গতকালের টাটকা খবর। অঙ্ক না পারায় নবম শ্রেণির কয়েকজন ছাত্রীকে ক্লাসের বাইরে নিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকার শাস্তি দেন এক শিক্ষক। কী অমানবিক! চোখ অন্ধ করে দেওয়ার আয়োজন আরকি।
রোদের প্রচণ্ড তাপ সইতে না পেরে এক ছাত্রী গাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষক তাকে সেখান থেকে এনে আবার রোদে দাঁড় করিয়ে দেন। একপর্যায়ে মেয়েটি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এখন সে অস্বাভাবিক আচরণ করছে। বারবার মূর্ছা যাচ্ছে। জ্ঞান ফেরার পর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিকট চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে সে।
মঙ্গলবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘অঙ্ক না পারায় শাস্তি, ছাত্রী অসুস্থ’ শীর্ষক এই খবরে উল্লেখ করা হয়, সুনামগঞ্জের দোয়ারবাজার উপজেলার রাশিদ আলী মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুলে এ ঘটনা ঘটে। অভিযোগটি উঠেছে বিদ্যালয়ের গণিত বিষয়ের সহকারী শিক্ষক বিমল চন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ইউএনওর কাছে গেছে লিখিত অভিযোগ।
মা-বাবা অনেক আশা নিয়ে প্রিয় সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠান। সবারই মূল লক্ষ্য থাকে সন্তান পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হবে। সেখানে কোনো অঙ্ক না পারায় প্রখর রোদে দঁড়িয়ে থাকার শাস্তি পাবে, এটা কোনো অভিভাবকের কাম্য নয়। এমন শাস্তি প্রদান সুস্থ মানসিকতার পরিচয়ও নয়।
নবম-দশম শ্রেণির ছাত্রী মানেই কিশোরী। বয়সের ধর্ম অনুযায়ী এটা চিত্তচাঞ্চল্যের সময়। তেরো-চৌদ্দ বছর বয়সী ছেলেমেয়ে না পারে বড়দের সঙ্গে মিশতে, না পারে ছোটদের দলে ভিড়তে। অতি অল্প তুচ্ছতাচ্ছিল্যে তাদের বিরাট অভিমান হয়। সামান্য কটূক্তিও আত্মসম্মানে বড় বেশি লাগে। এ কথাটি একজন শিক্ষকের অবশ্যই মনে রাখা উচিত।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে ওই শিক্ষার্থীর অস্বাভাবিক আচরণকে মানসিক ভারসাম্য হারানোর আভাস বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তা-ই যদি হয়, তাহলে শিক্ষকের প্রকাশ্যে অপদস্থ করার ঘটানায় কী পরিমাণ মানসিক আঘাত সে পেয়েছে! আর প্রখর রোদে ওভাবে দাঁড় করিয়ে অমানুষের মতো শাস্তি তো মানুষ চোরকেও দেয় না।
একটা শ্রেণিকক্ষে সব শিক্ষার্থী একই মেধার অধিকারী নয়। বরং মেধার বিচারে সেরা থাকে হাতে গোনা কয়েকজন। কিছু শিক্ষার্থী থাকে অমনোযোগী, পড়াশোনায় অনাগ্রহ থাকে তাদের। এর মধ্যে কিছু অভিভাবকের ঠেলাধাক্কায় পড়ে, কিছু আবার শত গুঁতোনাতায়ও অনড় থাকে পড়বেই না। এরা হলো নিম্ন সারির শিক্ষার্থী।
আবার মাঝারি গোছের কিছু শিক্ষার্থী বই নিয়ে সারাক্ষণ উপুড় হয়ে থেকেও আশানুরূপ ফল আনতে পারে না। এরা ভোঁতা টাইপের। মাঝারি গোছের কিছু শিক্ষার্থী আবার অল্প পড়েই সুবিধাজনক ফল করে ফেলে। আর মেধার বিচারে একদম ওপরের সারিতে যারা, তারা মেধায়ও তীক্ষ্ণ, পড়াশোনায়ও তুখোড়। সব সময় সেরা ফলটিই নিয়ে আসে তারা।
বাস্তব অভিজ্ঞতায় একটা বিষয় লক্ষ করেছি যে আমাদের দেশের গড়পড়তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বরাবরই মেধাবী ও ভালো ফল করা শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকের নজর থাকে বেশি। তা থাকুক, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক বিষয় হলো, খারাপ ফল করা শিক্ষার্থীদের প্রতি আশানুরূপ মনোযোগী না হওয়া। রাজধানীই বলি আর মফস্বলই বলি, সিংহভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণিকক্ষে ফলাফলে নিচের দিকে থাকা শিক্ষার্থীরা থাকে অবহেলিত।
বিশেষ করে শিশু শিক্ষার্থীদের বেলায় এটা বেশি হয়ে থাকে। হয়তো সে পড়াশোনায় অত ভালো নয়, কিন্তু তার অন্য কোনো প্রতিভা আছে কিংবা আছে বিশেষ কোনো চারিত্রিক গুণ, তা কিন্তু বড়রা কেউ গোনার মধ্যে ধরে না। সেই শিশুকে বাড়িতে যেমন মা-বাবার কাছে হরদম বকা খেতে হয়, তেমনি বিদ্যালয়েও শিক্ষকের কাছ থেকে পায় তীব্র ভর্ৎসনা। এভাবে কোনো শিশুর ব্যতিক্রমী কোনো প্রতিভা অঙ্কুরেই শেষ হয়ে যেতে পারে।
স্কুল পর্যায়ের কোনো শিক্ষার্থীর পড়াশোনায় কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না নিয়ে আসার পেছনে ১০১টা কারণ থাকতে পারে। তা অনুসন্ধান করা মূল দায়িত্ব শিক্ষকেরই। তিনি ধৈর্যের সঙ্গে তা খুঁজে বের করবেন এবং কীভাবে ওই শিক্ষার্থীর সমস্যা কাটানো যায়, এ ব্যাপারে জুতসই সমাধান দেবেন। ডান্ডা মেরে তাকে দমানো যাবে, শারীরিকভাবে পর্যুদস্ত করা যাবে, কিন্তু তার ভেতর গ্যাঁট হয়ে থাকা সমস্যার সমাধান হবে না। আর প্রখর রোদে দাঁড় করিয়ে অমানবিক শাস্তি দিলে এর ফল যে কী হয়, এর প্রমাণ তো পাওয়া গেছে হাতেনাতে।
কিশোর বয়সী যেকোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গে আচরণে অবশ্যই শিক্ষকের সতর্ক হওয়া উচিত। কারণ, এ সময়ই মূলত শিশুদের ব্যক্তিত্ব ডানা মেলতে থাকে। দমে দমে আবেগে ভাসে তারা। একটুখানি ভুলের মাশুল হতে পারে পাহাড়সম।
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী অরিত্রি অধিকারীর কথা মনে নেই? এক বছরও পেরোয়নি সে ঘটনা। গত ডিসেম্বরে নিজ বাসায় সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে অরিত্রি। রেখে যায় স্কুলশিক্ষকের কাছে নির্মমভাবে অপমানিত হওয়ার বিশাল অভিযোগ।
সুনামগঞ্জের সেই স্কুলের বিমল চন্দ্র হয়তো অরিত্রির এ ঘটনার কথা জানেন না। আর জানলেও মাথায় নেই কিংবা কেয়ার করেন না। অথচ এসব বিষয়ই মাথায় বেশি রাখা উচিত।
পড়া না পারলে একজন শিক্ষার্থীকে শিক্ষক অনায়াসে শাস্তি দিতে পারেন। কারণ, ক্লাস চলাকালে শিক্ষার্থীরা পুরোপুরি থাকে শিক্ষকের জিম্মায়। তিনি ক্লাসে পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়েই নিজের মতো করে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। কাজেই তিনি কী পড়াচ্ছেন, ওই সময় তা দেখার কেউ থাকে না। আর শাস্তি দিলেও বাধা দেওয়ার কেউ নেই। কিন্তু এর ফলাফলটা যে কী হবে, তা অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার। কারণ, সারা দুনিয়ায় একজন শিক্ষককেই সবচেয়ে বেশি বিবেকবান আর আদর্শের প্রতিভূ বলে ধরা হয়ে থাকে।
শিক্ষকতা হচ্ছে এমন এক মহান পেশা, তাঁরা সারা জীবন শিক্ষার্থীদের অকাতরে জ্ঞান বিলিয়েই যান, বিনিময়ে কিছু পান না। মা-বাবার তবু সন্তানের কাছে একটা সময় প্রতিদান পাওয়ার সুযোগ আসে, কিন্তু শিক্ষকেরা প্রায় সবাই যে সুযোগ থেকে বঞ্চিত। শিক্ষাজীবন শেষে শিক্ষার্থীরা কে কোথায় চলে যায়, এর কোনো ঠিকঠিকানা নেই। শিক্ষকদের এই নিঃশেষে দান অমূল্য। এর মধ্যে যে আত্মতৃপ্তি, তা অতুলনীয়। তবে একই সঙ্গে শিক্ষকদের এ কথাও মনে রাখতে হবে, তিনি নিজে কী দিচ্ছেন। আপন আয়নার দিকে তাকিয়ে তাঁকে অবশ্যই দেখতে হবে—তাঁর আত্মার ভেতর হিংস্র পশু বাস করে কি না।
শরিফুল ইসলাম ভূইয়া: প্রথম আলোর সহকারী বার্তা সম্পাদক ও সাহিত্যিক
shariful.bhuiyan@prothomalo.com