বাংলাদেশে উন্নয়ন এখনো রাস্তাকেন্দ্রিক। সেই রাস্তাও গর্ত, কাদা ও ধুলোভরা। উন্নত শিক্ষা, উন্নত স্বাস্থ্য, উন্নত কর্মসংস্থান ও উন্নত কাজের পরিবেশ এবং সর্বোপরি উন্নত জীবনমান এখন ‘উন্নয়নের’ প্রতিশব্দ হয়ে ওঠেনি। আফসোস! মধ্যবিত্ত দেশ হিসেবে দেশের শিক্ষার মান, শিক্ষাদান প্রক্রিয়া, শিক্ষাবিস্তার কৌশল, শিক্ষা অবকাঠামো ও বরাদ্দ সত্যিকারভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছাবে, সেই আশা করি। বাংলাদেশ আর্থিক সক্ষমতায় মধ্যবিত্ত দেশের স্তরে পৌঁছার প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়ায় বাংলাদেশ সরকার ও তার শিক্ষা প্রশাসনকে মধ্যবিত্ত দেশগুলোর সমান্তরাল মানের শিক্ষাকাঠামো ও শিক্ষা কর্মসূচি সূচনার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া এই অর্জন টেকসই হবে না। শিক্ষার মান ও অংশগ্রহণ কার্যকরভাবে সম্প্রসারণ করার জন্য দেশের সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য নিম্নোক্ত সুবিধাগুলোর দাবি করছি। কেননা, মধ্যবিত্ত দেশ হিসেবে শিক্ষায় মৌলিক সুবিধাগুলোর অনুপস্থিতি লজ্জাজনক বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়ে সরকারকে আন্তর্জাতিক পরিসরে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার উপলক্ষ তৈরি করবে।
বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি
২০১৭-১৮ বাজেটে সরকারের রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৮৩ হাজার কোটি, ২০১৮-১৯ বাজেটের প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ হাজার কোটি। সুতরাং টাকা নেই বলার সুযোগ নেই বাংলাদেশের। সরকার শিক্ষার সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রযুক্তি ও অটোমেশন মিলিয়ে বাজেটে শিক্ষা খাত বাড়িয়ে দেখায়, এই দুর্বৃত্তপনার অবসান চাই, শিক্ষায় সঠিক ও দরকারি মনোযোগ চাই। দুর্নীতি ও অতি খরচের লাগাম টেনে বাজেটের একই টাকায় বেশি কাজ করতে হবে সরকারকে। আমরা চাই না কথিত উন্নয়ন বাজেট দুর্নীতি, লাগামহীন দৃষ্টিকটু অপব্যয় আর লুটে ব্যয়িত হোক।
বাধ্যতামূলক শিক্ষার স্তর বাড়াতে হবে
কোনো অগ্রসর দেশ প্রাথমিক শিক্ষাকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত রেখে দেয়নি। ১৯৯২-এর কিছু পরে প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা হয়। এরপর ২৫ বছরের বেশি হয়ে গেল তাও পঞ্চমের অতি নিম্ন স্তর থেকে বাধ্যতামূলক শিক্ষাকে আপগ্রেড করা হয়নি। এটা বাংলাদেশের সরকারগুলোর বিশাল বুদ্ধিবৃত্তিক হীনতা, যা নিয়ে নাগরিকেরা একেবারেই সচেতন হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষার স্টান্ডার্ড হলো ১৮ বছর, মানে উচ্চমাধ্যমিক। বোধ করি, শিক্ষাব্যয় ও অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে বলে বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চমের পরে এগোচ্ছে না, অষ্টম পর্যন্ত বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে সেটাকে ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যর্থ করা হয়েছে। দরকার ছিল এটা ধাপে ধাপে অষ্টম থেকে দশম হয়ে দ্বাদশ পর্যন্ত বাধ্যতামূলক শিক্ষায় পৌঁছানো। অর্থাৎ ছেলেমেয়েরা ১৮ বছর পর্যন্ত যার যা ঝোঁক, সেই অনুযায়ী তাত্ত্বিক (থিওরি) কিংবা প্রায়োগিক শিক্ষা নেবে। এরপর যোগ্যতা ও পারিবারিক অবস্থা অনুসারে উচ্চশিক্ষায় যাবে অথবা কাজে যাবে। এতে দেশের মানবসম্পদের ভিত্তিমান উঁচু হবে।
