যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। অথচ ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর জাপানের কোনো প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ইরান সফরকে নিয়ে আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলেন অনেকে। কিন্তু সে আশার পাল ফুটো করে দিয়েছে দুটি বিস্ফোরণ।
ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকেই যে উত্তেজনার শুরু, তা এখন ছায়াযুদ্ধের দিকে মোড় নিচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার হরমুজ প্রণালির কাছে সৌদি আরব ও সিঙ্গাপুরের মধ্যে চলাচলকারী জাপানি মালিকানাধীন একটি তেলবাহী ট্যাংকারে হামলা হয়েছে। ইরানের দক্ষিণ উপকূল থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে যখন এ বিস্ফোরণ হচ্ছে, তার আগেই ইরান প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে বৈঠক শেষে জাপানের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘অঞ্চলটি দুর্ঘটনাবশত যেকোনো সংঘর্ষে জড়িয়ে যেতে পারে। শিনজো আবে ইরান গিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বার্তা নিয়ে। ঠিক কী বার্তা তা অবশ্য এখনো জানা যায়নি।
বৃহস্পতিবার প্রথম বিস্ফোরণটি হয় স্থানীয় সময় সকাল ছয়টার পরপর। এর এক ঘণ্টার মাথায় দ্বিতীয় বিস্ফোরণটি হয় কাছাকাছি অঞ্চলেই। এবার লক্ষ্য ছিল নরওয়ের মালিকানাধীন একটি তেলের ট্যাংকার, যা তাইওয়ান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) মধ্যে চলাচল করে। এ দুটি ঘটনার সরাসরি প্রভাব পড়েছে জ্বালানি তেলের বাজারে। চার শতাংশ দাম বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই উভয় পক্ষ থেকেই অভিযোগের তীর তোলা হয়েছে পরস্পরের দিকে। এই দোষারোপের খেলার মাঝে একমাত্র আশঙ্কাই আরও গাঢ় হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। জাতিসংঘ মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি সংঘর্ষ এড়াতে দ্রুত আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু সে রকম কোনো প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না।
ওয়াশিংটনে ট্রাম্প প্রশাসন কোনো সময় ব্যয় না করেই এ হামলার দায় ইরানের ঘাড়ে চাপিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। একই সঙ্গে গত মাসে হওয়ার চারটি হামলার দায়ও ইরানের বলে তারা দাবি করেছে। এ ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি, ইরান ও ওমানের মধ্যবর্তী ওমান উপসাগরীয় অঞ্চলেই ছয়টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলায় যে অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে এবং যেভাবে হামলা করা হয়েছে তার একমাত্র সক্ষমতা ওই অঞ্চলে ইরান ছাড়া আর কারও নেই। খোদ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এ কথা বলেছেন। তিনি এ ক্ষেত্রে গোয়েন্দা তথ্যের বরাত দিলেও সুস্পষ্ট কোনো তথ্যের কথা উল্লেখ করেননি।
এদিকে তেহরান এ অভিযোগ অস্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে। তারা বলছে, ঘটনাটি অন্য কিছু ইঙ্গিত করছে। ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির সঙ্গে যখন জাপানের প্রধানমন্ত্রী বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে বৈঠক করছেন, তখনই জাপানের মালিকানাধীন জাহাজে হামলা হয়। উত্তেজনা প্রশমনে উপসাগরীয় অঞ্চলের সব পক্ষের সঙ্গে ইরান যে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে, সে বিষয়ে তারা আন্তরিক বলেও উল্লেখ করেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ।
এই দোষারোপের খেলাটি চলবে এবং এটি এই উত্তেজনাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলেই মনে হচ্ছে। এ খেলাটি না থামলে সারা বিশ্বকেই হয়তো বড় মূল্য চোকাতে হবে। এ হামলায় ইরান যদি জড়িতও থাকে, তাহলেও যুক্তরাষ্ট্র নিজের দায় এড়াতে পারবে না। কারণ, তারাই নিষেধাজ্ঞাসহ নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে ইরানকে জেরবার করে তুলেছে। এ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ, ইরান প্রোগ্রামের পরিচালক আলী ভায়েজ নিউইয়র্কারকে বলেন, ‘ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় থেকেই ওয়াশিংটন ইরানের সঙ্গে বৈরী আচরণ করছে। এটি ইরানকে বাধ্য করতে পারে। আর ইরান এটি না করে থাকলে, এ ঘটনার পেছনে তারাই রয়েছে, যারা ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ চাইছে।’
এমন কোনো সংঘাতের মূল্য সম্পর্কে সারা বিশ্ব ওয়াকিবহাল। এরই মধ্যে জ্বালানি তেলের বাজার সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কারণ এমন সংঘাতের মূল ক্ষেত্রটি হতে পারে হরমুজ প্রণালি, যে পথ দিয়ে বিশ্বের মোট জ্বালানি তেল সরবরাহের এক-পঞ্চমাংশই হয়ে থাকে। আধিপত্যের লড়াইয়ের বলি হওয়ার আরেকটি পথে এসে উপনীত হয়েছে গোটা বিশ্ব। বিষয়টি অনুধাবন করেই ইউরোপের দেশগুলো উত্তেজনা প্রশমনে আশু পদক্ষেপ গ্রহণের ডাক দিয়েছে। জার্মানির পক্ষ থেকে উভয় পক্ষকে সমঝে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে।
যদিও রাশিয়া ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা অর্থনৈতিক, সামরিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও মানসিক চাপের কথা উল্লেখ করে সংকট নিরসনে ওয়াশিংটনকে এগিয়ে আসতে হবে বলেই বার্তা দিচ্ছে। কিন্তু সেই বার্তা ওয়াশিংটন অন্তত এখন পর্যন্ত বুঝেছে বলে মনে হচ্ছে না। তারা সরাসরি বৃহস্পতিবারের হামলাকে সুস্পষ্ট উসকানি হিসেবে উল্লেখ করেছে। একই সঙ্গে একে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখাতে চাইছে, যা আশির দশকের উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রেক্ষাপটটিই মনে করিয়ে দেয়। ১৯৮৪ সালে জ্বালানি তেলের স্থাপনা ও তেলবাহী ট্যাংকারে হামলার মধ্য দিয়েই উত্তেজনা শুরু হয়েছিল, যা পুরোদস্তুর যুদ্ধে রূপ নিতে সময় লাগেনি। আর ১৯৮৭ সাল নাগাদ এ যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে।
গত মাসে হওয়া চারটি হামলার বিষয়ে ইউএই এবং সৌদি আরব তদন্ত করেছে। তারা তাদের প্রতিপক্ষের দিক থেকে হামলা হয়েছে বললেও, ইরানের নাম নেয়নি। যদিও শুরু থেকেই এ দুই দেশের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ইরানের দিকেই আঙুল তুলে আছে। বৃহস্পতিবারের হামলার পর এখন আঙুলের পাশাপাশি ইরানের দিকে আরও কিছু তাক করা হবে বলে এক ধরনের হুমকিও এসেছে ট্রাম্প প্রশাসনের দিক থেকে। সৌদি আরব ও ইউএই স্পষ্টতই এ বিবাদে দর্শক সারিতে বসতে চায়। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানই তাদের একমাত্র প্রতিপক্ষ, যা গত প্রায় এক দশকে সিরিয়া ও ইয়েমেন ইস্যুতে আরও স্পষ্ট হয়েছে। কাতার প্রশ্নেও বিষয়টি সামনে এসেছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দা ইকোনমিস্ট বলছে, এই আঞ্চলিক প্রতিপক্ষকে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি দিয়েই তারা মোকাবিলা করতে চাইছে। এর একটি কারণ, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র প্রকল্প, অন্যটি জ্বালানি তেলের বাণিজ্য। সৌদি আরব ও ইউএই এমন কোনো দ্বন্দ্বে জড়িয়ে এ বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চায় না। তাতে তারা ইরানকে ‘শিক্ষা পেতে’ দেখতে চায় এবং সে ক্ষেত্রে মিত্রের ভূমিকায় জোগানের দায়িত্বটি পালন করতে চায়। যদিও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ঠিক শুরু করতে চাইছে না। ট্যাংকার হামলার পেছনে যে-ই থাকুক উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য এটি বড় উসকানি নিঃসন্দেহে। কারণ এটি সরাসরি অর্থনীতির ওপর আঘাত। ফলে এমন ঘটনা চলতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের উপসাগরীয় মিত্ররাই মাঠে নেমে যেতে পারে। এখন পর্যন্ত উভয় পক্ষ থেকেই ‘যুদ্ধ চাই না’ ধরনের বিবৃতি দিলেও বাস্তবের ঘটনাক্রম উল্টো ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
এই সমীকরণে অতি অবশ্যই রয়েছে ইসরায়েল, যারা মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের আধিপত্য কোনোভাবেই মানতে নারাজ। এ ক্ষেত্রেও তার মিত্র ওই সৌদি আরব, মিসর, ইউএইর মতো দেশগুলো। অন্য সব কিছু বাদ দিলেও ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইরানের অবস্থান ইসরায়েলের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। শুধু এই একটি বিবেচনাতেই ইরানকে কোণঠাসা করাটা তাদের জন্য জরুরি। এ ক্ষেত্রে তারা ওয়াশিংটনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কল্যাণে বেশ কয়েকজন অকৃত্রিম বন্ধু পেয়ে গেছে। এর মধ্যে সবার ওপরে রয়েছেন জ্যারেড কুশনার ও ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন। দুজনই ঘোরতর ইরানবিরোধী। তাঁরা ইরানের শাসক পর্যায়ে পরিবর্তন চান যেকোনো মূল্যে।
আর এ সূত্রেই সামনে হাজির হচ্ছে যুদ্ধ পরিস্থিতি, যা বেঁধে গেলে শেষ পর্যন্ত সবাইকেই বড় মূল্য চোকাতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতি আরেকটি বড় ধাক্কা খাবে নিশ্চিতভাবে। এখন পর্যন্ত এর উত্তরণের কোনো পথ দেখা যাচ্ছে না। শিনজো আবে কূটনীতির পথে এগোতে চাইছিলেন। কিন্তু তাঁর সফরের সময়েই ঘটা এ হামলা ইঙ্গিত দিল, এ ধরনের প্রচেষ্টা সফল হওয়াটা কতটা কঠিন।
লেখক: সাংবাদিক
ই মেইল: fazlul.kabir@prothomalo.com