মসিউর রহমান

শহীদ বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, চৌগাছা, যশোর, খুলনা

মসিউর রহমান

বৃহত্তর যশোরে আইনজীবী, আদর্শবান রাজনীতিক ও দেশপ্রেমিক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন মসিউর রহমান।

ধার্মিকও ছিলেন। নিয়মিত নামাজ পড়তেন ও রোজা রাখতেন। দানশীলও ছিলেন। বেশির ভাগ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ভালো একজন মানুষ।


ছাত্রজীবনেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরও অনেক খ্যাতিমান রাজনীতিকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়।


১৯৪৯ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে তিনি যশোর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

১৯৫২ সালে যশোরে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে এত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হন যে তাঁর ১৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বীর সবারই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।

নির্বাচনের পর গঠিত প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় তিনি প্রথমে স্থানীয় সরকার এবং পরে আইন ও বিচার বিভাগের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।


মসিউর রহমান আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর আজীবন সহকর্মী ছিলেন।

ছয় দফা আন্দোলনকালে বৃহত্তর যশোরে তিনি তাঁর সব শক্তি দিয়ে প্রচারকাজ চালান। এই সময় তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষকে ছয় দফার পক্ষে উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল ছয় দফা বাঙালির ম্যাগনাকার্টা।

পরবর্তী সময়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর প্রধান কৌঁসুলি আবদুস সালামের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন।


১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের এমপিএ (মেম্বার প্রভিনশিয়াল অ্যাসেম্বলি) নির্বাচিত হন।

একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন। এ সময় যশোরে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য।

এ কারণে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টার্গেটে পরিণত হন। ২৫ মার্চ রাত তিনটায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল মসিউর রহমানকে তাঁর শহরের ঈদগাহের পাশের বাসা থেকে আটক করে যশোর সেনানিবাসে নিয়ে যায়।

সেখানে সেনারা দীর্ঘ প্রায় এক মাস তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানোর পর হত্যা করে। হত্যার সঠিক তারিখ কারও জানা নেই।

তবে পরিবারের সদস্যদের ধারণা, পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে ২৩ এপ্রিল হত্যা করে এবং তাঁর মরদেহ অজ্ঞাত গণকবরে মাটিচাপা দেয়।

স্বাধীনতার পর থেকে এই দিনটিই তাঁর শহীদ হওয়ার দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা যশোরের ন্যাপ নেতা আইনজীবী মঈনউদ্দীন মিয়াজীকেও আটক করেছিল।

সেনারা তাঁকেও করে ব্যাপক নির্যাতন। কিন্তু হত্যা করেনি। বন্দী থাকা অবস্থায় তিনি মসিউর রহমান নিখোঁজ হওয়ার কয়েক দিন আগে তাঁকে দেখেছিলেন।

এটাই ছিল শেষ দেখা। মসিউর রহমানের গোটা শরীর তখন ছিল ক্ষতবিক্ষত। এক ইঞ্চি স্থানও অক্ষত ছিল না।

বেয়নেটের খোঁচায় অসংখ্য রক্তাক্ত ক্ষতের যন্ত্রণা ভোগ করেছেন দুঃসহ বন্দিজীবনে। সেনাদের নির্মম নির্যাতন তাঁকে ভোগ করতে হয়েছে। তবু ভেঙে পড়েননি।


দেখা হওয়ার পর মসিউর রহমান সতীর্থ মঈনউদ্দীন মিয়াজীকে বলেছিলেন, ‘মিয়াজী, ছাড়া পাব কি পাব না, জানি না। তবু শেষ পর্যন্ত আমরাই জিতব।

ধৈর্য ধরো, সহ্য করো।’
মসিউর রহমানের জন্ম ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার সিংহঝুলি গ্রামে।

বাবা ইসমাইল হোসেন, মা সৈয়দুন নেছা। তাঁরা ছিলেন তিন ভাই, পাঁচ বোন। ভাইদের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।

যশোর জিলা স্কুল থেকে ১৯৩৬ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে।

১৯৩৮ সালে আইএ ও ১৯৪০ সালে বিএ পাস করে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। একই কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে তিনি ল পাস করেন।

আইন পড়াকালে তিনি একটি মার্চেন্ট অফিসের ইংরেজ একজন কর্মকর্তার সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করায় ইংরেজিতে তিনি যথেষ্ট দক্ষতা ও নিপুণতা অর্জনে সক্ষম হন।


মসিউর রহমান দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক। ছেলে মাহমুদুর রহমান ও মাসুকুর রহমান। মেয়ে নাসরিন রহমান ও নীলুফার রহমান।

সবাই যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। স্ত্রী মাহমুদা রহমান। যশোরের আইন কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাস, চৌগাছা কলেজের একাডেমিক ভবন, যশোর পৌরসভা ও যশোর সেনানিবাসের একটি সড়কসহ আরও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাঁর নামে নামাঙ্কিত।

সূত্র: আলী কদর মো. শামসুজ্জামান (মসিউর রহমানের ভ্রাতুষ্পুত্র) ও স্মৃতি: ১৯৭১, চতুর্থ খণ্ড, প্রকাশ ১৯৯১, সম্পাদনা রশীদ হায়দার। প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯২) থেকে।


গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।
rashedtr@prothom-alo.info