শিক্ষাবৃত্তি শিশুশ্রমের মজুরির চেয়ে কম হওয়া যাবে না
শিক্ষা উপবৃত্তিকে নামকাওয়াস্তে মাসিক বা ত্রৈমাসিক মাত্র এক-দু-তিন শ টাকায় রেখে না দিয়ে বরং বাড়াতে হবে। গরিব পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের কৃষি বা গার্মেন্টস-শ্রমের কাছাকাছি হারে আর্থিক শিক্ষা প্রণোদনা দিয়ে স্কুল ও কলেজগামী ছাত্রছাত্রী সংখ্যা বাড়াতে হবে। যেহেতু শিশু ও কিশোর-শ্রমের মজুরি উপবৃত্তি থেকে শতগুণ বেশি, তাই এই নামমাত্র উপবৃত্তি দিয়ে বস্তি এলাকার কিংবা কৃষি ও শিল্পশ্রমে নিয়োজিত পরিবারের ছেলেমেয়েদের স্কুল ঝরে পড়া রোধ করা চূড়ান্তভাবে সম্ভব হবে না। সুতরাং চাষাবাদের ভূমি নেই—এই ধরনের কৃষক, সম্পূর্ণ ভূমিহীন কৃষক, বস্তিবাসী, রিকশাচালক, সব ধরনের ভাসমান শ্রমিক, ভূমিহীন জনজাতি ইত্যাদি আর্থিকভাবে প্রান্তিক শ্রেণি এবং বিশেষভাবে পোশাকশ্রমিক পরিবারের জন্য কৃষি ও শিল্পশ্রমের (শিশু-কিশোর শ্রম) সমমানে ছেলেমেয়ে-নির্বিশেষে আর্থিক উপবৃত্তি উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। সেই সঙ্গে এই ধরনের গরিব শ্রমজীবী ও কৃষি পরিবার যাতে বাচ্চাদের নিয়মিত স্কুলে পাঠায় এবং সন্তানের শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হয়, তার জন্য নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থাও তৈরি করতে হবে। আমাদের নিম্নবিত্ত ও প্রান্তিক সমাজ শিক্ষায় যথেষ্ট পশ্চাৎপদ, মধ্যবিত্ত দেশ হিসেবে এর উত্তরণ অতীব জরুরি।
দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে
এই প্রণোদনাকে সুরক্ষা দেওয়ার কিছু দিকও তৈরির দরকার হতে পারে, যাতে এ সুবিধা অপচয়িত না হয়। এর জন্য এসএসসি পাস (সনদধারী হওয়া) করা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। তা না হলে নবম ও দশমের শিক্ষা উপবৃত্তির উল্লেখযোগ্য অংশ জরিমানাসহ ফেরত নেওয়ার ভয়ের বিধান রাখা যেতে পারে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং এর সব খরচ রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে। উন্নত রাষ্ট্রে বাধ্যতামূলক শিক্ষা ধরা হয় উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত। বাংলাদেশে এখনই উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা কিছুটা খরুচে হয়ে উঠবে বিধায় অন্তত দশম পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোতে হবে, যাতে পরের ধাপ দ্বাদশে পৌঁছানোর প্রস্তুতি নেওয়া যায়। এবং দশম পর্যন্ত স্কুলে কোনো ধরনের বেতন থাকবে না।
ঝরে পড়া বন্ধে
ঝরে পড়া শতভাগ কমিয়ে আনার আশু লক্ষ্যমাত্রা নিতে হবে। স্কুলে সম্পূর্ণ ফ্রি ও মানসম্পন্ন টিফিন দিতে হবে। মানসম্পন্ন টিফিন ঝরে পড়া কমাতে কাজে আসবে।
শিক্ষার পারিবারিক ব্যয় কমিয়ে আনতে হলে
