করোনাভাইরাস আসার পর মানুষের মধ্যে একধরনের ভয়, বলা যায় আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বলছে, প্রতিবছর ইনফ্লুয়েঞ্জায় ২৯ থেকে ৬৫ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ‘হু’ আরও জানাচ্ছে, পৃথিবীতে মৃত্যুর প্রধান কারণের মধ্যে ১ নম্বর হলো হৃদরোগ, ২০১৬ সালেই দেড় কোটি মানুষ পৃথিবীজুড়ে হৃদরোগে মারা গেছে। তারপর আছে সিওপিডি, তারপর ফুসুফুসের ক্যানসার, ৪ নম্বর প্রাণঘাতী অসুখ হলো ডায়াবেটিস। কিন্তু এগুলোতে অনাক্রান্ত মানুষের মনে আতঙ্ক আসে না। সিএনএন বলছে, করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন এগারো শর বেশি মানুষ। কিন্তু এই সামান্য সংখ্যাতেই মনোবল এত ভেঙে যাচ্ছে কেন?
কোনো একটি রোগ, তাকে যদি কোনোভাবেই ঠেকানো না যায়, সে যদি দ্রুত ছড়াতে পারে, মৃত্যু ঘটায়, তাহলে সে দুনিয়াকেই শেষ করে দিতে পারে। অর্থাৎ মানব প্রজাতিই বিলুপ্ত। ভয়ধরানো একটি ব্যাপার তো বটেই। হৃদরোগে বছরে কোটি মানুষ মারা গেলেও পুরো প্রজাতি ধ্বংস হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। নির্দিষ্ট একটি মানুষের এর থেকে অব্যাহতি পাওয়ারও বেশ কিছু চিকিৎসা ও উপায় আছে। যদি আমার হয়! ব্যাপারটা সেভাবে চলে আসছে না। কিন্তু অজানা একটি নতুন রোগ, মুহূর্তে এর কাছ থেকে ওর কাছে, এই দেশ থেকে ওই দেশে চলে যাচ্ছে, কোনো চিকিৎসা নেই, এমন মৃত্যুরোগকে ভয় পাওয়ার কারণটা অনেক গভীরে। তখন জীবন ও পৃথিবী সম্পর্কে সাময়িক যে ভাসা ভাসা দর্শন মানুষের মনে রয়েছে, তাতেই আঘাত চলে আসছে। ‘কী হতে পারে’/ ‘কী হতে পারে না’/ ‘কী হওয়া উচিত’/ ‘কী হওয়া উচিত নয়’, এগুলোর ভারসাম্যে ভীষণ গোলযোগ বেধে যাচ্ছে। ব্যাপারটা নতুন নয়। বড় বড় সংকটে মানুষ এভাবেই চিন্তা করে। এভাবেই অভাবিত মানসিক পীড়ন হঠাৎই উপস্থিত হয়ে, একটা নিশ্চিত, প্রায় ছকে বাঁধা জাগতিক আটপৌরে মনোজগৎ লন্ডভন্ড করে ফেলে। পৃথিবী আছে কিন্তু মানুষ নেই! ভয়াবহ চিন্তা! মনের যত প্রকার ব্যাখ্যা—শক্তি আছে, কোনোটিই সেখানে টেকে না।
প্রশ্ন হলো, নিকট ভবিষ্যতে এমন কিছু কি ঘটতে পারে, যার কারণে পুরো মানবসভ্যতাই ধ্বংসের সম্মুখীন হবে? তেমন যে অনেক কিছুই আছে, সে কথা সবাই জানেন। কিন্তু সম্ভাবনার ভিত্তিতে বিজ্ঞানী এবং গবেষকেরা কয়েকটি বিষয়কে পৃথিবীর জন্য হুমকি বলে মনে করছেন। যেকোনো হুমকি, যেকোনো ঝুঁকিই, পরিশেষে না-ও ঘটতে পারে। এর শুধু শূন্য থেকে এক শ র ভেতরে একটা সম্ভাবনা থাকে। শূন্য হলে সেটা কোনো দিনই ঘটবে না। এক শ হলে অবশ্যম্ভাবীভাবে ঘটবে। তাই বিশেষজ্ঞরা এই দুই সংখ্যার মধ্যে একটি সংখ্যা দিয়ে ঝুঁকির সম্ভাবনাটিকে প্রকাশ করেন—বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনার মতোই। তবে বৃষ্টির পূর্বাভাস এখন অনেক নির্ভরযোগ্য হয়ে গেছে, মানবসভ্যতার হুমকির পূর্বাভাস সেভাবে নির্ভরযোগ্য নয়।
বিভিন্ন মতে এই ঝুঁকির তালিকাটি বিভিন্নভাবে সাজানো হয়েছে। তালিকায় মোটামুটি একই ধরনের ঝুঁকি রয়েছে, তবে এক তালিকার প্রথম ঝুঁকিটি হয়তো অন্য তালিকায় প্রথম স্থানে নেই।
প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগ
একটি প্রাণঘাতী, সংক্রামক রোগ এসে যেতে পারে, যার কোনো চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বের করতে পারবেন না। পারলেও সেই সময়ের মধ্যে সেটা মানবসভ্যতাকে প্রায় ধ্বংস করে দেবে। এমন সম্ভাবনা সব তালিকাতেই পাওয়া যাবে। তবে সব তালিকায় সেটা ঝুঁকির প্রথম স্থানে নেই। এ বিষয়টি কিছুদিন পরপরই চলে আসে, বিশেষত তখন, যখন এমন কিছু মারাত্মক রোগ সংক্রামক হওয়া শুরু করে। যেমন সার্স, বার্ড ফ্লু। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইউরোপে বুবনিক প্লেগ হয়েছিল, তাতে ইউরোপ মহাদেশের এক–তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে গুটিবসন্ত, কলেরা, এসব মহামারি এসে বিপুল জনপদ উজাড় করে দিয়েছে।
