মানসিক স্বাস্থ্যকে অবহেলা নয়

এবার বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘মানসিক স্বাস্থ্যে মর্যাদাবোধ: সবার জন্য প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা’। সাধারণ মানুষ মানসিক রোগ বা সমস্যাকে ইতিবাচকভাবে দেখতে শুরু করেছে, এটি আশার কথা। কিন্তু শারীরিক রোগকে যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়, মানসিক রোগের ক্ষেত্রে তা হয় না। শারীরিক অবস্থার সামান্য অবনতি হলেই আমরা নিঃসংকোচে চিকিৎসকের কাছে যাই। তাহলে মন, যেটি শরীরের চেয়ে বেশি জটিল, এর পরিচর্যা বা চিকিৎসার জন্য কতজন যথাসময়ে চিকিৎসকের কাছে যান?  সবার কাছে প্রাথমিক পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার কার্যক্রম নিলে এই সমস্যা অনেকটাই কমবে। এই রোগের প্রতিকারে সামাজিক ও আবেগিক দক্ষতার পাশাপাশি মানসিক চাপ মোকাবিলার সক্ষমতাও বাড়বে।

মানসিক স্বাস্থ্যের ভিত্তি তৈরি হয় মায়ের গর্ভাবস্থা থেকে। এরপর পরিবারে গুড প্যারেন্টিং, প্রাগ–স্কুল ও স্কুল পর্বে মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা, উন্নত চাইল্ড কেয়ার সেন্টার, কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও সুরক্ষা থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া ও চিকিৎসা গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।

 ষাটের দশকে বিএলএস (বেসিক লাইফ সাপোর্ট) এবং সিআরপি (কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন) যাত্রা শুরুর পর থেকে পথচারী থেকে শুরু করে অনেক রোগীর জীবন রক্ষা পেয়েছে। একই রকমভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের বেলায় এমন ফার্স্ট এইড বা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার একান্ত প্রয়োজন। কমপক্ষে প্রতি চারজনের একজন যেকোনো সময় গুরুতর মানসিক সমস্যায় পড়তে পারে, যাদের জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা প্রয়োজন। এবং সেটি হতে পারে বাড়িতে, স্কুলে, যানবাহনে, কর্মস্থলে, অবসর ও বিনোদনকেন্দ্র, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র এবং সাধারণ হাসপাতাল ও মানসিক হাসপাতাল—সব জায়গায়।

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ক. সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ‘সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড হচ্ছে গুরুতর মানসিক সংকটের পর মানবিক, সহযোগিতামূলক ব্যবহারিক সহায়তা প্রদান।’ যেমন: ধর্ষণ, অ্যাসিড আক্রান্ত, পারিবারিক সহিংসতার শিকার, আত্মহত্যার চেষ্টার পর, ইভ টিজিং ও ডিভোর্সের পর, আগুন লাগা, বিল্ডিং ধস, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি। এই সেবা যে কেউ দিতে পারেন—স্বাস্থ্যকর্মী, ভলান্টিয়ার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী প্রমুখ। এর লক্ষ্য হচ্ছে পরবর্তী জটিলতা ও ক্ষতি কমিয়ে আনা। এটি ভুক্তভোগীর মর্যাদা, সাংস্কৃতিক সক্ষমতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে করতে হবে। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে ১. তাৎক্ষণিক যত্নসহায়তা দেওয়া। ২. তাদের প্রয়োজন ও উদ্বেগগুলো জানা। ৩. মৌলিক চাহিদা (খাদ্য, পানি, তথ্য) পূরণে সহায়তা করা। ৪. তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা (কথা বা কাহিনি বলার জন্য চাপ দেওয়া যাবে না)। ৫. তাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা বা তাদের শান্ত রাখতে সাহায্য করা। ৬. তথ্যকেন্দ্র ও সামাজিক সহায়তা কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া। ৭. বাড়তি ক্ষতি থেকে রক্ষা করা।

এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনটি এল মনে রাখতে হবে। ১. লুক অর্থাৎ দৃষ্টি দেওয়া: তাদের নিরাপত্তার দিকে দৃষ্টি দেওয়া, জরুরি প্রয়োজনের দিকে দৃষ্টি দেওয়া এবং তাদের মধ্যে যাদের ভেতর তীব্র কষ্ট-যন্ত্রণা ও মানসিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে, তাদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া। ২. লিসেন বা শোনা: মনোযোগ দিয়ে তাদের চাহিদা ও উদ্বেগগুলো শোনা; তাদের স্বস্তি দিতে ও শান্ত রাখতে তাদের কথা শুনুন। ৩. লিংক বা সংযোগ স্থাপন: মৌলিক চাহিদা পূরণ ও অন্যান্য সেবা পাওয়ার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ বা কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে হবে, সমস্যার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়তা করতে হবে, প্রয়োজনীয় সব তথ্য সরবরাহ করতে হবে, সামাজিক সহায়তা দিচ্ছে এমন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে দিতে হবে।

খ. মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইড: রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও সহায়তা দেওয়া। এই স্বাস্থ্যসেবা ততক্ষণ পর্যন্ত দিতে হবে, যতক্ষণ না পেশাদার ব্যক্তির দ্বারা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে ১. ব্যক্তির জীবন রক্ষা করা, যেখানে ব্যক্তির জীবন হুমকির মুখে (আত্মহত্যার চেষ্টা)। ২. মানসিক রোগ যাতে আরও গুরুতর পর্যায়ে না যায়, সেটি প্রতিরোধ করা (বেশির ভাগ আত্মহত্যা হচ্ছে বিষণ্নতা রোগের ক্রমাবনতির জন্য)। ৩. মানসিক সমস্যা থেকে উত্তরণে ও তা থেকে মুক্ত থাকতে সহায়তা করা। ৪. মানসিক রোগীদের স্বস্তিতে রাখার চেষ্টা করা।

কারা এই ফার্স্ট এইড দেবেন: পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব, অফিস সহকর্মী, শিক্ষক, পুলিশ এবং রোগীর সামাজিক নেটওয়ার্কের মধ্যে যাঁরা রয়েছেন, তঁাদের যে কেউ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারেন। এদের সামান্য ট্রেনিং দিয়ে দক্ষতা ও জ্ঞান বাড়ানো যেতে পারে। তঁারা মূলত রোগের লক্ষণগুলো চিহ্নিত করবেন এবং সঠিক চিকিৎসা নিতে রোগীকে নির্দেশনা দেবেন।

কেন মেন্টাল ফার্স্ট এইড: মানসিক সমস্যা সাধারণ একটি সমস্যা, বিশেষ করে বিষণ্নতা, উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা জাতীয় মানসিক সমস্যা, মাদকাসক্তি, আত্মহত্যার চেষ্টা প্রভৃতি অতি সাধারণ মানসিক সমস্যা। মানসিক সমস্যা নিজেদের ইচ্ছাশক্তিবলে কাটানো সম্ভব।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে দেখা যায়, মানসিক রোগীদের খুব কমসংখ্যক প্রকৃত আধুনিক চিকিৎসা নেন। আবার অনেকে দীর্ঘ সময় অপচিকিত্সা করার পর বিজ্ঞানভিত্তিক মেডিকেল চিকিৎসা নিতে আসেন। মানসিক রোগের চিকিৎসা নিতে যত দেরি হবে, জটিলতা তত বাড়বে এবং চিকিৎসার ফলাফলও কম পাওয়া যাবে। তাই মানসিক রোগীকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে, সব লোকলজ্জা অগ্রাহ্য করে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা ঘরে শারীরিক সমস্যার জন্য ফার্স্ট এইড–সহায়তা গ্রহণ করি। তেমনি সবাইকে প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড সম্বন্ধে জানতে হবে ও তা ব্যবহারে দক্ষ হতে হবে।

ডা. মো. তাজুল ইসলাম: অধ্যাপক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।