ডেঙ্গু মৌসুমের দুই মাস হাতে থাকতেই ডেঙ্গু রোগীর সর্বোচ্চ রেকর্ড হাসিল হয়ে গেছে। ১৮ বছরের মধ্যে প্রথম সর্বোচ্চ রেকর্ড ভাঙে গত ২৭ জুলাই। সেদিন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা পৌঁছায় ১০ হাজার ৫২৮–এ। আর ৮ আগস্টে সেটা দাঁড়ায় ৩৪ হাজার ৬৬৬ জনে। ঢাকার বাইরেও হু হু করে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ৮ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি।
সাদা চোখেই বোঝা যাচ্ছে, গত বছরের চেয়ে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুর বিস্তার তিণ গুণেরও বেশি। বিপদ আরও বাড়তে পারে। প্রচার করা হচ্ছে, আমরা প্রস্তুত। হাসপাতালে শয্যা বাড়ানো হয়েছে, কোনো কিছুর ঘাটতি নেই। তারপরও শিশু সুমাইয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে বাবার কোলে চড়ে ফেরত গেছে চিকিৎসা ছাড়া (৯ আগস্ট, প্রথম আলো পৃ. ৪)। নড়াইলের লোহাগড়া থেকে নয় বছরের অর্ঘ্য দত্তকে নিয়ে তার পরিবার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে নড়াইল জেলা সদর হাসপাতাল হয়ে যশোর মেডিকেল পার করে ঢাকায় এসে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠাঁই মেলেনি কোথাও। অর্ঘ্যর সঙ্গে প্রথম আলোর প্রতিনিধির দেখা হয় হলি ফ্যামিলির জরুরি বিভাগে। বলা বাহুল্য, সেখানেও তার ঠাঁই হয়নি। হাসপাতালের নার্স, চিকিৎসক, শিক্ষানবিশ (ইন্টার্ন), এমনকি সিনিয়র ছাত্ররাও অমানুষিক পরিশ্রম করছেন, কিন্তু সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু আমরা বলছি না পরিস্থিতি বেসামাল।
প্রকৃত সমস্যার পাঠোদ্ধার করা না গেলে, সমস্যার স্বরূপটা বুঝতে না পারলে আর বোঝার পর সেটা স্বীকার না করলে সমস্যার জট পাকতেই থাকে।
যেসব প্রাণী লেজ দিয়ে মাছি তাড়ায়, তাদের লেজে যদি কোনো কারণে নিজের মল বা ঝোল–কাদা লেগে যায়, তাহলে আর লেজ দিয়ে সে মশা–মাছি কিছুই তাড়তে পারে না। যতবার চেষ্টা করবে, ততবার তার শরীরে কাদা, মল বা গোবরের আস্তরণ পড়তে থাকে। মাছির তাতে পোয়াবারো। মল–গোবরের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছি প্রাণীটিকে ছেঁকে ধরে। হাতি, ঘোড়া, মহিষ, গরু, ভেড়া, গাধা, দুম্বা—যেকোনো প্রাণী এই অবস্থায় পড়লে তার তখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। স্বগোত্রীয় কোনো প্রাণী তখন তাকে এই লেজেগোবরে অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে পারে না। হাতি তার শুঁড় ব্যবহার করে শরীরে পানি ছিটায় কিংবা মহিষের মতো নেমে পড়ে জলাশয়ে। পানি পছন্দ না করা গরু আর গাধাদের মশা-মাছি তাড়ানোর চেষ্টায় লেজের গোবর ক্রমে শরীরে মাখতে থাকে। শেষ পর্যন্ত এসব প্রাণীর মালিকদেরই এগিয়ে আসতে হয় লেজটা পানি দিয়ে ধুয়েমুছে দেওয়ার জন্য।
আমাদের লেজের গোবর ধুইয়ে দিতে এসেছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের প্রধান কীটতত্ত্ববিদ ডা. ভূপেন্দর নাগপাল। তিনি খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘বড় বড় যন্ত্র দিয়ে দিগন্ত আচ্ছন্ন করে ধোঁয়ায় ধোঁয়াময় করার বুজরুকি দিয়ে এডিসকে ঘাড়ধাক্কা দেওয়া যাবে না। এডিস অনেক স্মার্ট মশা। ড্রেনের মধ্যে ওষুধ ছিটালে এডিস মরবে না। ওখানে সে থাকে না। তারপরও আমরা ফগিং ফগিং করে তড়পাচ্ছি। এই সাধুর ওষুধ ভালো না, ওই সাধুর ওষুধ কার্যকর, সেটা নিয়ে তর্ক করছি। সাংবাদিক ডেকে মশা ঘুমায় না জ্ঞান হারায়, তার মজমার আয়োজন করছি। মনে রাখতে হবে, ফগিং মেশিনে ছিটানো ওষুধে শুধু উড়ন্ত মশা মরে, লার্ভা ধ্বংস হয় না।
উড়ন্ত মশা মারতে হলে ফজরের ওয়াক্ত থেকে কাজ শুরু করতে হবে। কারণ, মশা ওড়ে সূর্যোদয়ের পরপরই আর ঠিক গোধূলি লগ্নে সূর্যাস্তের আগে আগে। অন্য সময় ওষুধ ছিটালে কাজ হবে না।
ভূপেন্দর নাগপাল বলেছেন, বাংলাদেশে সিটি করপোরেশন মশা মারতে ‘কেমোফাস’ নামে যে তরল ওষুধ ছিটায়, তার ধক এক সপ্তাহও থাকে না। কিন্তু ‘কেমোফাস’ ওষুধের দানা আছে, ওই দানা ছিটালে ২১ দিন পর্যন্ত কাজ করে। ফলে, মশার ডিম থেকে লার্ভা হতে পারে না। তাঁর মতে, বর্তমান পরিস্থিতিকে জরুরি ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে বাড়ির ভেতর দরজা-জানালা বন্ধ করে মশা মারার ওষুধ স্প্রে করতে হবে। খাট, চেয়ার-টেবিল ও বিছানার নিচে ওষুধ ছিটাতে হবে। যেখানে বেশি মানুষ থাকে (যেমন স্কুল), সেখানে এডিস মশা বেশি থাকে। সেখানে বেশি কামড়ায়।
বলা বাহুল্য, দুই সিটি করপোরেশন এযাবৎ এডিস মশার প্রজননপ্রবণ এলাকা হিসেবে যেসব স্থান চিহ্নিত করে এসেছে, ৪০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই আন্তর্জাতিক কীটতত্ত্ববিদের তথ্যের সঙ্গে তা মেলেনি। তিনি এডিস মশার বৈশিষ্ট্য নিয়েও বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন। এত দিন ধারণা করা হতো, এডিস মশা বাসাবাড়ি ও আশপাশে জমে থাকা পানিতে বেশি থাকে। কিন্তু ভূপেন্দর নাগপাল জানান, এডিস মশা সবচেয়ে বেশি থাকে সরকারি পরিবহন পুলে। থানায় থানায় জব্দ করা গাড়ির স্তূপে। এসব জায়গায় সারিবদ্ধ গাড়ি, টায়ার ও পরিত্যক্ত টিউব যন্ত্রপাতিতে এডিসের বেশি লার্ভা পাওয়া গেছে। এর পরপরই এডিস থাকে হাসপাতালের নিচে খোলা জায়গায়, ছাদে, পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্রে।
এ ছাড়া বিমানবন্দরের চৌবাচ্চা ও রানওয়ের আশপাশে, পার্ক, নার্সারি, ফোয়ারা, সরকারি–বেসরকারি নির্মাণাধীন ভবনে। সরকারি অফিসগুলো ছাদে এডিসের বিস্তার বেশি। এ ছাড়া বাসাবাড়ির গ্যারেজে, বাড়ির মূল ফটকের লোহার গেটের ফাঁকে, পরিত্যক্ত কমোডে, বিদ্যুতের তার আটকানোর সরঞ্জামাদিতে মশা ডিম পাড়ে। ভূপেন্দর নাগপাল তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে জানিয়েছেন, মশা মারার সঙ্গে সঙ্গে লার্ভা ধ্বংসে মন দিতে হবে। এডিস মশার ডিম পানি ছাড়াও প্রতিকূল পরিবেশে প্রায় এক বছর টিকে থাকতে পারে। লার্ভা ধ্বংসে টেমিফস ১ গ্রাম/১০ লিটার পানিতে খুব কার্যকর, যা ব্যবহার পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। নির্মাণাধীন ভবনের প্রজননস্থল ধ্বংস করে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ডেঙ্গু বিস্তার কমানো সম্ভব।
কিন্তু মশা ঠিকই চিনেছে যে আমাদের লেজে পর্যাপ্ত গোবর এবং নিজে নিজে তা পরিষ্কার করতে পারছি না।
গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
nayeem5508@gmail.com