মধুপুর বনের গ্রামে ঢুকেছিলাম জোছনারাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন হলের রুমে টেপ রেকর্ডারে শুনতাম রবীন্দ্র জৈনের গান, ‘চন্দ্র–সুরুজ নিয়ে বুকে বেশ তো আছিস মনের সুখে’। মধুমতী নদীকে নিয়ে গান। এখানে এই বিদ্যুৎবিহীন গ্রামে মান্দিরাও যেন ‘চন্দ্র-সুরুজ’ বুকে নিয়ে সুখেই আছে। গাইরা গ্রামে যখন পৌঁছাই, তখন বনভূমির গ্রামে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। ছোট ছোট সোলার বাতি জ্বলছে কয়েকটি ঘরে। উঠানজুড়ে অন্ধকার। নানা ফুলের গন্ধে ভরে আছে চারপাশ। একটু পরে বনের আকাশ আলো করে চাঁদ উঠল। সে এক অপরূপ দৃশ্য। আমাদের আসার খবর শুনে আশপাশের কয়েকজন মান্দি চলে এলেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বললাম। এখানে রাতের খাবার খেয়ে যখন ফিরে আসি, তখন বনের আকাশে স্নিগ্ধ চাঁদ। কোথাও গাছের ছায়া, কোথাও আলো। মনে মনে বললাম, ভালো থেকো মান্দিরা বনের মধ্যে। মানুষের অধিকার নিয়ে বাঁচো তোমরা। এই বন রক্ষার দায়িত্ব তোমাদের।
কবি রফিক আজাদ মধুপুর বনের গ্রাম চুনিয়াকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন, ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’। আমরা পরের দিন সেই চুনিয়াকে পাশ কাটিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে চলে গেলাম জয়নাগাছা, বেদুরিয়া, সাদুপাড়া, জালাবাদা গ্রামে। মধুপুর বনের প্রায় শেষ প্রান্তে মান্দি গ্রাম। লিটন ম্রং, হেমন্ত কুবি, প্রশান্ত মানখিন, তেনজিং নকরেকদের গ্রাম। এত সুন্দর মাটির ঘর এখনো মধুপুরের মান্দিদের অনন্য বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছে। আমাদের দেখে সবাই খুশি হলেন। হেমন্তের মা কলা, পেঁপে, লেবু দিয়ে দিলেন, যেন ঢাকায় নিয়ে আসি। বললেন, এই কলা বিষমুক্ত। ভাবলাম, পৃথিবীতে কত স্নেহ-মমতাভরা মানুষ আছে এখনো। খুব সুন্দর বাড়িঘর আর গ্রাম। আবার পথের ধারে তাকিয়ে দুঃখ পেলাম বন বিভাগের অপরিণামদর্শী কর্মযজ্ঞ দেখে, প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে বাণিজ্যিক গাছের বাগান দেখে, কলা চাষ দেখে, বন ও প্রকৃতির ওপর নিষ্ঠুর অত্যাচার দেখে।
এখানে এই সব গ্রামের মান্দিদের সঙ্গে কথা হলো। মধুপুর বনের অনেক তরুণ-তরুণী শহরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। শিক্ষিত নেতৃত্ব বিকশিত হচ্ছে। অনেক মান্দি মেয়ে বিউটি পারলারসহ নানা দক্ষতার কাজে নিয়োজিত হয়েছেন। তাঁরা গ্রামে পরিবারকে সাহায্য করছেন। পীরগাছায় স্কুলে শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। স্কুলের সভাকক্ষে চা খেয়েছিলাম। প্রাইমারি স্কুলের চার শিক্ষক মেবুল দারু, মিনু সিমসাং, সবিতা দারিং, লিয়া মৃ—সবাই মান্দি এবং নারী। আর কার্তিক দালবত। মধুপুর বনে আশাভরা সব প্রাণবন্ত মানুষ। ফেরার পথে জলছত্রে জয়েনশাহী আদিবাসী পরিষদের অফিসে ঢুকি। ইউজিন নকরেক, মিথুন জাম্বিল, সজল রেমা ও অন্যরা এগিয়ে দেন রাস্তায়। হাত নেড়ে বিদায় জানাই। হয়তো আসব আবার। এখনো এই বনের ভেতর গ্রামগুলোতে কিছু মানুষ স্বপ্ন দেখেন, পাতার বাঁশি বাজিয়ে গান করেন, মাটির পরিচ্ছন্ন ঘরে আনন্দ করেন, অমলিন হাসেন, অতিথি এলে মহাসুখে আপ্যায়ন করেন, পাশে এসে বসেন, আলু, থাবুচুল, থামা, আনারস, পেঁপে ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন করেন। নতুন রান্নার কথা জানলাম, আদাপাতা দিয়ে মাংসের রান্না। বড় সুস্বাদ। কত রকম খাদ্যের আবিষ্কারক এই মানুষেরা!
মান্দিরা বাড়িতে অতিথি আসার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খেতের কাজ ফেলে ঘরে ফিরে অতিথির সঙ্গে গল্প করেন। অনেক কথার পরে তাঁরা আপনাকে রাতে থেকে যেতে বলবেন। বলবেন, ‘আজ থেকে কাল চলে যেয়ো।’ অনেক ঘর খালি। মাটির পরিপাটি ঘরে রাত কাটাতে ইচ্ছে করে। ‘মান্দি’ মানে মানুষ। পৃথিবীতে মানুষের নামে একটি জাতির নাম হয়! এই বনকে নিয়ে এদের সমস্ত জীবন ভালোবাসা-স্নেহ-মায়ায় জড়ানো। ‘খাদংআনি মান্দিরাং’ বলে কথা আছে গারোদের আচিক ভাষায়, যার বাংলা অর্থ আশাভরা মানুষের দল। ন্যাশনাল পার্ক, ইকোপার্ক, রাবার প্রকল্প, সামাজিক বনায়ন, আরও কত প্রকল্প আসে এখানে, অর্থ বরাদ্দ হয়, ব্যয় হয়। রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা করা হলো ২০১৬ সালে ৯ হাজার ১৪৫ একর, যার মধ্যে আদিবাসীদের গ্রাম রয়েছে ১৪টির বেশি। সরকার এ বিষয়ে বনের আদি অধিবাসীদের সঙ্গে আলোচনা করেনি। চূড়ান্ত রিজার্ভ ঘোষণার পর কী পরিস্থিতি হবে বনের মান্দিদের, কোচ বর্মণ ও বাঙালিদের—এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। তবু আমি এই বনের মান্দিদের মধ্যে খুব একটা ভীতি বা চাঞ্চল্য লক্ষ করিনি।
মধুপুরের বনে এই প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে এখনো কাঁচা রাস্তা অবহেলা আর উপেক্ষায় থমকে আছে। এই মান্দি, কোচ ও বর্মণরাই মধুপুরের বনকে এত কাল রক্ষা করেছে। একসময় এখানে চিরহরিৎ বৃক্ষের প্রাকৃতিক বন ছিল। মান্দিরা বলত, গ্রীমসিসি বুরুং বা গভীর বন। শালবন ছিল সারি সারি। এখনো কিছু শালবন টিকে আছে। আদি অধিবাসীদের বনের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করলে এই অবশিষ্ট বনভূমি রক্ষা পাবে।
এই মান্দিদের দৃষ্টিতে বনভূমি পবিত্র। বন তাদের জীবনের অংশ অথবা তার চেয়েও বেশি কিছু। তারা জানে, বন ধ্বংস হলে তারাও ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাবে। মান্দিদের কাছে বন ও মানুষ একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। বন শুধু অর্থনৈতিক অবলম্বন নয়। বনের সঙ্গে এই মানুষদের রয়েছে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক। মাটি বা ভূমির সঙ্গেও তাই। তাই তো আদিবাসী মানুষ ভূমির দলিল বা কাগজপত্রের নিয়ম বা সংস্কৃতি জানে না। মধুপুর বনকে মান্দি ভাষায় বলে ‘আবিমা’, অর্থাৎ মাটির মা। মাকে কি কেউ দলিল করে, রেজিস্ট্রি করে, কেনাবেচা করে? বন, ভূমি, গাছপালা, জীববৈচিত্র্য, প্রকৃতি সম্পর্কে যাদের এমন ভাবনা ও সংস্কৃতি, তাদের কেন রাষ্ট্রের ভেতর অসহায় অনিশ্চয়তায় দিন কাটবে? এই রাষ্ট্র তাদের চিন্তা বোঝে না।
বনবাসী মানুষেরা একসময় বলত, যেদিন বনের শেষ বৃক্ষ কেটে ফেলা হবে, যেদিন শেষ নদীটি শুকিয়ে যাবে, তখন মানুষ শিখবে যে সোনা-রুপা-টাকা খেয়ে জীবন বাঁচে না। মান্দিদের সংস্কৃতি, চিরায়ত জ্ঞান বা ইনডিজিনাস নলেজ কাজে লাগিয়ে এবং সম্মান করেই এই প্রাকৃতিক বন রক্ষা করার কথা আমাদের ভাবতে হবে।
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী