‘বাপ-দাদারা যে মাছগুলো মাইরছে, সেগুলা তো আমরা চোখেই দেখলাম না। এই যে ’১৫ সাল থাকি ইঁছলা (চিংড়ি) নাই, এবার পানি থাকায় পাওয়া যাচ্ছে।’ এই কথাগুলো বলছিলেন চিলমারীর জেলে আনোয়ার হোসেন (৪০)। আরেক জেলে আবু বক্কর সিদ্দিক (৫৫) বলেন, ‘এখন ইলিশের ডিম ছাড়ার মৌসুম, মাছ ধরা বন্ধ। লাভ কার? যারা ইলিশ সারা বছর ধরে তাদের। কিন্তু হামরা রুই-কাতলা, বাগাড়, চিতল, কালবাউশসহ যে মাছগুলো মারি, সেগুলা তো ডিম পাড়ে ফাল্গুন–চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসে। সেগুলা আবার ডিম ফোটায় নদীর তলার কোলায় গিয়ে। এই মাছগুলা রক্ষার কথা তো আপনারা কন না।’
মানে ফাল্গুন–চৈত্রে যখন নদ–নদী শুকাতে থাকে, তখন চরের মাঝখানে একধরনের নিচু জলাভূমি তৈরি হয়। এর তিন দিকে চর, আরেক দিকে নদীর স্রোতের সঙ্গে যুক্ত। একে বলা হয় কোলা। একেকটা কোলা একেকটা হালদা নদীর মতো মিঠাপানির মাছের আধার। ফাল্গুন–চৈত্র মাসে যখন নদীর পানি কমতে শুরু করে, তখন পৈরালী (বৈরালী), কালবাউশসহ কয়েক জাতের মাছ কোলাগুলোতে ঢুকে ডিম পাড়ে। একপর্যায়ে প্রভাবশালীরা কোলার ইজারা নিয়ে মুখ বন্ধ করেন। তারপর কেউ বিষ দিয়ে মাছ মারেন। কেউ কাঁথা জাল দিয়ে কোলা সেঁচে ফেলেন। এতে মাছ ও সব কীটপতঙ্গ ঝাড়ে–বংশে নিপাত হয়। আর বৈশাখ–জ্যৈষ্ঠ মাসে যখন নদ–নদীতে পানি বাড়তে বাড়তে কোলায় ঢুকতে থাকে, তখন চিতল, বোয়াল, বাগাড়ের মতো বড় মাছগুলো ডিম ছাড়তে আসে কোলায়, খালে ও বিলে। কিন্তু কোলা ও খালের মুখে শিকারিরা কয়েক দিনব্যাপী ওত পেতে থাকে। বিশেষ প্রক্রিয়ায় বিশাল বিশাল মাছগুলো শিকার হতে থাকে। এই পুরো প্রক্রিয়ায় কোথাও জেলেরা যুক্ত থাকেন না। এটি ঘটে প্রভাবশালীদের নেতৃত্বে।
রাজা মিয়া (৩৮) নামের একজন জেলে বলেন, চিলমারীর সব কটি জেলেপাড়া মিলে যত জেলে, একটা চরে তার সমান ভুয়া জেলে। তাঁরাই কার্ডধারী, তাঁরাই সুবিধাভোগী।
২০১৭ সালে মোট মাছ সংগ্রহ হয়েছে ২৪ লাখ টনের কিছু বেশি। তার মধ্যে ১০ লাখ ৪৮ হাজার টন প্রাকৃতিক উৎস থেকে। এরই মধ্যে ৫ লাখ টন ছিল ইলিশ। এফএও এবং বাংলাদেশের মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদ–নদীসহ উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মাছের আহরণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি।
১৯৮৫-৮৬ সালে বাংলাদেশে ব্যবহৃত বিষের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৬৩ মেট্রিক টন, তা ২০০৮ সালে এসে দাঁড়ায় ৪৮ হাজার ৬৯০ মেট্রিক টন। বর্তমানে তা আরও বেড়েছে। ফলাফল ১২ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন। আরও ২৫ ধরনের প্রাণী ও উদ্ভিদ বিপন্ন হওয়ার মুখে। এখন শুধু রাসায়নিক সারের পেছনেই বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় এক বিলিয়ন ডলার।
পুকুর শুকিয়ে আগাছানাশক হার্বিসাইড ব্যবহার করা হয়। এটি মার্কিন মনসান্টোর রাউন্ডআপ। এটা তৈরির প্রধান উপাদান ‘গাইফোসেট’। এটি ক্যানসারের জন্য দায়ী হওয়ায় মার্কিন আদালত মনসান্টোকে ২৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার জরিমানা করে ২০০৮ সালে। এটি অনেক দেশে নিষিদ্ধ হলো, কিন্তু বাংলাদেশে নয়। ১৯৯১-৯২ সালে এটি আমদানির পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ১১৩ মেট্রিক টন, ২০১৭-১৮ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩৭ হাজার ১৮৭ মেট্রিক টন। তাহলে এই দেশে ক্যানসার কেন বাড়বে না।
আমরা দেখি না একটি কীট একটি বনকে খেয়ে উজাড় করে দিয়েছে বা কোনো একটি প্রাণসংহারী রোগের আবির্ভাবে হাজার একর বনভূমি নষ্ট হয়েছে। তেমনি নদ–নদীতেও এমনটা ঘটে না। কারণ, বনের মতো নদীও প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে অনন্য প্রাণবৈচিত্র্য গড়ে তোলে। একেকটি কোলায় প্রায় ১০০ প্রজাতির মাছ থাকে, কিন্তু এক একর আয়তনের পুকুরে এক বা দুই প্রজাতির মাছ থাকে। মাছের এই একক চাষ প্রকৃতিতে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে। জেলেরা এটা জানেন। তাঁদের জীবনদর্শনও এই যে তাঁরা প্রকৃতিকে খণ্ড খণ্ড করে দেখেন না। তাঁরা জানেন, মাছ যখন আহরণ থেকে চাষে পরিণত হয়, তখন জীবনও বদলে যায়।
নাহিদ হাসান: কুড়িগ্রামের রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সাবেক সভাপতি
nahidknowledge@gmail.com