২০১৪ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের সব জয় করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন, কিন্তু জিতেছিলেন ৩৪টি। কংগ্রেস চারটি, বাম দল দুটি ও বিজেপি পেয়েছিল দুটি। এবারের লোকসভা নির্বাচনে মমতা তাঁর দলের নেতা–কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন, ৪২টি আসনেই জিততে হবে, কোনো অজুহাত চলবে না। উল্লেখ্য, ভারতের আইনসভার নিম্নকক্ষ লোকসভার মোট আসনসংখ্যা ৫৩৪, এর মধ্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ৪২টি।
এবারে নির্বাচনে মমতা আরও একটি স্লোগানও তুলেছেন, ‘মোদি হটাও, দেশ বাঁচাও’। মমতার লক্ষ্য ভারতের কেন্দ্র থেকে মোদিকে হটিয়ে নতুন এক ধর্মনিরপেক্ষ প্রধানমন্ত্রী বসানো। তবে কে হবেন সেই পদের দাবিদার, তা মমতা এখনো স্পষ্ট করেননি।
ভারতে এখন তিনটি রাজনৈতিক জোট। বিজেপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ), কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট (ইউপিএ) ও কংগ্রেস-বিজেপিবিরোধী ২৩ দলের জোট ইউনাইটেড ইন্ডিয়া। এর নেতা এখনো ঘোষিত না হলেও মমতাই রয়েছেন এই জোটের প্রধান হিসেবে। বিজেপির এনডিএ জোটে আছে ২৯টি আর কংগ্রেসের ইউপিএতে ২৮টি রাজনৈতিক দল আছে। বিজেপি জোট জিতলে প্রধানমন্ত্রী হবেন নরেন্দ্র মোদি। কংগ্রেস জোট জিতলে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে রাহুল গান্ধীর। কিন্তু ইউনাইটেড ইন্ডিয়া জিতলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা নিয়ে কিছু বলা হয়নি। সম্ভাব্য নেতাদের এক নম্বরে আছেন তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর আছেন তেলেগু দেশম পার্টির নেতা চন্দ্রবাবু নাইডু, বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতী, সমাজবাদী পার্টির মুলায়ম সিং যাদব প্রমুখ। কিন্তু কোন জোট ভোটে জিততে পারে?
জনমত সমীক্ষাগুলোতে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এককভাবে বা এনডিএ জোটগতভাবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। সরকার গঠন করতে হলে লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে প্রয়োজন ২৭২টি আসন। গত সপ্তাহে এবিপি নিউজ ও সি-ভোরের যৌথ সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বিজেপি ২৬৪টি আসন পেতে পারে, তার জোট এনডিএ টেনেটুনে সরকার গড়তে সক্ষম হতে পারে। কংগ্রেসের জোট ইউপিএ পেতে পারে ১৪১টি আসন আর মমতার ইউনাইটেড ইন্ডিয়া পেতে পারে ১৩৮টি আসন। অবশ্য এই দুই জোট ঐক্যবদ্ধ হলে সরকার গড়তে পারে।
জরিপে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে ৪২ আসনের মধ্যে তৃণমূল পেতে পারে ৩৪টি। বিজেপি পেতে পারে ৮টি; কংগ্রেস ও বাম দল কোনো আসন না–ও পেতে পারে। কিন্তু কংগ্রেস ও বাম দল এ হিসাব মানছে না। তারা বলছে, এবার তারা গতবারের থেকে বেশি আসন পাবে। তারা একটুও হাল ছাড়েনি। তারা নিশ্চিত, মোদি এবার আর ফিরছেন না। দেশে আসবে নতুন সরকার, নতুন প্রধানমন্ত্রী। এই লক্ষ্য নিয়ে তারা রাজনৈতিক ময়দান চষে বেড়াচ্ছে।
ভারতের অন্যান্য রাজ্যে কংগ্রেসসহ বিজেপিবিরোধী বিভিন্ন দল আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচনে লড়তে যাচ্ছে। বৃহত্তম রাজ্য উত্তর প্রদেশের ৮০ আসনে মায়াবতী ও অখিলেশ যাদবরা ভাগাভাগি করে প্রার্থী দিয়েছেন। আসনসংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য মহারাষ্ট্রে ৪৮টি আসনে আসনরফা হয়েছে কংগ্রেসের সঙ্গে শারদ পাওয়ারের জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টি বা এনসিপির। চতুর্থ স্থানে আছে বিহার। আসনসংখ্যা ৪০। এখানেও আসন ভাগ হয়েছে বিজেপিবিরোধী দলের মধ্যে। পঞ্চম স্থানে রয়েছে তামিলনাড়ু। এখানে রয়েছে ৩৯টি আসন। এখানেও ডিএমকের সঙ্গে আসনরফা হয়েছে কংগ্রেসের। অন্যান্য রাজ্যেও বিজেপিবিরোধী দলগুলো আসন ভাগাভাগি করেছে। কিন্তু আসনসংখ্যার দিক থেকে তৃতীয় বৃহত্তম রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেস আসন ভাগাভাগির পথে হাঁটছে না। তারা এককভাবে ৪২টি আসনেই জিততে চাইছে। এ রাজ্যে অন্য কোনো দল এককভাবে ৪২টি আসনেই প্রার্থী দিতে পারেনি।
ফলে মমতার স্বপ্ন, নির্বাচনে আসনসংখ্যার দিক থেকে তাঁরাই কংগ্রেসের পরে থাকবেন। আর ইউনাউটেড ইন্ডিয়া জোটের শীর্ষে থাকবে মমতার তৃণমূল। তখন যদি দেখা যায় বিজেপির ভরাডুবি আর সম্মিলিত বিরোধীদের আসনসংখ্যা সরকার গড়ার মতো অবস্থানে রয়েছে, সে ক্ষেত্রে মমতাই হবেন রাহুল গান্ধীর পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার। এসব অঙ্ক কষেই এগোচ্ছেন মমতা। এই লক্ষ্যে কাউকে কোনো একটি আসন না দিয়ে বরং একাই ৪২ আসনে প্রার্থী দিয়ে জয়ের স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নও দেখা শুরু করেছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, মমতার তৃণমূল কি ৪২ আসনেই জিততে পারবে? বিরোধীরা কি একটি আসনও পাবে না? রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা মমতার অলীক স্বপ্ন। মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস। জনমত সমীক্ষাগুলোতেও বলা হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস সব আসনে জিতবে না। কয়েকটি জনমত সংস্থা বলেছে, পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে উঠে আসবে বিজেপি। এই দল বলছে, তারা এবার পশ্চিমবঙ্গে ২৩টি আসনে জিততে চলেছে।
অমর সাহা প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি