মন্ত্রী-বচন: যখন কাজের চেয়ে কথা বেশি

কবি কুসুম কুমারী দাশ লিখেছিলেন, আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।

কুসুম কুমারী দাশ প্রখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশের মা; যিনি নিজেও ছিলেন কবি। তাঁর এ কথাটির অন্তর্নিহিত অর্থ গভীর। যারা কথায় নয় কাজে বড় হবে, সেই ছেলেদের অপেক্ষা করেছিলেন কুসুম কুমারী দাশ। কিন্তু আমাদের দেশের মন্ত্রী-নেতারা কাজে বড় না হয়ে কথায়ই বড় হতে চান। অন্যের জন্য তাঁরা যে উপদেশ বাণী আওড়ান, সেই বাণী নিজেরাই বিশ্বাস করেন না।

মন্ত্রী থাকতে তাঁরা বড় বড় কথা বলেন। ভাবেন, তাঁরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয়ের সব সমস্যা রাতারাতি সমাধান হয়ে যাবে। গত বছর একজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী এই বলে বড়াই করেছিলেন যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীরা নাকি বাংলাদেশের মন্ত্রীদের উপদেশ নিতে মুখিয়ে আছেন। আমাদের মন্ত্রীদের সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য তাঁরা দীর্ঘ লাইন দিয়ে থাকেন।

যেসব মন্ত্রী এ রকম অতি আত্মগরিমায় ভোগেন, তাঁদের মন্ত্রণালয়ে কোনো সাফল্য দেখা যায় না। তাঁরা যদি বিদেশের দিকে তাকিয়ে না থেকে একবার দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন, বুঝতে পারতেন, মন্ত্রীদের সম্পর্কে তাঁদের মনোভাবটা কী।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর যে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়, তাতে অভিজ্ঞ মন্ত্রী ছিলেন খুব কমই। তার প্রথম কারণ নতুন মন্ত্রিসভার বেশির ভাগ সদস্য বয়সে তরুণ। তরুণেরা মন্ত্রী হতে পারবেন না, এ রকম কোনো বিধান নেই। তবে মন্ত্রী হওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁদের কিছুটা হোম ওয়ার্ক করতে হয়। পড়াশোনা থাকতে হয়। যুক্তরাজ্যেও মন্ত্রিসভায় তরুণদের নেওয়া হয়। তবে সেখানে একজন মন্ত্রীর সঙ্গে কয়েকজন অভিজ্ঞ উপদেষ্টা নেওয়া হয়, যাতে তরুণ মন্ত্রী তাঁর অভিজ্ঞতার ঘাটতি মেটাতে পারেন।

আমাদের মন্ত্রীরা অন্য কারও উপদেশ নেন না। দেশবাসীকে হররোজ উপদেশ দিয়ে থাকেন। তাঁরা নিজের মন্ত্রণালয় সম্পর্কে বলেন কম। বেশি বলেন রাজনীতি নিয়ে। আওয়ামী লীগের আগের মন্ত্রিসভাটি ছিল পাঁচমিশালি। অর্থাৎ জোটসঙ্গী জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতার পাশাপাশি সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি থেকেও মন্ত্রী করা হয়েছিল। এবারেরটি নির্ভেজাল আওয়ামী লীগ সরকার। সেখানে অন্য কারও প্রবেশাধিকার নেই।

একজন মন্ত্রী সফল না বিফল, তা জানা যায় মন্ত্রিত্ব যাওয়ার পর। মন্ত্রিত্ব যাওয়ার পরও যদি মানুষ কাজের জন্য তাঁকে স্মরণ করে, তাহলে বুঝতে হবে তিনি জনগণের সেবা করেছেন। তিনি অন্যায়-দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেননি কিংবা ব্যক্তিগত সুবিধা নেননি। কিন্তু আমাদের দেশে সে রকম সৌভাগ্যবান মন্ত্রী হাতে গোনা দু–চারজনের বেশি হবে না। বরং সব আমলেই দেখতে পাই, যাঁরা মন্ত্রীর তখতে বসে জল ও স্থল ও অন্তরিক্ষ দাপিয়ে বেড়ান, মন্ত্রিত্ব হারানোর পর কেউ তাঁদের খোঁজও নেয় না। এ রকম একাধিক সাবেক মন্ত্রীকে জানি, নিজের জেলা শহরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই তাঁদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন।

একসময় ছিল জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা না বললে মন্ত্রীদের ঘুম হতো না। আবার কেউ কেউ সংবাদমাধ্যমকে গালমন্দ করে জিহ্বার ধার ঝালিয়ে নিতেন। কিন্তু এখন বিএনপি-জামায়াত সরকারকে চ্যালেঞ্জ করবে কী, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত। আর গত ১১ বছরে সংবাদমাধ্যম আইনি বেআইনি খড়্গের নিচে পড়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। কেউবা সরকারের হক না–হক সব কাজে হাততালি দিচ্ছে। ফলে বিরোধী দল কিংবা সংবাদমাধ্যম কাউকে নিয়ে মন্ত্রীদের মাথা ঘামাতে হচ্ছে না।

