পাকিস্তান

মহামারির মধ্যেও সামরিক ব্যয় বাড়ে কেন

কোভিড-১৯
কোভিড-১৯

কোভিড-১৯ হানা দেওয়ার পর দেশের অর্থনীতির জেরবার অবস্থা চললেও পাকিস্তানের সরকার তাদের অগ্রাধিকারমূলক ব্যয় থেকে সরে আসেনি। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে দেশটিতে সর্বোচ্চ গতিতে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হচ্ছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে। এ পর্যন্ত পাকিস্তানে চার হাজারের বেশি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে এবং দেশটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) নেই। কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস দেওয়ার যন্ত্র নেই। এ কারণে মৃত্যুহার কমছে না।

এরপরও ইসলামাবাদ ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ ধরেছে ৮৭৫ কোটি ডলার। অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে মাত্র ১৫ কোটি ১০ লাখ ডলার। গত বছর প্রতিরক্ষায় যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, এ বছর তা থেকে ১২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এর বাইরে আরেকটি বিষয় হলো, পাকিস্তানে বাজেটে যে ব্যয় দেখানো হয়, তার বাইরে অদৃশ্যভাবে ব্যয় হয়। সেই ব্যয়ের পরিমাণও অনেক। তবে তার খবর কখনোই প্রকাশ্যে আসে না।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কড়া প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে পাকিস্তান বরাবরই সামরিক ব্যয়ের স্বচ্ছতা দূর করতে অস্বীকার করে এসেছে। সামরিক বাহিনীর রাষ্ট্রীয় সম্পদ অধিগ্রহণ, সেনাবাহিনীর পাবলিক সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (পিএসডিপি), পরমাণু কর্মসূচি ও আধা সামরিক বাহিনীর পেছনে ব্যয়, অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যদের পেনশন দেওয়া, নতুন চালু করা ন্যাশনাল সিকিউরিটি ডিভিশন এবং অন্য অনেক সেনা খাতের ব্যয় এই বাজেটের মধ্যে পড়ে না। এসব ব্যয় ধরা হলে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাজেটের বরাদ্দের পরিমাণ ১ হাজার ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

পাকিস্তান এমন এক সময় তার প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়াচ্ছে, যখন দেশটির মোট ব্যয়ের ৪১ শতাংশই ঋণ পরিশোধে ব্যয় হচ্ছে। কোভিড-১৯ আঘাত হানার আগে থেকেই পাকিস্তানের অর্থনীতির অবস্থা নাজুক। বিশেষ করে আইএমএফের ছয় শ কোটি ডলারের প্যাকেজ ঋণ শোধ করতে গিয়ে দেশটিকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মোট দেশজ উৎপাদন ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা ২ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। করোনা মহামারির কারণে জিডিপি ১ দশমিক ৫ শতাংশ কমে গেছে। এ মহামারি আসার আগেই পাকিস্তান বহির্বিশ্বের কাছে ১১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের দেনাদার হয়ে আছে। কোভিড-১৯–এর কারণে এখন দেশটিতে আরও আড়াই কোটি অনাহারী মানুষ যুক্ত হয়েছে। এদের মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবার দেওয়া সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।

গত ২০ মে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে ভাষণ দেওয়ার সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জি-২০–ভুক্ত দেশগুলোর প্রতি পাকিস্তান ও অন্য উন্নয়নশীল দেশের স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা করার আবেদন জানান। এপ্রিলের শুরুতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোমিনিক রোবকে এ অনুরোধ করেছিলেন, যুক্তরাজ্য সরকার যেন করোনাভাইরাসের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পাকিস্তানের ঋণ মওকুফ করতে জি-২০ দেশগুলোকে অনুরোধ করে।

