শিক্ষাদানের লক্ষ্য হলো শিশুর কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট বা ডেভেলপমেন্ট অব দ্য ফ্যাকাল্টিজ অব মাইন্ডজ, তথা মনের সব প্রকোষ্ঠের সম্মিলিত উন্নতি, যার বিভিন্ন নাম হতে পারে, যেমন চিন্তাশক্তির বিকাশ বা চিন্তাশক্তির ক্ষমতা বৃদ্ধি, অন্তর্দৃষ্টি সৃষ্টি, মননের বিকাশ ইত্যাদি। সাইকোলজিতে কগনিটিভ থিওরির সাহায্যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে মনের সব প্রকোষ্ঠের সম্মিলিত উন্নতি কীভাবে সম্ভব। এ বিষয়ে যাঁরা মৌলিক গবেষণা করেছেন, তাঁদের মধ্যে সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও ইমানুয়েল কান্ট অন্যতম। অবদান আছে বার্ট্রান্ড রাসেলের ছাত্র উইটজেনস্টাইনেরও। শিক্ষাদানের কাজটা কীভাবে করলে এই কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট সর্বাধিক হবে, আমাদের তাই-ই করতে হবে। এ প্রসঙ্গে শিক্ষাদানের মাধ্যম কী হবে, তা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। মনে রাখতে হবে, ‘সম্পদ সীমিত কিন্তু চাহিদা অসীম’—মানবজীবনের এই ট্র্যাজেডি সব দেশের সব কালেরই বাস্তবতা। অতএব জাতীয় জীবনের সব কাজই ন্যূনতম সম্পদ ও ন্যূনতম সময় ব্যয় করে সর্বাধিক উপযোগিতা লাভের প্রচেষ্টা বহাল রাখতেই হবে।
কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট বিষয়ে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের অন্যতম উপাদান হলো ভাষা এবং ভাষা বলতে এখানে মা, শিশুর সঙ্গে যে মাধ্যমে ভাবের আদান-প্রদান করেন। মা যদি শিশুর সঙ্গে তাঁর নিজের ভাষা বাদ দিয়ে, অন্য ভাষায় ভাবের আদান-প্রদানের চেষ্টা করেন, তাহলে শিশুর কগনিটিভ ইম্পেয়ারমেন্ট তথা জ্ঞানগত বৈকল্য দেখা দিতে পারে অর্থাৎ এতে শিশুর মনের সব প্রকোষ্ঠের সম্মিলিত উন্নতি বাধাগ্রস্ত হবে। এই যে তত্ত্ব, এর মধ্যে দ্ব্যর্থক কোনো কিছু নেই এবং এই তত্ত্ব আজ পর্যন্ত কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি। অতএব এটা মানতে হবে।
মা শিশুর সঙ্গে যে ভাষায় ভাবের আদান-প্রদান করেন, শিশু সে ভাষায়ই চিন্তা করে; অতএব, বিদ্যালয়েও শিক্ষাদানের মাধ্যম সেই ভাষায় হতে হবে। এ বিষয়ে মনোবিজ্ঞানী ও ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। যদি কোনো কারণে মায়ের ভাষায় শিক্ষা দান করা না যায়, বিদ্যালয়ের যে উদ্দেশ্য, তা পুরোপুরি সফল হবে না কারণ বিদ্যালয়ের প্রথম উদ্দেশ্য হলো জ্ঞান দান করা, নতুন একটা ভাষা শেখানো নয়।
ইউনেসকো মনে করে, শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার ব্যবহার শিক্ষার গুণগত মানের জন্য অপরিহার্য। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদস্যদেশগুলোর জন্য যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে, তা মাল্টি-লিংগুয়ালিজম তথা বহু ভাষা শিক্ষার কথা ঘোষণা করে; কিন্তু শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সদস্যদেশের, এমনকি এক দেশের ভেতরেও আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষাদানের নীতি তারা অনুসরণ করে। ওই দুই ক্ষেত্রেই মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তাটা শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে।
সবচেয়ে সফল শিক্ষাব্যবস্থাগুলোর মধ্যে জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা অন্যতম। বস্তুত জাপানের যে অভাবনীয় উন্নয়ন, তার মূল ভিত্তি হলো তাদের শিক্ষাব্যবস্থা। জাপানের উন্নয়নের ভিত্তি গড়ে ওঠে মেইজি শাসনামলে (১৮৬৮-১৯১২)। মেইজি শাসকেরা পাশ্চাত্যের সঙ্গে জ্ঞান আদান–প্রদানের গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এক শর বেশি ইউরোপীয় পণ্ডিত তাঁরা নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। আবার দফায় দফায় বিপুলসংখ্যক ছাত্র, শিক্ষক, পণ্ডিত তাঁরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠান। এই আদান–প্রদানের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান তাঁরা জাপানি ভাষায় লিখে ফেলেন, অনুবাদ করে প্রচুর বই এবং শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন। বিজ্ঞানের পরিভাষা, মাতৃভাষায় অনুবাদ যায় না—এ জাতীয় চিন্তা জাপান ভুল প্রমাণ করে কারণ, ধার করা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পরিভাষা অনুবাদ করে ছাত্রদের শিক্ষিত করে মূল ভাষাভাষীদেরও ছাড়িয়ে গেছে জাপান। একটি ছোট দেশ হয়েও দীর্ঘদিন তারা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি ছিল ওই প্রযুক্তির শক্তিতেই।
ইউনেসকো মনে করে, শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার ব্যবহার শিক্ষার গুণগত মানের জন্য অপরিহার্য। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদস্যদেশগুলোর জন্য যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে, তা মাল্টি-লিংগুয়ালিজম তথা বহু ভাষা শিক্ষার কথা ঘোষণা করে; কিন্তু শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সদস্যদেশের, এমনকি এক দেশের ভেতরেও আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষাদানের নীতি তারা অনুসরণ করে। ওই দুই ক্ষেত্রেই মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তাটা শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। ব্রিটিশ ভারতে ও স্বাধীন ভারতে ১৮৮২ সালে হান্টার কমিশন ও পরবর্তী সময়ে (১৯৬৪-৬৬) কোঠারি কমিশন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অঞ্চল ভিত্তিতে যার যার মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের প্রস্তাব করে। গ্লাসগো ইউনিভার্সিটির অ্যালামনাই, শিক্ষাবিদ স্যার উইলিয়াম হান্টার, যিনি সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত, ভারতে মিশনারি স্কুল প্রতিষ্ঠায়ও নিরুৎসাহিত করেছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন, কুদরত-এ-খুদা কমিশন যে এক ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব করে, তা হান্টার কমিশন প্রদত্ত প্রস্তাবের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থার সাধারণ, মাদ্রাসা ও ইংরেজি বিলোপ করে খুদা কমিশন যে এক ধারার শিক্ষার প্রস্তাব করে, তার পেছনে জোরালো যুক্তি আছে। যুক্তিটা হলো, দেশের মধ্যে একই সমাজে এক ধরনের নাগরিক তৈরির প্রয়াস।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাল্টি-লিংগুয়ালিজম তত্ত্বের সঙ্গে আমরা একমত অর্থাৎ আমাদের ছাত্রদেরও একাধিক ভাষা শেখাতে হবে। কিন্তু শিক্ষার মাধ্যম হতে হবে বাংলা আর দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষা শেখা শুরু করা উচিত কত বছর বয়স থেকে, তা জানার জন্য আমাদের দ্বারস্থ হবে মনোবিজ্ঞানী ও ভাষাবিজ্ঞানীদের। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতি আমরা হুবহু অনুসরণ করতে পারব না কারণ তাদের সমাজ-বাস্তবতা ও নৃতাত্ত্বিক গড়ন আমাদের চেয়ে আলাদা।
মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করে অন্য ভাষায় সাহিত্য রচনা করে একেবারে শীর্ষে পৌঁছানো, নোবেল প্রাইজ পাওয়ার মতো অসংখ্য কবি-সাহিত্যিকের কথা আমরা জানি। আমাদের ভাষার প্রধান দুই কবি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের ইংরেজি সাহিত্যে দখল ছিল আকাশছোঁয়া। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পান তাঁর গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের জন্য আর নজরুলের প্রবন্ধ ‘বর্তমান বিশ্ব-সাহিত্য’ পড়লে বোঝা যায় তিনি কীভাবে আত্মস্থ করেছিলেন বিদেশি সব ভাষা। অতএব, অন্য ভাষায় দখল অর্জনের জন্য শিক্ষাদানের মাধ্যম ইংরেজি করার কোনো দরকার নেই।
রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা চালু করা নিছক শিক্ষানীতির বিষয়ই নয়, এটা নাগরিকদের অধিকারও বটে। ভালো বাংলা ও ইংরেজি শেখার পাশাপাশি পাহাড়ি জনগণেরও তাঁদের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থাও করতে হবে। ইংরেজিকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্রের সমস্ত দলিল ও গেজেট, নন-গেজেট রাষ্ট্রীয় সব অধ্যাদেশ বা ঘোষণা বাংলার নিচে ইংরেজি ভার্সন যুক্ত করলে মানুষের জন্য ইংরেজি শিক্ষার একটি নতুন দ্বারও উন্মোচিত হবে। ইংরেজি জানা অনেক লোকের চাকরি হবে, যা আমাদের ইংরেজি শিখতে প্রণোদনা দান করবে।
এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা জরুরি। বাংলায় লেখা বই ইংরেজিতে ও অন্য ভাষার বই বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে, তাদের ওয়েবসাইটে পিডিএফ কপিও সংযোজন করে দেশের মানুষকে বিনা পয়সায় পড়ার সুযোগ করে দিতে হবে। এ জন্য অনতিবিলম্বে বাংলা একাডেমির জনবল ও সামর্থ্য বাড়াতে হবে, যাতে প্রতিষ্ঠানটি এই মহাকর্মযজ্ঞ শুরু করতে পারে। জাপানের মেইজি শাসকদের উন্নয়নের ইতিহাস পড়েই রবীন্দ্রনাথ নিচের কবিতাটি লিখেছিলেন কি না, আমি জানি না:
পশ্চিমে আজি খুলিয়াছে দ্বার
সেথা হতে সবে আনে উপহার
দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে
যাবে না ফিরে
এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে
ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। nntarun@gmail.com