তাই সাম্প্রতিক কালে মন্ত্রীদের বক্তৃতা–বিবৃতিতে ঘুরেফিরে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। রোববারের পত্রিকায় দেখলাম, অন্তত চারজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ‘দল’ নিয়ে কথা বলেছেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অপকর্মের অভিযোগে আটক যুব মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার প্রশ্রয়দাতাদের প্রসঙ্গে বলেছেন, যাঁরা পাপিয়ার পেছনে আছেন, তাঁরাও নজরদারিতে। শুধু পাপিয়া নন, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও মাদকের সঙ্গে যারাই জড়িত, তারা নজরদারিতে আছে। এর আগে তিনি বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই পাপিয়াকে ধরা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের দুটি দিক আছে। একটি হলো পাপিয়ার প্রশ্রয়দাতাদের নজরদারিতে রাখা। অপরটি যারা সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও মাদকের সঙ্গে জড়িত, তাদেরও সরকার নজরদারিতে রাখছে। কত দিন ধরে? আওয়ামী লীগ একটানা ক্ষমতায় আছে ১১ বছর। এত দীর্ঘ সময় সরকার অপরাধীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ এবং কঠোর নজরদারিতে রাখার পরও কীভাবে অপরাধের নতুন নতুন সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীদের আবির্ভাব ঘটে? রাষ্ট্রযন্ত্র এবং ক্ষমতাসীন দলের কোনো না কোনো অংশের আশ্রয়–প্রশ্রয় না পেলে এটি সম্ভব নয়। এ রকম দানব তৈরির ঘটনা এরশাদ আমলে দেখেছি, বিএনপি আমলে দেখেছি। এখন আওয়ামী লীগ আমলেও দেখছি। কোনো অঘটন ঘটলে কিংবা হাতেনাতে কেউ ধরা পড়লে অনুপ্রবেশকারী বলে দায় মোচনের চেষ্টা করা হয়। মন্ত্রীরা প্রতিবারই বলেন, অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। কিন্তু ক্ষমতাবলয়ে এসব অপরাধী কীভাবে তৈরি হয়, সেই প্রশ্নের উত্তর নেই।

যখন পাপিয়ার ঘটনায় সারা দেশ তোলপাড়, তখনই খবর এল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হয়েছেন কিশোর অপরাধী চক্রের সাত গডফাদার। তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। তাহলে নজরদারিটি কি অপরাধীদের রক্ষার জন্যই?

মৎস্য ও পানিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, আওয়ামী লীগের মধ্যে বেইমান খুনি মোশতাকের মতো লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়েছে। তারা দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। দলের সাবেক নেতা মোহাম্মদ মামুন মিয়ার স্মরণে শনিবার স্বরূপকাঠি উপজেলা আয়োজিত সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। খুনি মোশতাক চক্র ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে। ৪৫ বছর পরও আওয়ামী লীগে খুনি মোশতাকের মতো লোকের আনাগোনা শুরু হওয়া মহা দুশ্চিন্তার বিষয়। তবে মন্ত্রী মহোদয়ের নিজের এলাকায় আওয়ামী লীগের এমন নেতাও আছেন, যিনি ভাইয়ের কাছ থেকেও উৎকোচ নিয়েছেন—সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি দখল করেছেন বলে অভিযোগ আছে। সম্প্রতি জেলখানা থেকে বেরিয়ে তিনি বিরাট শোডাউনও করেছেন।

চট্টগ্রামের এক অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ মানুষের মধ্যে মমত্ববোধ ও ভালোবাসা জাগ্রত করার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে তিনি শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তাঁরা যেন শিক্ষার্থীদের মেধাবিকাশের পাশাপাশি মমত্ববোধ, দেশাত্মবোধ এবং মূল্যবোধের শিক্ষা দেন। হাছান মাহমুদ শুধু মন্ত্রী নন, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকও। যেখানে ছাত্রলীগের নেতা শিক্ষককে ধাওয়া দিয়ে পুকুরে ফেলে দেন, প্রতিপক্ষ কোনো ছাত্রসংগঠন ক্যাম্পাসে মিছিল বের করলেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন, সেখানে মমত্ববোধ জাগ্রত হতে পারে না। তাই শিক্ষাঙ্গনে মমত্ববোধ ফিরিয়ে আনতে হলে সবার আগে ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরা প্রয়োজন।

অন্যদিকে, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বগুড়ার পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজের বঙ্গবন্ধু একাডেমিক ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে সব শিক্ষার্থীকে মুজিব–আদর্শে গড়ে তোলার কথা বলেছেন। মন্ত্রী যেদিন শিক্ষকদের প্রতি এই সদুপদেশ দিয়েছেন, তার পরের দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে চারজন আহত হয়েছেন। তাঁদের এক গ্রুপ চট্টগ্রাম সিটি মেয়রের অনুসারী এবং অপরটি শিক্ষা উপমন্ত্রীর। অতএব সব শিক্ষার্থীকে মুজিব–আদর্শে দীক্ষিত করার আগে শিক্ষামন্ত্রীর উচিত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মুজিব–আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা। তাতে শিক্ষাঙ্গনে কিছুটা হলেও শান্তি বজায় থাকবে।

মন্ত্রীরা প্রতিদিন রাজনীতি নিয়ে কথা বললেও নিজের মন্ত্রণালয় সম্পর্কে খুব কম কথাই বলেন। এর একটি কারণ হতে পারে মন্ত্রণালয়ে কীভাবে চলছে, তা তাঁরা জানেন না। অথবা মন্ত্রণালয় এমন কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি, যা জনগণকে জানানো যায়।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com