এ পর্যন্ত ইসলামাবাদ করোনাভাইরাসের ত্রাণ বাবদ ৪২ কোটি ৪০ লাখ ডলার খরচ করেছে। মহামারি মোকাবিলা করতে হলে তাকে আরও বহু অর্থ খরচ করতে হবে। সে অর্থের সংস্থান হবে কি না, তার জবাব ইসলামাবাদের কাছে না থাকলেও সামরিক ব্যয় বাড়ানোর অর্থ তার কাছে রয়েছে। নিজেদের স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের পিপিই না থাকলেও মার্কিন সেনাদের পাকিস্তান পুরো একটি প্লেন বোঝাই পিপিই উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে।

সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়া ইমরান খানের সরকার যখন ত্রাণ তহবিল জোগাড়ের জন্য দিশেহারা, তখন প্রাদেশিক সরকারগুলোও তাদের মৌলিক অভাব পূরণের জন্য কেন্দ্রের কাছ অর্থ চেয়ে বারবার চিঠি পাঠাচ্ছে। ১৯৭৩ সালের একটি সাংবিধানিক সংশোধনীতে প্রদেশগুলোকে অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছিল। এটি ছিল অষ্টাদশ সংশোধনী। এখন কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছা, ওই সংশোধনী বাতিল করা হোক, যাতে প্রদেশের আয়ে কেন্দ্র ভাগ বসাতে পারে।

পাকিস্তানের সামরিক প্রতিষ্ঠান মনে করছে, বর্তমানে পাকিস্তান নানা দিক থেকে হুমকির মধ্যে রয়েছে এবং এ অবস্থায় প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয়ে লাগাম টানলে সেই হুমকি আরও বেড়ে যাবে। পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিদ্যমান থাকায় এবং জাতীয় রাজনীতির ওপর সামরিক প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ জেঁকে বসায় কেন্দ্রীয় সরকার কখনোই সেনাবাহিনীর ইচ্ছেমতো খরচের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেনি। বেসামরিক সরকারের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা না করেই সেনা কর্মকর্তারা খরচের সিদ্ধান্ত নেন।

চীনের কাছ থেকে ট্যাংক না কিনে পাকিস্তানের নিজের তৈরি ট্যাংক ‘আল-খালেদ’ ব্যবহার করা উচিত—এই কথা বেসামরিক রাজনীতিকেরা সেনাবাহিনীকে বলার সাহস পান না। প্রতিবছর সেনাবাহিনীকে ২০০ কোটি ডলারের বেশি পেনশন দেওয়া হলেও (এ অর্থ প্রতিরক্ষা বাজেটের অন্তর্ভুক্ত নয়) সরকার সামরিক বাহিনীকে এ প্রশ্ন করতে সাহস রাখে না যে বেসরকারি ব্যবসা খাত থেকে প্রতিবছর সেনাবাহিনী যে দুই হাজার কোটি ডলার আয় করে থাকে, তা দিয়ে কী করা হয়? কাশ্মীর নিয়ে ভারতের সঙ্গে দ্বৈরথ থাকলেও দেশটির সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ লাগার আশঙ্কা প্রায় নেই। এ ছাড়া বর্তমানে ভারতকে চীনের সঙ্গে মোকাবিলা করে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর যৌক্তিক কারণ দেখা যাচ্ছে না।

সেনাবাহিনীর হাতে একটিই অজুহাত আছে, সেটি হলো ‘জাতীয় নিরাপত্তা’। এর দোহাই দিয়ে তারা দিনের পর দিন পাকিস্তানের রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি সামাজিক জীবনও কুক্ষিগত করে ফেলছে। জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের সেনাপ্রধান দেশটির অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তদাতা পর্ষদের প্রধান কর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য বিস্তার করে আছেন সামরিক কর্মকর্তারা। সরকারের বেসামরিক নেতারা এ নিয়ে কোনো কথা বলতে পারছেন না। এ অবস্থা চলতে থাকলে পাকিস্তানে বেসামরিক রাজনীতির ছিটেফোঁটাও একসময় থাকবে না।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

আয়েশা সিদ্দিকা লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সোয়াস-এর একজন গবেষক। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর অর্থনৈতিক কার্যক্রম নিয়ে লেখা মিলিটারি আইএনসি: ইনসাইড পাকিস্তানস মিলিটারি ইকোনমি বইয়ের লেখক