ক্ষুদ্র জাতিসত্তা

মাতৃভাষায় শিশুশিক্ষা কোন পথে?

এ বছর ১ জানুয়ারি বিপুল উৎসাহে বিনা মূল্যে পাঠ্যবই বিতরণের মধ্য দিয়ে বই উৎসব পালিত হয়েছে। এবার সারা দেশের কোটি শিশুর সঙ্গে পাঁচটি জাতিসত্তার (মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, সাদরি ও গারো) কয়েক হাজার শিশুও বেশ খুশি নিজ মাতৃভাষায় লেখা বই হাতে পেয়ে। আশার কথা হলো, দেরিতে হলেও অবশেষে আংশিকভাবে পাঁচটি জাতিসত্তার শিশুদের হাতে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষার বই পৌঁছেছে।
২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতির ১৮, ১৯, ২০ ধারা [যেখানে ‘আদিবাসী’ শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকারের বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে] দেখে এ দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল। ২০১৪ সাল থেকে প্রাক্-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুদের নিজস্ব মাতৃভাষায় পড়ানোর কথা থাকলেও ক্ষুদ্র পরিসরে সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি এসেছে ২০১৭ সালে! ক্ষুদ্র বলছি এই অর্থে, দেশে প্রায় ৪৫টির মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৫টি ভাষায় বই প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। অন্যান্য জাতিসত্তার নিজস্ব ভাষা থাকলেও কতক ক্ষেত্রে নিজস্ব বর্ণমালা না থাকা, বর্ণমালা ব্যবহারে নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে (সাঁওতাল) মতপার্থক্য দেখা দেওয়া ইত্যাদি কারণে বই ছাপানোর কাজটিও পিছিয়ে পড়ছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দাবি করে থাকে!
মাত্র ৫টি জাতিসত্তার শিশুদের জন্য পাঠ্যবই ছাপানো হলেও সমন্বয়হীনতার কারণে এ উদ্যোগটি কতটুকু সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে প্রাক্-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুদের নিজস্ব মাতৃভাষায় পড়ানোর কথা থাকলেও সরকার প্রাক্-প্রস্তুতি হিসেবে সেসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এ বিষয়ে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বিশেষত চাকমা ও মারমা ভাষার ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে চরম অব্যবস্থাপনা। কেননা, এ দুটি ভাষার বইগুলো নিজস্ব বর্ণমালায় না হওয়ায় অধিকাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা প্রশিক্ষণের অভাবে নিজেরাই পড়তে-লিখতে সক্ষম নন।
তিন পার্বত্য জেলা শিক্ষা অফিস থেকে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীদের তালিকা দেখে বিদ্যালয়গুলোতে বই বিতরণের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে বা এখনো হচ্ছে। কিন্তু বই বিতরণের চেয়ে মুখ্য হলো সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিজ নিজ ভাষায় প্রশিক্ষিত কি না, তা আগে যাচাই-বাছাই করে নেওয়া। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার নির্দেশনা যেহেতু সরকারিভাবে নির্ধারিত ছিল, তাই বই ছাপা ও বিতরণের আগে জরিপের মাধ্যমে কোন কোন বিদ্যালয়কে এর আওতায় আনা হবে, তা যাচাই-বাছাই করে সেসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল। হাতে গোনা কিছু বিদ্যালয়ে হয়তো প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষক আছেন। কিন্তু সেই সংখ্যাটা পর্যাপ্ত নয়।
মাতৃভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করতে হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের ন্যূনতম দ্বিভাষিক শিক্ষায় প্রশিক্ষিত হতে হবে। কেবল লাখ লাখ টাকা খরচ করে হাজার হাজার বই ছাপিয়ে বিতরণের প্রচারণা আর নতুন বই হাতে উচ্ছ্বসিত কিছু শিশুর ছবি ছাপালেই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুরা ‘মাতৃভাষা’য় শিক্ষা লাভ করতে পারবে না। এই চরম সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে সরকারের এই মহতী উদ্যোগ বছর শেষ না হতেই মুখ থুবড়ে পড়ার ব্যাপক আশঙ্কা আছে। শুধু তা-ই নয়, মাতৃভাষায় জাতিসত্তার শিশুদের পাঠদানের কাজটি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে কোন বিভাগ বা কারা মনিটর করবে, সে বিষয়েও স্পষ্ট কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি। তাই শুধু প্রচারণার জন্য বাগাড়ম্বর না করে শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করে এই মাতৃভাষায় পাঠদান-প্রক্রিয়াকে টেকসই ও স্থায়ী করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

২.
অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে। দেশের সব গণমাধ্যম বরাবরের মতোই বেশ সরব ছিল। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রেক্ষাপট আমাদের সবার জানা। আমরা এ-ও জানি, বাংলা ভাষা পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম ভাষা। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের দেশের অনেক ভাষাবিদ ও পণ্ডিতেরা বাংলা ভাষা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে থাকেন! বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁরা যতটা সচেতন, ঠিক ততটাই যেন এ দেশের বাংলা ভিন্ন অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদাসীন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট বর্তমানে ইউনেসকোর ক্যাটাগরি-২-এর স্বীকৃত একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও এই প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বের মাতৃভাষার চর্চা ও গবেষণার আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার কথা ব্যক্ত করেছেন। ২০১০ সাল থেকে এই ইনস্টিটিউটের যাত্রা শুরু হলেও এই প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য কোনো কাজের নমুনা আমরা দেখতে পাই না। ২০১৪ সালে নৃভাষা-বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার কাজ (এর মাধ্যমে দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয়, তাদের ভাষার উৎপত্তি, বিকাশ ও বর্তমান পরিস্থিতি এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থা পর্যালোচনা করা) শুরু হলেও এটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমাউথ কলেজের লিঙ্গুইস্টিকস অ্যান্ড কগনিটিভ সায়েন্সের অধ্যাপক ডেভিড এ পিটারসন ১৯৯৯ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের খুমি, খিয়াং, বম ও ম্রোদের ভাষা নিয়ে কাজ করার সময়ে ম্রো ভাষার সঙ্গে মিশে যাওয়া ‘রেংমিটচা’ ভাষায় কথা বলা মানুষের সন্ধান পান। উল্লেখ্য, ১৯৬০ সালে লরেন্স লোফলার নামের এক জার্মান ভাষাবিদ প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামে ম্রোদের মধ্য থেকে রেংমিটচা গোষ্ঠীর সন্ধান পেয়েছিলেন। ডেভিড এ পিটারসন দীর্ঘ ১৬ বছর গবেষণার পরে এই রেংমিটচাভাষীদের সন্ধান পাওয়ার পরে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে বান্দরবান প্রেসক্লাবে রেংমিটচাভাষী চার নারী-পুরুষকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তা প্রকাশ করেন (সূত্র: প্রথম আলো)। কিন্তু সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এই ‘রেংমিটচা’ ভাষাটিকে নিজেদের গবেষণার ফসল বলে দাবি করলে এ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি প্রতিষ্ঠান। তাই আবিষ্কৃত ভাষা নিয়ে ‘আমিত্ব’ জাহির না করে বাংলাদেশে যেসব ভাষা বিপন্নপ্রায়, সেসব ভাষাকে কীভাবে সংরক্ষণ করে সেগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যায়, সেদিকে নজর দেওয়াটাই এখন সবচেয়ে জরুরি।
ইলিরা দেওয়ান: হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
ilira.dewan@gmail.com