শিক্ষা ও সংস্কৃতি পরস্পর লগ্ন বিষয়। একের অভাবে অন্যের বিকাশ অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। তাই শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চা হতে হয় যুগপৎ। অন্যথায় তা পথ হারায়। শিক্ষা ও সংস্কৃতি বহুধারায় বহমান। তার গতি রুদ্ধ হলে, অথবা সংকীর্ণ হলে মানবিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুপ্রাচীনকাল থেকে তাই শিক্ষার পাশাপাশি সংস্কৃতির চর্চা চলে আসছে। শিক্ষালয় যত দিন আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেনি, তত দিন সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্রগুলোতেই শিক্ষাদানের কাজ চলত। প্রাচীন ভারতে তপোবন, প্রাচীন গ্রিসে প্লেটোর একাডেমি বা অ্যারিস্টটলের লাইসিয়াম ছিল এমনই যুগপৎ শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র। সেখানে জিম বা শরীরচর্চাকেন্দ্র ছিল অপরিহার্য অঙ্গ। আরও স্পষ্ট করে বললে জিমেই চলত পাঠদানের যাবতীয় কাজ। এখনো উন্নত বিশ্বে শিক্ষালয় ও জিম অভিন্ন। সঙ্গেই শিল্পকলার অন্যান্য শাখায় সাধনার সব আয়োজন। আমাদের দেশে সংস্কৃতির অন্য শাখাগুলো শিক্ষালয়–সংলগ্ন না থাকলেও অন্তত একটা খেলার মাঠ ছিল আবশ্যিক শর্ত। এখন, শিক্ষালয়গুলো নিজেই লৌহকারায় বন্দী, খেলার মাঠে চলে নিত্য বাণিজ্য।
ইহুদি শিক্ষা (হেব্রাইক) খুব বেশি শিক্ষাকেন্দ্রিক হওয়ায় তা গ্রিক শিক্ষার (হেলেনিক) মতো সর্বত্রগামী না হয়ে হিংসাশ্রয়ী হয়ে ওঠে। হেলেনিক সভ্যতার ভিত্তি আলোক, হেব্রাইকের ভিত্তি বাহুবল। হেলেনিক হৃদয় আলোকিত করে, উদ্ভাসিত করে; হেব্রাইক মনের গহিনে সম্পদের লোভ জাগায়। হেলেনিক শিক্ষা যত বেশি বৈশ্বিক ও বহির্মুখী, ইহুদি শিক্ষা ততই অন্তর্মুখী ও সংকীর্ণ। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা হেলেনিক শিক্ষাচর্চায় উদ্যোগী না হয়ে ইহুদিবাদী শিক্ষার দিকে অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়েছি। বহুধারার সংস্কৃতিচর্চা, বহুমত চর্চার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছি। শরীর ও মন, দেহ ও আত্মার সমান অধিকারকে অস্বীকার করে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার নামে অন্ধকারের পূজা করছি। কেবল বই ও পরীক্ষার কারাগারে শিক্ষাকে এমনভাবে আবদ্ধ করে ফেলেছি যে বহিরাঙ্গন বলতে শিক্ষালয়ের বাইরের কোচিং সেন্টারগুলোকেই বোঝায়।
এ দেশে চালু করা হয়েছে শিক্ষককেন্দ্রিক এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে কেবল জিপিএ–৫ ছাড়া আর কোনো আরাধ্য নেই, অন্য সবই মূল্যহীন। স্মৃতি-শ্রুতিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় দিতে স্মৃতি ও শ্রুতিকে নিন্দায় ভাসিয়েছি। এই একপেশে ও দুরাচারীদের বড় স্লোগান হলো ‘মুখস্থকে না বলো’। এর মাধ্যমে মানবশিশুর অতি বড় একটি গুণকে শুধু অস্বীকারই করা হয়নি, সংস্কৃতিচর্চাকেই (রেওয়াজ বা সাধনা) ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছে। অথচ প্রাচীন ভারতে তো বটেই, এখনো উন্নত বিশ্বে সাধনাই সিদ্ধিলাভের শ্রেষ্ঠ পন্থা হিসেবে স্বীকৃত।