জৈব অস্ত্র
এখন ধারণা করা হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যান্য কারণে মিউটেশনের মাধ্যমে এমন কিছু জীবণু আসতে পারে, যার বিরুদ্ধে কোনো ওষুধ কাজ করবে না। বাতাসের মাধ্যমে সেটা একজনের কাছ থেকে আরেকজনের কাছে চলে যাবে, এভাবে পৃথিবীর মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। অনেকে আবার ভাবছেন, বড় বড় দেশ যে জৈব অস্ত্র নিয়ে গবেষণা করছে, তাদের ল্যাবরেটরির মারাত্মক কোনো জীবাণু কোনোভাবে বাইরে বের হয়ে সভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
পারমাণবিক যুদ্ধ
তবে ১ নম্বরে এখনো রয়েছে পারমাণবিক যুদ্ধ। পরাশক্তিগুলোর অস্ত্রাগারে যে পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র আছে, তা পৃথিবীকে সহজেই ধ্বংস করে দিতে পারে। পৃথিবীর এমন একটি বড় সংকট এসেছিল ১৯৬২ সালে, যাকে বলে কিউবা মিসাইল সংকট। আমেরিকা ও তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবার কাছে ক্যারিবিয়ানে যুদ্ধজাহাজ নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, আর পৃথিবীর মানুষের ভবিষ্যতের আলো নিভে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এমন যে আবার হবে না, সে কথাও জোর দিয়ে বলা যায় না। তিন বছর আগে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের অবনতি এবং ফলে হাইড্রোজেন বোমা নিয়ে উৎকণ্ঠার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। এটা কিউবা মিসাইল সংকটের কাছাকাছি না হলেও পারমাণবিক যুদ্ধ এখনো মানবসভ্যতার জন্য প্রধান ঝুঁকি হিসেবে রয়ে গেছে।
বিপুল আগ্নেয়গিরি
প্রাকৃতিক দুটো দুর্যোগের সম্ভাবনাকে বেশ বড় ঝুঁকি ধরা হয়। একটি হলো সুপার ভলকানো—বিপুল আগ্নেয়গিরি। বেশ কটি সুপার ভলকানোর সন্ধান বিজ্ঞানীরা বের করেছেন। একটা সাধারণ আগ্নেয়গিরির প্রভাবই যে কত ব্যাপক হতে পারে, তা ২০১৫তে জাপানের সেই বিপুল ধূম্র উদ্গিরণকারী আগ্নেয়গিরি থেকেই বোঝা যায়। আকাশ কালো হয়ে যায়। শত মাইল দূরে গিয়ে ছাই পড়তে থাকে। জাপানের ক্ষেত্রে অনেকটা আকাশপথজুড়ে বিমান যাতায়াত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সুপার ভলকানো শুরু হলে বিজ্ঞানীরা কয়েক দিন বড়জোর কয়েক মাস আগে আভাস পেতে পারেন, তার আগে নয়।
উল্কা বা ধূমকেতু
আরেকটি বড় সংকট হতে পারে, মহাশূন্য থেকে কোনো প্রকাণ্ড উল্কাপিণ্ড বা ধূমকেতু যদি এসে পৃথিবীর ওপর পড়ে, তাহলে পৃথিবী নিজে ধংস না হলেও মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণিকুল ধংস হয়ে যেতে পারে। উল্কাপিণ্ড আঘাত করার পর সেটা পারমাণবিক বোমার মতোই বিস্ফোরিত হবে। তার থেকে যে ধূলি আকাশে ছড়িয়ে যাবে তাতে আংশিক, এমনকি গোটা পৃথিবী বহু বছর অন্ধকার হয়ে থাকতে পারে। পৃথিবীকে প্রতিদিন অসংখ্য উল্কাপিণ্ড আঘাত করছে। কিন্তু সেগুলো ছোট হওয়ায় মাটিতে পড়ার আগেই বাতাসে জ্বলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। যাকে আমরা ভুল করে বলি, তারা খসে পড়া। আধুনিক কালে সবচেয়ে বড় উল্কাপিণ্ড পড়েছিল ১৯০৮ সালে রাশিয়ার সাইবেরিয়ার তুঙ্গুস্কায়, সেটার কম্পন পৃথিবীকে সাতবার পাক খাইয়েছিল, আণবিক বোমার মতো প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। ধারণা করা হয়, উল্কা বা ধূমকেতুর কারণেই সাড়ে ছয় কোটি বছর পূর্বে পরাক্রমশালী ডাইনোসররা হঠাৎ বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে এই ঝুঁকিটিতে এখন একটু সময় পাওয়া যাবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমন বড় কিছু একটা পৃথিবীকে এসে আঘাত করার অনেক আগেই টেলিস্কোপে ধরে ফেলা যাবে। আর কিছু না হোক, পঞ্চাশ–একশ বছরের একটা আগাম পূর্বাভাস দেওয়া যাবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
অনেকের বিবেচনাতেই এই ঝুঁকিটি প্রায় ১ নম্বরে এসে দাঁড়াচ্ছে। কম্পিউটারের বা মেশিনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যাকে ইংরেজিতে বলে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সংক্ষেপে এআই (AI)। শুধু সোফিয়া নামের রোবটটি নয়, তার যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আছে তার থেকে অনেক বেশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্মুখীন আপনি ইন্টারনেট ব্যবহার করলে প্রতিদিনই হচ্ছেন। ফেসবুকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আছে। সে বের করছে আপনি কাকে কাকে চিনতে পারেন। গুগুলের আছে, সে বুঝতে পারছে আপনি কী খুঁজছেন, কোনটা প্রথমে দেখালে আপনার জন্য লাগসই হবে। গবেষণা, অর্থনীতি, সমরাস্ত্র, এমন অসংখ্য বিষয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ঢুকে পড়ছে। রোবট তো তৈরি হচ্ছেই। কলকারখানায় কাজ করছে, কিছুদিন পর বাসাবাড়ির অনেক কাজ তারাই করবে। অবস্থা এমন হবে যে মানুষ বড় বড় কাজের দায়িত্ব এই এআইকেই দেবে। ইতিমধ্যেই কিছুটা দিয়ে ফেলেছে। তখন? তারা যদি বিগড়ে যায়, অথবা সত্যিসত্যিই বুদ্ধি করে মানুষের বিপক্ষে চলে যায়, তাহলে মানবসভ্যতা বিরাট ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। এমনকি বিলুপ্তও হয়ে যেতে পারে।
পরিবেশদূষণ
পরিবেশদূষণের মাধ্যমে মানুষ ইতিমধ্যেই পৃথিবীর আবহাওয়ায় বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। তার ফলাফলও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু হয়ে ওঠার কথা উঠলেই বাংলাদেশের কথা চলে আসে। বাংলাদেশ এই হুমকির অগ্রভাগে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই পরিবেশদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং পৃথিবীকে অচিরেই মানুষের বসবাসের অযোগ্য করে তুলবে। উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে সভ্যতাই এখন হুমকির সম্মুখীন।
ন্যানো টেকনোলজি
ন্যানো টেকনোলজির নামে একটি নতুন প্রযুক্তি দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। সেটা বস্তুর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণু ব্যবহার করে আণুবীক্ষণিক মেশিন বানাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন একটি মেশিন কেউ বানাবে, যেটা সব জৈব পদার্থ শুধু খেতে থাকবে এবং নিজের প্রতিরূপ তৈরি করতে থাকবে। একটা থেকে দুইটা, তারপর এভাবে হাজার, কোটি, শুধু বাড়তেই থাকবে। অনেকটা ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার মতো কিন্তু জীবন্ত নয়, তবে আরও ভয়ংকর।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, অদূরভবিষ্যতে মানবসভ্যতার জন্য যতগুলো ঝুঁকি আছে, তার মধ্যে মানুষের তৈরি ঝুঁকির সংখ্যাই বেশি এবং সেগুলোই প্রথম দিকের আসন গেড়ে বসে আছে। মানুষ সৃষ্টি করতে পারে, আবার ধ্বংসও করতে পারে। সন্দেহ নেই, সভ্যতা রক্ষায় মানুষই আবার মানুষের মনে আশার দুর্দমনীয় প্রদীপ জ্বালিয়ে দিতে পারবে। করোনাভাইরাস আসবে–যাবে, কিন্তু পৃথিবী বিলয় না হওয়া পর্যন্ত মানুষ টিকে থাকবে।
মোস্তফা তানিম: লেখক, তথ্য ও প্রযুক্তিবিদ