বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১০ বার জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুটি ছিল একতরফা: বিএনপি সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোট সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। এ ছাড়া ১৯৮৮ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অধিকাংশ দল অংশ নেয়নি। বাকি নির্বাচনগুলো মোটামুটি প্রতিযোগিতামূলক হয়েছে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে চারটি নির্বাচন। এ নির্বাচনগুলো ছিল যথাক্রমে: বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচন, বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০০১ সালের নির্বাচন এবং ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন।
এই নির্বাচনগুলোর কোনটাতে কারা জিতেছিল? এগুলো থেকে কোনো প্রবণতা কি খুঁজে পাওয়া যায়? এ ধরনের বিশ্লেষণ ভোট ও জোটের রাজনীতিতে নিয়োজিত রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হতে পারে।
বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন থেকে শুরু করে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন পর্যন্ত চারটি নির্বাচনের প্রতিবারই ২৭টি আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছিল। আসনগুলো হলো: দিনাজপুর-৫, সিরাজগঞ্জ-১, নড়াইল-২, বাগেরহাট-১, বাগেরহাট-৩, খুলনা-১, পটুয়াখালী-৩, পটুয়াখালী-৪, টাঙ্গাইল-১, জামালপুর-৩, ময়মনসিংহ-১০, কিশোরগঞ্জ-৫, গাজীপুর-১, ফরিদপুর-১, গোপালগঞ্জ-১, গোপালগঞ্জ-২, গোপালগঞ্জ-৩, মাদারীপুর-১, মাদারীপুর-২, মাদারীপুর-৩, শরীয়তপুর-২, শরীয়তপুর-৩, সুনামগঞ্জ-৩, মৌলভীবাজার-৪, হবিগঞ্জ-২, হবিগঞ্জ-৪ ও পার্বত্য বান্দরবান। লক্ষণীয় যে এ আসনগুলোর এক-তৃতীয়াংশই বৃহত্তর ফরিদপুরে অবস্থিত। আর অর্ধেকের বেশি (১৫টি) ফরিদপুরসহ দক্ষিণবঙ্গে অবস্থিত। উল্লেখ্য, এই আসনগুলোতে ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ জিতেছিল।
অন্যদিকে ওই চারটি নির্বাচনের প্রতিবারই বিএনপি জয়ী হয়েছিল ১৮টি আসনে। সেই আসনগুলো হলো: জয়পুরহাট-১, জয়পুরহাট-২, বগুড়া-৩, বগুড়া-৪, বগুড়া-৬, বগুড়া-৭, খুলনা-২, বরিশাল-৫, কুমিল্লা-২, চাঁদপুর-৪, ফেনী-১, ফেনী-৩, নোয়াখালী-১, নোয়াখালী-২, নোয়াখালী-৩, লক্ষ্মীপুর-১, লক্ষ্মীপুর-২ ও লক্ষ্মীপুর-৩। প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ৩০টি আসনে জয়ী হয়েছিল, যা ছিল তাদের জন্য ইতিহাসের সর্বনিম্ন। ওই নির্বাচনে বিএনপি ঢাকা ও সিলেট বিভাগের যথাক্রমে ৯৪ ও ১৯টি আসনের মধ্যে ১টিতেও জিততে পারেনি। লক্ষণীয় যে বিএনপির এই ভরাডুবি সত্ত্বেও তারা আওয়ামী লীগ থেকে মাত্র আটটি কম আসনে একটানা জিতেছিল। আরও লক্ষণীয় যে বিএনপির এ জয়গুলো এসেছিল মূলত বৃহত্তর বগুড়া, বৃহত্তর কুমিল্লা ও বৃহত্তর নোয়াখালী থেকে।
একই সময়ে জাতীয় পার্টি সাতটি আসনে একটানা জিতেছিল। এ আসনগুলো হলো: লালমনিরহাট-২, রংপুর-১, রংপুর-২, রংপুর-৩, কুড়িগ্রাম-১, কুড়িগ্রাম-২ ও গাইবান্ধা-৩। লক্ষণীয় যে জাতীয় পার্টির একটানা জেতা আসনের সব কটিই বৃহত্তর রংপুরে অবস্থিত।
আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর তুলনামূলক শক্তি নিরূপণের জন্য বাংলাদেশের ঐতিহাসিক নির্বাচনী ফলাফলের আরও বিশ্লেষণ প্রয়োজন। বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ২৭টি আসনে একটানা চারবার জেতার বাইরেও আওয়ামী লীগ ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত একটানা তিনবার আরও তিনটি আসনে জয়ী হয়েছিল। আসনগুলো হলো: নড়াইল-১, ফরিদপুর-৫ ও চট্টগ্রাম-৪। প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে সীমানা নির্ধারণের সময় ফরিদপুর-৫ আসনটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
একই সময়ে ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিএনপি ৫৪টি আসনে একটানা তিনবার জয়ী হয়েছিল। আসনগুলো হলো: পঞ্চগড়-১, বগুড়া-১, বগুড়া-৫, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২, নওগাঁ-৩, নওগাঁ-৬, রাজশাহী-১, রাজশাহী-২, রাজশাহী-৫, নাটোর-১, সিরাজগঞ্জ-৩, কুষ্টিয়া-১, কুষ্টিয়া-২, কুষ্টিয়া-৩, চুয়াডাঙ্গা-১, ঝিনাইদহ-২, ঝিনাইদহ-৩, ঝিনাইদহ-৪, বরিশাল-৩, টাঙ্গাইল-৩, টাঙ্গাইল-৬, ময়মনসিংহ-৫, কিশোরগঞ্জ-৬, মানিকগঞ্জ-১, মানিকগঞ্জ-৩, মুন্সিগঞ্জ-১, মুন্সিগঞ্জ-২, মুন্সিগঞ্জ-৩, মুন্সিগঞ্জ-৪, ঢাকা-১, ঢাকা-২, ঢাকা-৩, ঢাকা-৭, ঢাকা-১২, ঢাকা-১৩, নরসিংদী-১, নরসিংদী-২, নরসিংদী-৩, নারায়ণগঞ্জ-৩, ফরিদপুর-৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩, কুমিল্লা-১, কুমিল্লা-৪, কুমিল্লা-৮, চাঁদপুর-৩, চাঁদপুর-৬, নোয়াখালী-৪, চট্টগ্রাম-১, চট্টগ্রাম-৫, চট্টগ্রাম-৮, চট্টগ্রাম-১০, চট্টগ্রাম-১১ ও চট্টগ্রাম-১৩। প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে সীমানা পুনর্নির্ধারণের সময় মুন্সিগঞ্জ-৪ ও চাঁদপুর-৬ আসন দুটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
