পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান নিজেদের সব মুখোশ খুলে এমন এক ঝুঁকিপূর্ণ খেলায় মেতে উঠেছে যে তা গোটা অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে জটিল প্যাঁচের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ক্রমে সেই জটিলতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ২০১৮ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র যখন ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে করা পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার এবং আগের সব নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করার ঘোষণা দিল, মূলত তখনই এই অস্থির অবস্থার সৃষ্টি হয়। ইরানের ওপর ‘সর্বোচ্চ চাপ’ প্রয়োগ করার অংশ হিসেবে তখন থেকেই ওয়াশিংটন তেহরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কয়েক গুণ বাড়িয়েছে। নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ইরানের সঙ্গে বাকি বিশ্বের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করা, তাদের তেল বিক্রয়লব্ধ রাজস্ব আয় কমানো এবং সর্বোপরি নানান কায়দায় ইরানের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নামানোই যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের বিশাল অর্থনৈতিক আঘাতের জবাবে সমান শক্তির আঘাত করার ক্ষমতা যেহেতু ইরানের নেই, সেহেতু ইরানকে সৃজনশীল কৌশল বেছে নিতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের এই দ্বন্দ্বের প্রথম ধাক্কাটা লেগেছে ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ আমেরিকার ইউরোপীয় মিত্রদের ওপর। ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে জয়েন্ট কম্প্রিহেন্সিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) নামে পারমাণবিক–সংক্রান্ত যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে তারাও সই করেছে। তারা বলছে, যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চুক্তিতে সই করার মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য বেড়েছিল। ইরানও চুক্তির শর্ত মেনে পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে চুক্তি থেকে বের হওয়ায় ইরানের শর্তের বাঁধন অনেকটাই শিথিল হয়ে গেছে। এতে ইউরোপীয় দেশগুলোর যেসব সুবিধা পাওয়ার কথা, সেসব সুবিধা অনেকটাই খর্ব হবে।
যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলেও ইরান এখনো বের হয়নি। তবে চুক্তিতে যেসব বিধিনিষেধ মেনে চলার কথা, সে বিষয়ে তারা শৈথিল্য দেখাচ্ছে। যেমন, চুক্তিতে পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম সর্বোচ্চ যে মাত্রায় চালানোর কথা ছিল, ইরান এখন তার চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ করছে। ইরানের এই অধিক মাত্রার সমৃদ্ধকরণ নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন তেমন একটা গা করছে না, কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন এটি নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়েছে।
পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণের গতি বাড়ানো ছাড়াও ইরান এখন পারস্য উপসাগর এবং আরব উপদ্বীপে কৌশলগত যুদ্ধ শুরু করেছে। গত কয়েক মাসে ইরান এই অঞ্চল থেকে বেশ কয়েকটি বিদেশি তেলবাহী জাহাজকে জব্দ করেছে। তারা হরমুজ প্রণালিতে নজরদারি করা একটি মার্কিন সামরিক ড্রোন ভূপাতিত করেছে। তেল ও অন্যান্য পণ্যবাহী জাহাজের অন্যতম প্রধান এই যাত্রাপথের আশপাশে সম্প্রতি কয়েকটি কয়েকটি দুর্ঘটনাজনিত জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে। মনে করা হচ্ছে এগুলো অন্তর্ঘাত। এর পেছনে ইরানের হাত রয়েছে। সম্প্রতি সৌদি আরবের দুটি তেলক্ষেত্রে হামলার ঘটনা ঘটেছে। ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা এই হামলার দায় স্বীকার করলেও ব্যাপকভাবে মনে করা হচ্ছে এই হামলার নেপথ্যে ইরানের হাত আছে।
এসব ঘটনার সঙ্গে ইরানের যোগসাজশ থাকা-না থাকা এখন বড় কথা নয়। যে বিষয়টি এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ঘোষণা করেছেন, ‘ইরানকে যদি তার তেল বিক্রিতে বাধা দেওয়া হয়, তাহলে পারস্য উপসাগর থেকে এক ফোঁটা তেলও রপ্তানি হতে দেওয়া হবে না।’
এ কথা অবশ্যই সত্য যে ইরানের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি অনেক বেশি। কিন্তু ট্রাম্প এখন আর কোনোভাবেই মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধে জড়াতে চাইবেন না। বিশেষ করে সেখানে আবার লাখ লাখ মার্কিন সেনা মোতায়েন করা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এখন প্রায় অসম্ভব। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ইরানের ব্যাপক ক্ষতি করবে সন্দেহ নেই, তবে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বাইরে এখন যুক্তরাষ্ট্রের আসলে তেমন কিছুই করার নেই।
এই নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকেও অনেক ক্ষতি স্বীকার করে নিতে হবে। একতরফাভাবে যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় ইউরোপীয় মিত্ররাসহ বাকি বিশ্বের কাছে তার অঙ্গীকারনিষ্ঠতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তার কারণেই জেসিপিওএর শর্ত মানার বিষয়ে ইরানের বাধ্যবাধকতার সুযোগ কমে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি অস্বীকার করে ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ বাড়ানোর ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
সৌদির তেলক্ষেত্রে হামলার পরপরই ট্রাম্প সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। ইরানও যেকোনো ধরনের হামলা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। এখনই তাদের মধ্যে সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা হয়তো নেই, কিন্তু তাদের কারণে উপসাগরীয় এলাকায় একটা অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়েছে। ওয়াশিংটন ও তেহরান যখন কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে একে অপরকে শায়েস্তা করার পথ খুঁজছে, ঠিক তখন সৌদি আরব ও ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। ইরানের বিরুদ্ধে এই দেশ দুটি আগেও তৎপর ছিল, তবে এখন সে তৎপরতা বহুগুণ বেড়ে গেছে।
জেসিপিওএতে স্বাক্ষরকারী সবগুলো ইউরোপীয় দেশ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আঞ্চলিক অংশীদার দেশ এই উত্তেজনার অবসান চাইছে। এ লক্ষ্যে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সরাসরি সংলাপ আয়োজনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য এবং ইইউ সবাই গত জুলাইয়ের ভিয়েনা সম্মেলনে এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছে। তবে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি আলাপ–আলোচনা হতে হলে ইরানের প্রতিবেশী দেশগুলোর সহযোগিতা দরকার।
সম্প্রতি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য ইরানকে দেড় হাজার কোটি ডলার অনুদান দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। নানা কারণে এ ধরনের প্রস্তাব খুবই আশাজাগানিয়া। তবে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ক্রমে এমনভাবে বিষিয়ে উঠছে যে এখনই কূটনৈতিকভাবে এর সমাধান করা না গেলে তা উপসাগরীয় অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি উত্তেজনার সৃষ্টি করবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ফোলকের পার্থেস বার্লিনে অবস্থিত জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের রাজনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান