মতামত

মগবাজার জানাল আমরা মগের মুল্লুকেই আছি

মগবাজারে বিস্ফোরণে ধ্বসে পড়া ভবন
ছবি: প্রথম আলো

রাজবাড়ীর নূর নবী গ্রামেই ছিলেন। ঢাকায় এসে ভ্যান চালাচ্ছিলেন পরিবার বাঁচাতে। কলেজ বন্ধ বলে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মো. রাসেল ঠাকুরগাঁও থেকে এসেছেন ঢাকায়। একটু ভালো থাকতে চেয়েছেন। কাজ নিয়েছেন বেঙ্গল মিটে। ঢাকা তাঁদের ভালো থাকতে দেয়নি। ঢাকা আসলে তাঁদের বাঁচতেই দেয়নি। আমরা ঢাকাকে সেভাবেই তৈরি করে রেখেছি। ঢাকা তার পেট থেকে মাঝেমধ্যে কাউকে কাউকে উগরে ফেলে দেয়। মগবাজারের এক ভবন এক ধাক্কায় ১১ জনকে উগরে দিল ঢাকা থেকে।

ঢাকার এ এক বড় অবহেলা। তবে অবহেলা করে সব সময় পার পায় না ঢাকা। আমাদের সমগোত্রীয় কারও সঙ্গে এমন করলে আমরা তো গলা ছাড়তাম। ক্ষোভ জানাতাম। অন্তত হায় হায় করতাম! কিন্তু এই ১১ জনকে যেন নীরবে গিলে ফেলেছে ঢাকা। ঢাকার চৈতন্যে সুড়সুড়ি দেওয়ার শক্তিও এদের ছিল না। এরা সব তস্য গরিব! এতগুলো গরিব একসঙ্গে মগবাজারে গেল কেন!

হায়, বৃদ্ধ হারুনুর রশিদ! বছরের পর বছর পাহারা দিয়েছেন ভবনটি। সেই ভবনের সিঁড়ির নিচেই মরে পড়ে ছিলেন ৪৪ ঘণ্টা। মরে পড়ে ছিলেন? নাকি জীবিত ছিলেন কিছু সময়? আটকে থাকতে থাকতে মরে গেলেন না তো! কেউ জানে না। অবিশ্বাস্য! এই দীর্ঘ সময়ে কত বুট আওয়াজ তুলেছে ঘটনাস্থলে। অহংকারী বুট! শত ক্যামেরায় উজ্জ্বল হয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্তদের মুখ। কিন্তু হারুনুর রশিদ পড়ে ছিলেন বিধ্বস্ত সিঁড়ির তলায়। ‘উদ্ধার অভিযান’ নামের শব্দ দুটির কথা আমরা ভুলে থেকেছি বেমালুম। অন্তত দুদিন তো আমরা ভুলে থাকতে পেরেছি। আমরা আগেই বুঝে গেছি, ধ্বংসস্তূপের নিচে যদি কেউ থেকেও থাকে, তাতে সমস্যা নেই! এরা অবহেলার সন্তান। এদের বেঁচে থাকা এবং মরে যাওয়ার আলাদা অর্থ নেই।

গরিব মানুষ দুর্ঘটনায় মারা গেলে, আহত হলে সরকারের পক্ষে স্থানীয় প্রশাসন দাফন ও চিকিৎসার জন্য কিছু টাকা দেয়। মারা গেলে ২০ হাজার, আহত হলে ১০ হাজার টাকা। মগবাজার বিস্ফোরণে নিহত, আহত ব্যক্তিরা সেখানেও অবহেলার শিকার। ঘটনার চার দিন পর ঢাকার জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছেন, ঘটনার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে তাঁরা তিনটি লাশ পেয়েছেন। তাঁদের স্বজনদের দাফনের জন্য ২০ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে। ওই ঘটনায় মারা গেছেন ১১ জন। এঁরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আর শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে একজন–দুজন করে মরেছেন। তাঁরা প্রশাসনকে চার দিন সময় দিয়েছেন। কিন্তু কাউকে পাশে পাননি। আহত ব্যক্তিদের খবর কী?

পত্রিকায় মানবিক প্রতিবেদন হয়েছে তো! নাহ্, ঢাকার জেলা প্রশাসক বলেছেন, আহত ব্যক্তিদেরও ১০ হাজার টাকা করে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। তাঁরা বা বাকি নিহত ব্যক্তিদের পরিবার যদি আর্থিক সহযোগিতা না পেয়ে থাকে, তাহলে শিগগিরই ব্যবস্থা।

সরকারি এই ‘ব্যবস্থা’ শব্দটি এক বিষয় বটে! সব জায়গায় খেটে যায়। এরপর আরও তিন দিন চলে গেছে। নিহত ব্যক্তিরা এখন প্রশাসনের নাগালের বাইরে! আহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা সাংবাদিকদের কাছে আত্মসম্মান ভুলে অসামর্থ্যের আবরণ খুলেছেন। তাতে কী লাভ হলো! সবাই এখন ব্যবস্থার ফাঁদে আটকা।

ভ্যানচালক নূর নবীর (৩০) কথাটা বড় মনে পড়ছে। নূর নবী জ্ঞান ফিরলে হাসপাতালে স্ত্রী পপি বেগমকে বলেছিলেন, ‘ভ্যান চালিয়ে এসে তো আমি বাসায় ঘুমিয়েছি। ঘুম থেকে উঠে কখন হাসপাতালে এলাম, হাসপাতালে কী করছি?’ বিস্ফোরণের ধাক্কা নূর নবীর স্মৃতি এলোমেলো করে দিয়েছে। এলোমেলো স্মৃতি নিয়েই চলে গেলেন নূর নবী।

কিন্তু আমাদের সরকারি সংস্থাগুলো কেন এলোমেলো আচরণ করল? শহরের মাঝখানে একটা তিনতলা ভবন বিস্ফোরণে ধসে গেল, আশপাশের সাত ভবনের কাচ ভেঙে ব্যস্ত রাস্তা সয়লাব হলো। রাস্তায় থাকা তিনটি বাস চুরমার হয়ে গেল। আহত যাত্রীরা রক্তঝরা শরীর নিয়ে দিগ্‌বিদিক ছুটল। প্রাণহানি হলো। তারপর সে ভবনে কি ঠিকঠাক উদ্ধারকাজ চলল?

আনুষ্ঠানিকভাবে কী বলা হলো, এর ভেতরে আর কোনো জীবিত বা মৃত মানুষের অস্তিত্ব নেই। আমরা জানতে পারিনি। উদ্ধার প্রটোকল পুরোপুরি মানা হয়েছে, দ্বিতীয় দিনেও এটা বলা গেলে একটা স্বস্তি আসত। কিন্তু বৃদ্ধ হারুনুর রশিদের মরদেহ অবহেলার গল্পই কেবল বলে যায়।

আমরা বিস্ফোরণের কারণ জানতে চেয়েছি। সব পক্ষে গ্যাস থেকে বিস্ফোরণের ধারণা জোরালো হলেও তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ প্রথম দিনই হাত ধুয়ে ফেলেছে। আশপাশের তিন ভবনে তাদের কোনো গ্যাস–সংযোগ নেই। সাত দিন এই দাবি নিয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিধ্বস্ত ভবনে গ্যাসের লাইনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। তবে তিতাসের কাউকে আর কথা বলার জন্য পাওয়া যাচ্ছে না।

নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লা এলাকায় মসজিদে বিস্ফোরণে ৩৪ জন মারা গিয়েছিল। সে ঘটনায়ও তিতাস শুরুতে দাবি করেছিল সেখানে তাদের কোনো গ্যাস–সংযোগ নেই। কিন্তু তদন্তে বেরিয়ে এল সেখানে তিতাসের লাইন ছিল। পরিত্যক্ত হলেও সেই লাইন তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ যথাযথ প্রটোকল মেনে বন্ধ করেনি। ফলে সেখানে গ্যাস লিক করেছে। গ্যাস জমা হয়েছে মাটির নিচে, বাতাসে। তার বলি হয়েছে ৩৪টি প্রাণ। শেষে সম্পূরক অভিযোগপত্র দিয়ে অবহেলাজনিত হত্যা মামলায় তিতাসের আট কর্মকর্তাকেও আসামি করা হয়েছে।

মগবাজার বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত তিনতলা ভবনটির মালিক কে? সেই মালিকের কাছ পর্যন্ত কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পৌঁছাতে পেরেছে? আট দিন পার হয়েছে। ভবন অপসারণের জন্য রাজউক একটি কমিটি করেছে। তারাও নাকি ভবনের মালিককে খুঁজছে। এই খোঁজাখুঁজি, তদন্ত আরও কিছু সময় চলবে। মামলা, বিচারের চলমান ধারায় ভবনটিও কোনো একদিন তিনতলা থেকে নয়তলা হয়ে যাবে। মুছে যাবে ধ্বংসচিহ্ন। কিন্তু গরিব সেই পরিবারগুলোর বুকের ক্ষত মুছবে না। এই বাহ্য চাকচিক্যের শহরে কোনো দিন তাঁদের স্বজনেরা এসে হয়তো খুঁজেও পাবেন না এই ভবন। কিন্তু তাঁরা জানবেন, এই শহরের অবহেলায় তাঁদের স্বজনেরা হারিয়ে গেছেন চিরতরে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স যথার্থ বলেছে। একটি শহরকে নিরাপদ করে গড়ে তুলতে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিপর্যায়ে যে প্রচেষ্টা থাকা দরকার, তার ঘাটতি দিনকে দিন প্রকট হচ্ছে। নগর ব্যবস্থাপনা ও নগর সংস্থাগুলো সুশাসনের অভাবে ভুগছে।
সুশাসন আর শৃঙ্খলার অভাব সবার আগে মানবিক মূল্যবোধকে সংকুচিত করে। জীবনের গুরুত্ব অনুধাবনের সূচকগুলোকে ভোঁতা করে দেয়। মগবাজারে উদ্ধার তৎপরতাসহ সার্বিক অবস্থা দেখে অন্তত তা-ই মনে হচ্ছে।

* শাহেদ মুহাম্মদ আলী: সাংবাদিক