সৃষ্টির সময় সৃষ্টিকর্তা মানুষকে দিয়েছেন বেশি বেশি, সে জন্যই মানুষ বড়, উন্নত, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ।
সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ পরিচয় বিষয়ে মানুষ কি সচেতন! মানুষ কি গৌরব বা আনন্দবোধ করে সৃষ্টিকর্তার এমন মহান কৃপায়। কেউ করে, আবার কেউ করে না। যারা করে না, কেমন তারা? বোকা, গাধা, চালাক, আধুনিক না বিশেষ! আধা বুঝে যারা সবজান্তা, অহংকারে যাদের পা মাটিতে পড়ে না, তারা চারপাশের মানুষ, এমনকি এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তাকেও টেক্কা দিতে চায়। এমনদের ঠাট্টা করে বলা হয় গাধা।
গাধা গাধাই, তার মধ্যে মানুষের উপাদান নেই। সে মানুষ হতে চায় কি না জানা নেই, চাইলেও তার পক্ষে তা অসম্ভব। গাধা মানুষ হতে পারবে না। অন্যদিকে গাধা হওয়া মানুষের পছন্দ নয়, তবু মানুষ অহরহ গাধা হয়, হচ্ছে। আকৃতির বদল নয়, শুধু বেচারা প্রাণীটার কল্পিত স্বভাব ভর করে মনুষ্যচরিত্রে। গাধাদের খুব বোকা ভাবা হয়, আর কোনো মানুষ বেশি মাত্রায় বোকামো করে ফেললে বলা হয়ে থাকে গাধামো। মানুষের মানানসই যোগ্যতা হচ্ছে বুদ্ধিমত্তা, কিন্তু প্রিয় চর্চার বিষয় চালাকি। জন্তু-জানোয়ারের বুদ্ধিমত্তায় মানুষেরা বিস্মিত হয়, কিন্তু মানুষের মধ্যে অনেকেই নিজ স্বার্থ বা বিশেষ গৌরব অর্জনের জন্য বুদ্ধিমত্তার চেয়ে চালাকির চর্চা শ্রেয়তর মনে করে থাকে। নিশ্চয়ই সৃষ্টির আগে সৃষ্টিকর্তা জানতেন শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠার সব যোগ্যতা দান করলেও সে পথে সব মানুষ পা বাড়াবে না।
অনেক মানুষ নিজ ধ্যান-জ্ঞানের দোর্দণ্ড প্রতাপে ধরাকে সরা জ্ঞান করে জানান দিয়ে যাবে বাহাদুরি। সে আত্মতুষ্টিতে সমাজ, সংসার ও অন্য মানুষদের জীবন রসাতলে গেলেও তারা থাকবে তোয়াক্কাহীন। তোয়াক্কাহীন এসব মানুষ চেনে শুধু নিজেকে, নিজ স্বার্থ, নিজ গোষ্ঠীকে। মানুষ তার গোষ্ঠী নয়, নিজের বিবেচনা ধ্যান-জ্ঞান যে বা যাদের সঙ্গে মিলে যায়, সে বা তারাই আপন, নিজ গোষ্ঠীভুক্ত, দরকারি তারা। প্রয়োজন তাদেরই শুধু। তারাই যোগ্যতর, ভালো, কৃতী। কেবল তাদেরই ভালো থাকার অধিকার, ভালো জোটার অধিকার।
গাধা ও মানুষের মধ্যে ব্যাপক তফাত। মানুষেরা গাধা হতে চায় না, গাধা বানাতে চায়। অন্যদের বানাতে গিয়ে নিজেরাই গাধা বনে যায়, তা টের পায় না। অন্যের মধ্যে গাধামো আবিষ্কার করতে পারে মানুষ। অন্যজনের গাধামোতে অধিক পরিমাণে আনন্দিত হয়। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ পরিচয়ের মানুষ অন্যের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হয়ে আত্ম-আবিষ্কারের সাধ্য হারিয়ে ফেলে। আত্মতুষ্টির ঘোর তাদের করে রাখে আহ্লাদে আটখানা। তা গাধামোর বিশেষ আর এক ধরন।
যেসব মানুষ নিজেকে বুদ্ধিমান আর অন্যকে বোকা ভাবতে পছন্দ করে, তারা স্বভাবে হয় একচোখা ও একরোখা। নিজেরা অনেক মানে, বোঝে এবং অন্যরা কিছুই বোঝে না মনে করে। তারা জাহির করতে ভালোবাসে। চোখেমুখে নিজেরাই শুধু বলে থাকে এবং অন্যরা তা কান পেতে কেবলই শুনবে বলে আশা করে। নিজে যা ভাবছে, ষোলো আনা ঠিক, অন্যদের ভাবনা এক শ ভাগ ভুল। যারা অন্যকে ছোট, দুর্বল ও ভুল ভাবতে ভালোবাসে, তাদের মধ্যে অন্যদের শোনা, জানা, বোঝার আগ্রহ থাকে না। এমনটা স্বাভাবিক নয়। শিষ্টাচার, সভ্যতার তোয়াক্কা না করে নিজেকে জাহির অবশ্যই আত্মম্ভরিতা এবং গাধামো। অন্যকে ছোট ভেবে অসম্মান করে নিজেকে বড় প্রমাণের চেষ্টা কৌতুককর। আমি ভালো, তুমি খারাপ। আমি সত্য, তুমি মিথ্যা। এসবই শ্রেষ্ঠ পরিচয়ের বিপরীত। অস্বাভাবিকতা। অসম্মান, অবিবেচনা, মিথ্যাচার, হিংসা যা যা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ পরিচয়কে ÿক্ষুণ্ন করে, সবই গাধামো সমতুল্য।
টেলিভিশন ক্যামেরা নানা উদ্যাপনের বেলায় মানুষ ধরে ধরে এই দিন কেন, অমুক দিনের তাৎপর্য কী, এসব প্রশ্ন করে সাধারণের গাধামো আবিষ্কার করে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা দেখে কমবেশি দুঃখিত, মর্মাহত হয় অনেক মানুষ। বড় বড় মানুষের বড় বড় গাধামো দিব্যি হজম করা হচ্ছে নিত্যদিন। আর কৌতুকের ইচ্ছা জাগে সামান্যদের গাধামো ফলাও করে দেখিয়ে। কেন এই গাধামো? ভেবে দেখা হয়ে ওঠে না। গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের কর্তব্যজ্ঞানহীন আচরণ প্রায় প্রত্যহের ঘটনা। তা সানন্দে মেনে চলার রীতি একটা ফাঁপা সমাজ রচনা করে চলেছে।
সত্যের দশা করুণ, মিথ্যা দাপুটে। সচেতনতার জ্ঞান ডিঙিয়ে অজ্ঞানতা ও অসচেতনতা যদি ঘাড়ে উঠে বসার সুযোগ পায়, তা হজমের অভ্যাসও মানুষকে রপ্ত করে নিতে হয়। এমন অস্বাভাবিক কাণ্ডে যদি নতুন প্রজন্মের একটা অংশ অসম্পূর্ণতায় বেড়ে ওঠে, সে দোষ শুধু সেই সাধারণের নয়। অসচেতনতা অজ্ঞানতার প্রকাশ ঘটিয়ে একশ্রেণির মানুষের সামান্য মর্যাদাহানি ঘটে না। দায়িত্বশীল পরিচয় অটুট থাকে। ঘাড়-মাথা বাঁকিয়ে, কুঁজো হয়ে তেমন দায়িত্ববানদের যদি মেনে নেওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়ে যায়, সাধারণদের মনের বৃদ্ধি সঠিক ঘটবে, তেমন আশা দুরাশাই। টেলিভিশনের পর্দায় আলাদা করে সামান্যজনদের অজ্ঞতা প্রচার করলে তা বিনোদনের বিষয় হয়ে ওঠে, হতাশাও বাড়ায়। ব্যক্তিবিশেষের অজ্ঞানতা, বোকামো বা গাধামো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তার নিশ্চয়ই পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে। মানুষটা একটা কালের অংশ, তা-ও অস্বীকার করা যায় না।
একটা কালে অসংখ্য অভিভাবককে মানতে হয়েছে। বেড়ে ওঠার কালে অনেকগুলো স্তরে, সাবধানতা মেনে নানাভাবে যে শিক্ষা গ্রহণের রীতি ছিল, তা ভেঙে চুরমার। শৈশব-কৈশোরে প্রথম শিক্ষা গ্রহণ এবং অভিভাবকত্ব পাওয়া হতো নিজ পরিবার থেকে। তারপর চারপাশের পরিবার থেকে। গুরুজন, স্থানীয়দের অভিভাবকত্বও মানতে হতো। বাড়িতে কর্মরত বেশ পুরোনো মানুষদের কথা শোনা, নিষেধ মানা পারিবারিক নিয়ম ছিল। স্কুলে ছিলেন শিক্ষকেরা, পাড়ায় বয়সে বড় ভাইবোনেরা। সংস্কৃতিকর্মী, চিকিৎসক, মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পূজারিসহ বহু পরিচয়ের মানুষের নানা রকম অভিভাবকত্ব ছিল মাথার ওপর। দেশজুড়ে এখন যে রকম অভিভাবকত্ব মেলে তা বেয়াড়াগিরি শেখায়, বাহাদুর বানায়।
মানুষ দুরকমের। একদল বিনয়ী, একদল বাহাদুর। বাহাদুরদের বাহাদুরি দেখানোর সাধ অসীম। তারা থামতে জানে না। যুক্তি মানে না। যুক্তি না মানা মানুষেরা চোখ থাকতেও অন্ধের মতো। স্বার্থপর, বেপরোয়া, নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না। বিনয়ী গোত্রকে তারা সানন্দে ভাবে গাধা কিসিমের। অচল ভাবে, ভাবে সময়ের অযোগ্য। তুচ্ছ জ্ঞান করে। বিনয়কে ভাবে দুর্বলতা, ভাবে অজ্ঞান। নিজেতে মুগ্ধ বাহাদুরেরা তাই আপনাকে জাহির করতে, বড়ত্ব প্রমাণ করতে বিনয়ীদের কাঁধে পা তুলে দিতে চায়। দেয়ও। ভদ্রতা, বিনয় যে অসাধারণ শক্তি-সব মানুষের তা অর্জন, ধারণের সামর্থ্য নেই, জানতে পারে না বিনয়হীনেরা।
জ্ঞানী ও অজ্ঞানের মর্মান্তিক পার্থক্য এখানেই। দুপায়ের মানুষকে চার পায়ের গাধার সঙ্গে তুলনা করে থাকে মানুষেরাই। গাধামো বহুকাল ধরে মনুষ্যসমাজে রয়েছে। সময় এগিয়েছে। উন্নত থেকে উন্নততর প্রযুক্তি, কলাকৌশল এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। গাধামো এমনকালে বাড়ছে না কমছে, তা নিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে ভাবা বোধ হয় জরুরি। গাধামো শুধুই হাসি-ঠাট্টার বিষয়, এমন গা বাঁচানো স্বভাব বজায় থাকলে বা মানতে শিখলে তার বৃদ্ধি তো রোধ হবে না।
আফজাল হোসেন: অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, লেখক ও নির্দেশক
afzalhossain1515@yahoo.com