জাতীয় পার্টি এই সময়ে ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত একটানা তিনবার ছয়টি আসনে জয়ী হয়েছিল। এ আসনগুলো হলো: রংপুর-৪, রংপুর-৫, রংপুর-৬, কুড়িগ্রাম-৪, গাইবান্ধা-৫ ও পিরোজপুর-২। লক্ষণীয়, একটানা তিনবার জয়ী হওয়ার ক্ষেত্রেও জাতীয় পার্টির প্রাধান্য বৃহত্তর রংপুরে ছয়টি আসনের মধ্যে মাত্র একটি, পিরোজপুর-২, বৃহত্তর রংপুরের বাইরে অবস্থিত।
প্রসঙ্গত, ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একটি আসনে তিনবার একটানা জিতেছিল, আসনটি ছিল সাতক্ষীরা-২। জামায়াত ১৯৯১ সালে ১৮টিতে, ১৯৯৬ সালে ৩টিতে, ২০০১ সালে ১৭টিতে এবং ২০০৮ সালে মাত্র ২টি আসনে জয়ী হয়েছিল। প্রসঙ্গত, ২০০১ ও ২০০৮ সালে জামায়াত চারদলীয় জোটের অংশ হিসেবে বিএনপির সঙ্গে যৌথভাবে নির্বাচন করেছিল।
ঐতিহাসিক নির্বাচনী ফলাফল থেকে এটি সুস্পষ্ট যে আওয়ামী লীগ ৩০টি (২৭+৩) আসনে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থান অর্জন করেছিল জাতীয় পার্টি ও মহাজোটের অন্য সহযোগীদের সমর্থনে।
আওয়ামী লীগের এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থান বহুলাংশে গোপালগঞ্জসহ দক্ষিণবঙ্গে। পক্ষান্তরে বিএনপি প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ৭২টি (১৮+৫৪) আসনে। তবে ২০০১ ও ২০০৮ সালে তাদের শক্তি জুগিয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য। তাদের এ শক্তি তথা জনসমর্থন অবশ্য অনেক বেশি জেলায় বিস্তৃত।
ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি, গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য ও জাসদের (জাসদ-রব) সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সৃষ্টির পর এটি প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় যে জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোটের অংশ হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। তাই যদি হয়, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সম্মিলিতভাবে টানা চারবার জেতা আসনের সংখ্যা হয় ৩৪টি (২৭+৭)। এ দুটি দল ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত টানা তিনবার জিতেছে ৯টি (৩+৬) আসনে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি আবারও জোটবদ্ধ হলে তারা মোট ৪৩টি (৩৪+৯) আসনে জনসমর্থনের দিক থেকে শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে।
আরও একটি বিষয় স্পষ্ট, বিএনপি ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিলেও তারা ২০-দলীয় জোটের অংশ হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেই থাকছে, যদিও দলটির নিবন্ধন নেই। এর ফলে বিএনপির শক্তি মাত্র একটি আসনে বাড়বে। তবে অন্যান্য আসনে জামায়াতের ভোট দ্বারা তারা উপকৃত হবে বলেই
মনে হয়।
উল্লিখিত বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট যে ১৯৯১ থেকে শুরু করে ২০০৮ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগ একটানা চারবার বিএনপির তুলনায় বেশি আসনে জিতেছে। জাতীয় পার্টির আসন যোগ করলে আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টির একটানা চারবার জেতা আসনের সংখ্যা দাঁড়ায় বিএনপির প্রায় দ্বিগুণ—৩৪ বনাম ১৮। কিন্তু এর সঙ্গে একটানা তিনবার জেতা আসনের সংখ্যা যোগ করলে বিএনপি ও তার মিত্রদের আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী মনে হয়—তাদের তুলনামূলক আসনসংখ্যা দাঁড়ায় যথাক্রমে ৭৪ ও ৪৩।
তবে অতীতের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি আগামী নির্বাচনে হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ, গত ১০ বছরে নদীতে অনেক জল গড়িয়েছে এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটেছে। ব্যাপক জনসমর্থন সত্ত্বেও বিএনপি এখন চরম নেতৃত্ব-সংকটে ভুগছে এবং গত ১০ বছরের মামলা ও গ্রেপ্তারের কারণে তারা ক্ষমতাসীনদের তুলনায় অনেকটা দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। তাই বর্তমানের বিরূপ পরিস্থিতিতে ব্যাপক জনসমর্থন কতটুকু তাদের পক্ষে নির্বাচনী ফলাফলে রূপান্তর করা সম্ভব, তা এখনই বলা কঠিন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)–এর সম্পাদক