শিক্ষায় সর্বকালে সর্বোত্তম পন্থা হিসেবে স্বীকৃত সৃজনশীল দক্ষতা। এর অর্থ হলো মানবশিশু তার অসীম সৃজনীক্ষমতায় নিত্যনতুন পথ আবিষ্কার। শিশুর এই অপার সম্ভাবনার গুণকে স্বীকৃতি দেওয়া। গভীর মনোযোগে কোনো কিছু বোঝার চেষ্টা করা, সমস্যা চিহ্নিত করতে পারা, সমস্যা সমাধানে সক্রিয় হওয়ার মধ্য দিয়ে মানবশিশু নব নব আবিষ্কারের পথ খুঁজে বের করে। এর মধ্য দিয়ে সে নতুন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হাজির করতে পারে। অন্যের সঙ্গে তুলনা বা পার্থক্য করতে শেখে। এমনই বিশ্লেষণ-সংশ্লেষণের মাধ্যমেই সম্ভব হয় নতুন কিছু সৃজন বা আবিষ্কার করা। স্যামুয়েল বেঞ্জামিন ব্লুমের শিক্ষাতত্ত্বে এরই নির্দেশ করা আছে ছয় ধাপে—স্মরণ (রিমেম্বারিং), বোঝা বা অনুধাবন (আন্ডারস্ট্যান্ডিং), প্রয়োগ (অ্যাপ্লাই), বিশ্লেষণ (অ্যানালাইজ), মূল্যায়ন (ইভালুয়েট) ও সৃজন (ক্রিয়েট)।
আরও সহজ করে বললে—১. আমি জানি, ২. আমি বুঝি, ৩. আমি ব্যবহার (প্রয়োগ) করতে পারি, ৪. আমি ব্যাখ্যা (বিশ্লেষণ) করতে পারি, ৫. আমি বিচার (মূল্যায়ন) করতে পারি এবং ৬. আমি সৃজন করতে পারি। লক্ষণীয়, ব্লুমের শিক্ষাতত্ত্বে আমি হচ্ছে শিক্ষার্থী নিজে। অ্যারিস্টটলের আরোহী পদ্ধতির বিপরীতে ব্লুম সাহেব শিক্ষাতত্ত্বে প্রাচীন ভারতের গুরু আশ্রম কিংবা প্রাচীন গ্রিসের সক্রেটিসের (অবরোহী বা ডাইডাক্টিভ) পদ্ধতি ফিরিয়ে এনেছেন। এই পদ্ধতিতে শিশুর সব সম্ভাবনাকে অসীম বলে স্বীকার করা হয় এবং কেবল পাঠ্যবইয়ে সীমাবদ্ধ না রেখে শিশুর সব আবেগ ও মনোপেশীয় বিকাশের ওপর সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে শিক্ষা ও সংস্কৃতি এক দেহে লীন হয়ে আত্ম-আবিষ্কারের মাধ্যমে নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতে আত্মনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ হয় শিশু।
সমগ্র সামাজিক জীবনই ব্যক্তির জন্য একটি শিক্ষাপ্রক্রিয়া। সব রাষ্ট্রের মধ্যে সম্ভবত প্রাচীন গ্রিস ছিল সর্বাধিক সংস্কৃতিমান রাষ্ট্র—যার ছিল অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য বা সমন্বয়ের বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য। অন্যান্য সংস্কৃতির তুলনায় গ্রিক রাষ্ট্র শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে সমন্বয় ও সৌন্দর্যের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিল। রুশ শিক্ষাবিদ লুনাচারস্কির ভাষায়, যাবতীয় গ্রিক ট্র্যাজেডি, গ্রিক থিয়েটার, গ্রিক ইতিহাস, গীতিকবিরা সবাই একই নীতির ঐকতানে বাঁধা এবং তা হলো নিটোল সমগ্রের সঙ্গে ব্যক্তির সমন্বয় সাধনের ইচ্ছা। গ্রিকদের কাছে সর্বোচ্চ মূল্যবান হলো স্বদেশপ্রেম, গ্রিকরা যাকে বলে অহমিকা বা ঔদ্ধত্য, সেই সব ব্যক্তিত্ববাদী প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, এগুলোকে সংযমের, পরিমিতির, মধ্যপন্থার অধীন করা।
শিল্পকলা জনপ্রিয়করণের ব্যাপারটি প্রথম দৃষ্টিতে বিলাসিতা বলে মনে হতে পারে। অনেকে প্রায়ই এ কথা মনে করে যে বিদ্যালয়মুক্ত শিক্ষায় শিল্পকলাও থাকবে, হয়তো বিনোদনের সময় শিক্ষাদানের জন্যই। এটি অত্যন্ত হাস্যকর দৃষ্টিভঙ্গি। লুনাচারস্কি বলেন, শিল্প হলো একটি শক্তি, যা শিল্পীর প্রকাশিত বিশেষ আবেগের শক্তিতে শ্রোতা বা দর্শকসাধারণের অনুভূতিকে প্রভাবিত করে। এটা তর্কাতীত সত্য। বাগ্মিতা বলতে বক্তার কেবল প্রচার হওয়াটাই বোঝায় না (শ্রোতার জ্ঞানের পরিধি বর্ধন), উত্তেজনাসঞ্চারী (অনুভূতিকে নাড়া দেওয়া) হওয়াও বোঝায়…মানুষের তখনই চারিত্র্যবদল ঘটে যখন সে আপ্লুত হয়, যখন সে জ্বলে ওঠে, যখন সে ভালোবাসে, যখন তার আবেগের তারে, অনুভূতির মর্মে সাড়া জাগে।
আর এটাই তো শিল্পের কাজ! মানুষ, এমনকি তাদের অস্তিত্বের উষালগ্নেও, সব ধরনের সামাজিক, নৃত্যগীতির আশ্রয় নিয়েছিল। বিজ্ঞান যেমন মস্তিষ্ককে, শিল্পকলা তেমনি হৃদয়কে সংগঠিত করে এবং এর প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে জনগণের নৈতিক উন্নতি ঘটায়। মানুষের যেকোনো জাতির বিকাশলগ্নে, অতীতেও আমরা মহান শিল্পের অভ্যুদয় প্রত্যক্ষ করি, যা আমাদের প্রতিটি বোধ্য উদ্দীপনা ও আনন্দের উৎস হতে পারে। লুনাচারস্কির মতে, যে প্রবণতা মানুষকে শাসকশ্রেণির অনুগত যন্ত্র বানানোর লক্ষ্যে কার্যকর, জনকল্যাণে তা কোনো ভূমিকা পালন করে না।
শিক্ষা শব্দটির তিনটি অর্থ রয়েছে। এক পক্ষে নিজেকে গড়া, অর্থাৎ নিজেকে নিজের তৈরি আদর্শের রূপ বা ভাবমূর্তির ঘনিষ্ঠ করা। পক্ষান্তরে, এমন একজন বিদগ্ধ মানুষ হওয়া, যে মানুষটি অর্ধ-প্রস্তুত সামগ্রী থেকে, ‘মানুষী ধাতুপিণ্ড’ থেকে মানুষের সেই মহিমান্বিত প্রত্যয়ের ঘনিষ্ঠ এক সত্তায় উত্তীর্ণ হচ্ছে, হয়তো আজও সে জন্মায়নি, যাকে আমরা জন্মাতে চাই—এই বিদগ্ধ মানুষের পক্ষে এককভাবে, যথাযোগ্য প্রতিবেশ ব্যতিরেকে টিকে থাকা সম্ভব নয়। শিক্ষার কাজ শুধু কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্বকে শিক্ষিত করা নয়, মানবজাতি গড়ে তোলা, সমাজ গড়ে তোলা। মানুষ কেবল নিজেকে, তার সামাজিক প্রতিবেশকেই গড়ে তোলে না, ভৌত পরিবেশকেও তৈরি করে।… সে এমন এক জীবন সৃষ্টি করে, যা যাবতীয় আত্মিক চাহিদা মেটায়, যে মানুষ তার নিজেরই স্রষ্টা।
শিক্ষার নামে বাংলাদেশে আমরা এক চরম একঘেয়েমি পরীক্ষাসর্বস্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলছি। একঘেয়েমিজনিত বিরক্তিই সব ধরনের দুষ্কর্মের দিকে, অর্থহীন চালাকি, বীভৎস ও লজ্জাকর কাজের দিকে মানুষকে ঠেলে দেয় (লুনাচারস্কি)। আর সেখানে শামিল করছি দেশের গতর খাটা ও নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের হতভাগ্য পড়ুয়াদের। এভাবে সমাজের বৃহত্তর অংশকে ক্রমেই ঠেলে দিচ্ছি প্রান্তদেশে, যেখান থেকে তাদের ফেরার আর কোনো পথই থাকছে না।
অন্যদিকে ধনিক শ্রেণির সন্তানদের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষাধারা গড়ে তোলা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। বিদেশি সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠছে তাদের অনেকেই, হয়ে উঠছে দেশ–বিচ্ছিন্ন এক নয়া প্রজন্ম।
ফলে সাধারণ ঘরের শিশুরা পাচ্ছে না দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার শিক্ষা। অন্যদিকে বিত্তবান ঘরের শিশুরা শিখছে দেশকে ঘৃণা করতে। এরূপ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে লাভবান হবে শুধু মানববিরোধী শক্তিই। শিক্ষা ও সংস্কৃতির যুগলবন্দী ছাড়া কোনো সভ্যতা গড়ে ওঠে না, কোনো জাতি টিকে থাকে না। শুধু প্রাচুর্য কোনো জাতির টিকে থাকার গ্যারান্টি দিতে পারে না। যে শিক্ষা সমগ্র জাতিকে একসূত্রে বাঁধতে ব্যর্থ, যে শিক্ষায় সাংস্কৃতিক উজ্জীবনের অভাব থাকে, সে সমাজ ভেঙে পড়তে বাধ্য। আমরা যখন সহস্রাব্দ টেকসই উন্নয়নের কথা সাড়ম্বরে ঘোষণা করি, তখন যেন এ মূল্যবান কথাগুলো বিস্মৃত না হই।
আমিরুল আলম খান যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
amirulkhan7@gmail.com