রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে পশ্চিমবঙ্গে। চার-পাঁচ মাস পরই নির্বাচন। মে মাসে হতে পারে বলে অনুমান সবার। কিন্তু প্রচারমাধ্যমের মূল মনোযোগ এখনই ওদিকে ঘুরে গেছে। আয়তনের হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ ভারতে ১৪তম রাজ্য। জনসংখ্যার হিসাবে চতুর্থ। কিন্তু ভোটের গুরুত্বে রাজ্যটির মর্যাদা জাতীয়ভাবে আরেকটু ওপরে। কেন্দ্রের শাসক বিজেপি এবং সব বিরোধীরা পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনকে দেখছে বড় শক্তি পরীক্ষা হিসেবে। গ্রাম-শহরের সাধারণদের কাছে অবশ্য প্রশ্ন একটাই—মমতা কি পারবেন বিজেপিকে ঠেকিয়ে রাখতে?
২৮ রাজ্য এবং ৮ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল মিলে ভারত। ১৭টিতেই বিজেপি ক্ষমতায় এখন। কোথাও একা—কোথাও জোট গড়ে। সর্বশেষ জিতেছে বিহারে। লোকসভা ও রাজ্যসভাও তাদের নিয়ন্ত্রণে। বলা যায়, দেশের রাজনীতিতে তাদের অবস্থান একচ্ছত্র। অনেকে একে ভারতে একদলীয় শাসনের সঙ্গেও তুলনা করছে। তারপরও বিজেপি পরিবার অসুখী। কারণ, পশ্চিমবঙ্গ তাদের কবজায় এল না আজও। অনেকের ধারণা, গেরুয়া শিবিরের সেই অপূর্ণতা এবার পূরণ হতে পারে।
উপমহাদেশে বিভিন্ন জাতিসত্তার মাঝে বাঙালির ইতিহাসে রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদের প্রাচুর্য বিপুল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মাঠে বিজেপি আপাতত প্রাচীর হিসেবে দেখছে কেবল সাধারণ এক বাঙালি নারী—মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। চেষ্টা চলছে তাঁকে যেকোনো উপায়ে কাবু করার। নির্বাচন তাই দাঁড়িয়েছে ‘বিজেপি বনাম মমতা’ সমীকরণে।
রাজ্যের বিধানসভায় আসন ২৯৪টি। ১৪৮টি আসন হাতে থাকলে সরকার গড়া যায়। ২০১৬ সালে ২১১টি পেয়েছিল মমতার তৃণমূল। ২০১১ সালে পেয়েছিল ১৮৪টি। এসব ইতিহাসে কেউই এখন আর ভরসা রাখছে না। গত নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ৩টি আসন। আগের নির্বাচনে কোনো আসনই পায়নি। তারপরও দলটি এবার রাজ্যে ২০০ আসন জয়ের স্বপ্ন দেখছে। একে দিবাস্বপ্নও বলা যাচ্ছে না। গত কয়েক বছরে ভারতের ভোটের রাজনীতি আমূল পাল্টে গেছে। সেই ঢেউ আছড়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গেও। ২০১৬ সালের নির্বাচনের পর রাজ্যের উপনির্বাচনগুলোতে বিজেপি ক্রমাগত ভালো করেছে। সেই সূত্রে মূল নির্বাচনে পাওয়া ৩টি আসনকে তারা কয়েক গুণ বাড়িয়ে নিয়েছে। একইভাবে যে বিজেপি ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ২টি আসন পায়—গত বছর সেটা নয় গুণ বাড়িয়েছে।
নয় বছর হলো পশ্চিমবঙ্গে মমতার রাজত্ব চলছে। ২২ বছর বয়সী একটা দলের ৯ বছর ক্ষমতায় থাকা সফলতা হিসেবে বেশ। মের নির্বাচনে জিতে তৃণমূল তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে যেতে চায়। কিন্তু ভোটের দিনক্ষণ যত এগোচ্ছে—দল ছাড়ছে অনেকে। দলত্যাগীদের মাঝে সর্বশেষ নাম এসেছে শুভেন্দু অধিকারী ও রাজীব ব্যানার্জির। এঁরা প্রভাবশালী নেতা।
এ রাজ্যে দল ভাঙাগড়ার খেলা নতুন নয়। মুকুল রায়-অনুপম হাজরাসহ বিজেপির রাজ্য শাখার নেতা-কর্মীদের বড় অংশ অতীতে কংগ্রেস-তৃণমূল ও বামদের সঙ্গে থাকা মানুষ। খোদ তৃণমূল দলটিও কংগ্রেস ভেঙেই তৈরি। মেঠো শক্তি গড়েছে তারা বাম কর্মীদের টেনে এনে। ২০১৬-এর পর রাজ্য কংগ্রেসের ৪৪ এমএএলের ১৭ জনকেই তৃণমূল নিয়ে এসেছে। একদা মমতা যে সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিলেন, এখন সেটাই তাঁকে ছোবল দিচ্ছে। বিজেপিরও এতে ইন্ধন আছে। তৃণমূল থেকে বের হওয়াদের কাছে পেতে তারা আগ্রহী। সেটা না হলেও ক্ষতি নেই। তৃণমূল দুর্বল হওয়া বলে কথা। দুর্বল হচ্ছেও।
২০১৯-এর লোকসভায় তৃণমূল আসন পেয়েছে ২২টি। অথচ ২০১৪ সালে ছিল ৩৪টি। দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা আড়াল করতে মমতা বলছেন, তৃণমূলের সব আসনে যাকেই মনোনয়ন দেওয়া হোক, তাঁকেই যেন সবাই প্রার্থী মনে করে! বোঝা যাচ্ছে, জয়-পরাজয়ের পুরো বাজি ধরছেন তিনি নিজের ওপর।