সরকারি স্কুলে অথবা নির্দিষ্ট আয়সীমার পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের পাবলিক পরীক্ষার সব রেজিস্ট্রেশন ফি ফ্রি হতে হবে। এখনো রেজিস্ট্রেশন ফির অভাবে ছাত্রছাত্রীদের পাবলিক পরীক্ষা দেওয়া মুশকিল হয়, এর জন্য ধারদেনা করতে হয়। এমনকি পরিবারগুলো উচ্চ সুদে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে পাবলিক পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন ফি জোগায়। এর বাইরে রেজিস্ট্রেশন ফির নাম করে স্কুলগুলো বর্ধিত ফি নেয়, এই ফি সম্পূর্ণরূপে তুলে দেওয়া হোক। শিক্ষা উপকরণ ফ্রি দেওয়া চাই। এখনো দেশে স্কুল ড্রেসের অভাবে, বাচ্চারা স্কুলে যেতে অনীহা দেখায়, প্রান্তিক অভিভাবকদের ড্রেস বানিয়ে দেওয়ার সাধ্য হয় না। খাতা, কলম, জ্যামিতি বক্স, ক্যালকুলেটর ইত্যাদির অভাব নিত্য চিত্র।
মেয়েদের জন্য সুযোগ-সুবিধা
মেয়েদের জন্য স্কুল ও কলেজে সুযোগ-সুবিধা (অন্তত স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন) নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি মাধ্যমিক ও ওপরের স্তরের স্কুলে মেয়েদের জন্য আলাদা গার্লস কমন রুম ও টয়লেটের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষার জন্য পরিবহন-ব্যবস্থা (স্কুলবাস) করতে হবে। গ্রামীণ এলাকায় বাইসাইকেল লোন দিতে হবে।
শিক্ষার মান বাড়াতে
শিক্ষাকে মানবিক ও মানসম্পন্ন করতে অন্তত বিসিএস সমপর্যায়ের যোগ্যতাসম্পন্ন নারী শিক্ষক প্রাথমিক থেকেই নিয়োগ দিতে হবে। কোনোমতে এইচএসসি বা স্নাতক ডিগ্রি সনদধারীকে যেনতেন বেতনে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার দায়সারা কাজ থেকে রাষ্ট্রকে সরতে হবে।
ওপরে বলা ধাপগুলো পার হওয়ার পরের স্তরে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সব ক্লাস লেকচারে মাল্টিমিডিয়াভিত্তিক কোর্স কনটেন্ট পড়ানো, প্রেজেন্টেশন ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আসতে হবে। এর বাইরে মাত্র ৪৫ মিনিট করে প্রায় সব বিষয়ের ক্লাস রাখার সংস্কৃতি বাদ দিতে হবে। ছোট ক্লাসে শিক্ষকেরা গালগল্প করে কাজ সেরে কোচিংয়ে ব্যস্ত হন। প্রতি ক্লাস দুই ঘণ্টা করে দিনে সর্বোচ্চ তিনটি বিষয়ে ক্লাস থাকা দরকার। প্রতি ক্লাসে লেকচার, অনুশীলন, টেস্ট, কুইজ, প্রেজেন্টেশনের জন্য টিচারকে ব্যাপক পরিমাণ স্কুলওয়ার্ক ধরিয়ে দিতে হবে।
নাগরিকের মাঝে সঠিক জনস্বার্থভিত্তিক দাবি তোলার ধারণা ও তাগাদা আসুক, এই কামনা করি। বাংলাদেশের মানুষের অন্যতম একটি বড় সমস্যা, তারা অনেক সময় জানেই না সরকারের কাছে কী দাবি করতে হবে! ফলে সরকারও কার্যকর ও দূরদর্শী কিছু না করেই পাঁচ বছর অন্তর অন্তর কিছু রাস্তা কার্পেটিং করেই সমুদয় বাজেট খরচ করে দিচ্ছে। বড় বড় সামাজিক বিপর্যয়েও ‘কোনো সমস্যা না’ বলে আশ্বস্ত করা হচ্ছে। একশ্রেণির মানুষের এই চাওয়ার দীনতা অথবা অজ্ঞতা কিংবা অক্ষমতাই একের পর এক দায়িত্বহীন, দুর্নীতিপরায়ণ ও দুর্বৃত্ত সরকার তৈরি করছে।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: টেকসই উন্নয়নকর্মী। প্রকৌশলী, নেদারল্যান্ডসে কর্মরত।
faiz.taiyeb@gmail.com