তৃণমূল, বাম এবং কংগ্রেসের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের বিজেপিকে মনে হয় দলছুটদের সংগঠন। তাতে অবশ্য ভোটের হিস্যায় সমস্যা হয় না। তাদের মূলশক্তি ‘হিন্দুত্ববাদ’-এর আদর্শ আর মোদি-অমিত শাহর ইমেজ।
ভারতজুড়ে ধর্মবাদী রাজনীতির তরঙ্গ বইছে এ মুহূর্তে। সেই তরঙ্গে কংগ্রেস অনেকখানি কোণঠাসা। স্থানীয় পর্যায়ে সামান্য সংগঠন নিয়েও একের পর এক রাজ্য জয় করছে বিজেপি বাহিনী। বিহারের নির্বাচনের পর পশ্চিমবঙ্গে তুমুল উজ্জীবিত তারা। গত লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের ৪২ আসনের ১৮টি দখল করে জেলায় জেলায় প্রবল উপস্থিতি গড়ে ফেলেছে দলটি। এখন কেবল ‘শেষ ধাক্কা’ দিতে চায়।
লোকসভা নির্বাচনকালে বিজেপির ভোট ছিল ৪০-৪১ শতাংশ। তৃণমূলের ৪৩-৪৪ ভাগ। এই হিসাব সামান্য কমবেশি হওয়া মানেই আসনের অঙ্কে বড় ওলটপালট। সেটা ঘটাতে রাজ্যজুড়ে হিন্দুত্বের হাওয়া ওঠাতে বহু কৌশলে এগোচ্ছে বিজেপি। বাবরি মসজিদের জায়গায় নির্মাণাধীন মন্দিরের জন্য অর্থের জন্য বাঙালির ঘরে ঘরে ধরনা দেবে বিজেপি সমর্থকেরা জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিজুড়ে। সাধু-সন্তুদের এ কাজে সামনে রাখা হবে। কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে ‘নিধিসংগ্রহ যোজনা’। অর্থ সংগ্রহের কথা বলা হলেও মূল লক্ষ্য এটা বোঝানো—ধর্ম রক্ষায় তারা কত আন্তরিক। ‘বিজেপি যা বলে তা করে ছাড়ে’ এই বার্তাও দিতে চায় তারা বাঙালিকে।
এসব কলাকৌশল সামলাতে মমতার হাতে অস্ত্র বেশি নেই। দার্জিলিংয়ের গুর্খাদের সঙ্গে পুরোনো বৈরিতা কমিয়ে ভোটের কৌশলে সমর্থকদের খানিক আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়া দিতে পেরেছেন কেবল।
অনেক অপবাদ আর সাংগঠনিক সংকটের পরও পশ্চিমবঙ্গে মমতা বিজেপির জন্য অবশ্যই এক শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। তবে রাজ্যে বিজেপিবিরোধী শক্তি তিনি একা নন। আছে বামপন্থীরা এবং কংগ্রেসও। ২০১১-এর আগে ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল সিপিএম-সিপিআই-ফরোয়ার্ড ব্লক। মাঠে তাদের সাংগঠনিক শক্তি এখনো কম নয়। কিন্তু মমতার সঙ্গে সম্পর্ক অতি বৈরী। এতে বিজেপিবিরোধী ভোট ভাগ হবে কিছু। বিজেপির সুবিধা তাতে। হিন্দুত্ববাদী ভোটগুলো তারা একা পেতে চায়; বাদবাকি অন্যরা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিক। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে এ রকমই ঘটে প্রায় অর্ধেক রাজ্যজুড়ে। তবে সে রকম শঙ্কার মুখেও মমতার ভঙ্গি অদম্য। তাঁর ভরসা রাজ্যের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য। ভরসা ২৭-২৮ ভাগ ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপরও। সংখ্যালঘুদের শেষ ভরসা মনে হচ্ছে মমতা। কারণ, বিজেপি মানেই ধর্মবাদী নতুন অস্থিরতার ইঙ্গিত। সঙ্গে আছে নতুন নাগরিকত্ব আইনের হানা এবং নাগরিক শুমারির হুমকি। মুসলমান, নিম্নবর্ণের হিন্দু, আদিবাসী—সবার এসবে অনেক ভয়।
এই ভয়ের বিপরীতে মমতা কি আশ্রয় হয়ে দাঁড়াতে পারবেন? পশ্চিমবঙ্গে কেউই নিশ্চিত নয় তাতে। সবাই কংগ্রেস ও বামদের কৌশল দেখার অপেক্ষায় আছে। এই উভয় শক্তির ৬-৭ ভাগ করে ভোট আছে। এই ভোট নিয়ে তারা কি রাজ্যের রাজনীতির সংকীর্ণ হিসাব-নিকাশে আটকে থাকবে, নাকি বিজেপিকে মোকাবিলায় নতুন কোন অবস্থান নেবে। সেটাই দেখার অপেক্ষায় দেশ-বিদেশের বাঙালিরা এবং অন্যান্য ভারতবাসীও। পশ্চিমবঙ্গে বাঙালিত্বের এই রাজনৈতিক পরীক্ষার ফল দেখতে আগ্রহভরে তাকিয়ে বাংলাদেশও। এটা ধর্মবাদী জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের এক দ্বন্দ্বযুদ্ধ বটে। দেয়ালজুড়ে নির্বাচনী স্লোগান সে রকম বার্তাই দিচ্ছে। বিজেপি আওয়াজ তুলেছে, ‘এবার বাংলা—পারলে সামলা’। মমতার গলায় পুরোনো মন্ত্র ‘মা-মাটি-মানুষ’।
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক