৩০ ডিসেম্বর কী ঘটেছিল, কর্তাব্যক্তিরা একটু একটু করে তার স্বীকারোক্তি দিতে শুরু করেছেন। এসব স্বীকারোক্তির মধ্যে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের বাক্স ভরা হয়েছে আগের রাতেই। এসব কথা আগে ছিল অভিযোগ এবং অভিযোগকারীরা ছিলেন হয় বিরোধীদলীয়, নয়তো স্বতন্ত্র প্রার্থী। তার সঙ্গে ছিল বিবিসির মতো বিদেশি সংবাদমাধ্যমসহ সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতার বিবরণ। কিন্তু এখন যোগ হয়েছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ স্বীকারোক্তি এবং তা আসছে ক্ষমতাসীন জোটের ছোট শরিক এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান—নির্বাচন কমিশনের ভাষ্যে।
আগের রাতে ভোট হয়ে যাওয়ার বিষয়ে এসব স্বীকারোক্তি সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সন্দেহ নেই। কিন্তু তার চেয়েও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে নির্বাচনে অদৃশ্য শক্তির প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ। এ ক্ষেত্রে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা এবং সাবেক মন্ত্রী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। রাশেদ খান মেননের বক্তব্যটি রাজনীতিকদের আর দশটা মেঠো বক্তব্য নয়। তিনি একাদশ জাতীয় সংসদের উদ্বোধনী অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনায় বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তাঁর কথায় দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় অশুভ শক্তির প্রভাবের কথা এসেছে। তিনি বলেছেন, যদি রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশ দেশের ওপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, তাহলে রাজনৈতিক দল কেবল নির্বাচন নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায়ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। এটা যেমন আমাদের জন্য প্রযোজ্য, সরকারি দলের জন্যও তা প্রযোজ্য। নির্বাচনকে তাই যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে হবে (নির্বাচনকে যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে হবে: মেনন, সমকাল, ৪ মার্চ ২০১৯)। এর আগে জোটের আরেক শরিক বাংলাদেশ জাসদও রাতের বেলায় ভোট হওয়ার কথা বলে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করায় ‘অতি উৎসাহীদের’ দায়ী করেছিল।
এই একই সপ্তাহে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদা এবং অন্য কমিশনাররা একটু একটু করে মুখ খুলেছেন। প্রথমে মুখ খুলেছিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তিনি বলেছেন যে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেই সুষ্ঠু হয় না। এরপর প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদা বললেন যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নির্বাচন যথাযথভাবে হয়নি। তারপর আরেকজন কমিশনার শাহাদাত হোসেন বললেন যে উপজেলা নির্বাচনে আগের রাতে ভোট চলবে না। এর এক দিন পরই প্রধান নির্বাচন কমিশনার বললেন, ‘আগামীতে ভোটে ইভিএম শুরু করে দেব, তাহলে সেখানে আর রাতে বাক্স ভর্তি করার সুযোগ থাকবে না’ (ইভিএম হলে রাতে ব্যালট বাক্স ভরবে না: সিইসি, বিডিনিউজ.কম, ৮ মার্চ ২০১৯)। স্পষ্টতই এসব কথায় আগের নির্বাচনে রাতের বেলায় ভোটের বাক্স ভরার বিষয়টির পরোক্ষ স্বীকারোক্তি মেলে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার রাতের বেলায় ভোটের বাক্স ভরা বন্ধের উপায় হিসেবে ইভিএমকে কেন বেছে নিতে চাইছেন, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। ভোটার তথ্যভান্ডার এবং ভোট মেশিন—দুটোই হ্যাকিং বা দূরনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় অদৃশ্য হাতে বেআইনিভাবে প্রভাবিত করার যেসব ঝুঁকির কথা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, তা অস্বীকার করার যুক্তিটা খুবই দুর্বল ও ঠুনকো। কেননা, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে যে ছয়টি আসনে ইভিএম ব্যবহৃত হয়েছে, সেই ইভিএমে সমস্যার কথা তিনি এর আগেই স্বীকার করেছেন। তাহলে কি তিনি প্রযুক্তির সাহায্যে কারসাজির ব্যবস্থা করে দিতে চাইছেন? নাকি বড় ধরনের বিলাসী কেনাকাটার যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা করছেন?
তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কথায় এর চেয়েও উদ্বেগজনক অংশ রয়েছে। ভোটে অনিয়মের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘কারা সে জন্য দায়ী, তাদেরকে কী করা যাবে… সেই দীক্ষা-শিক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা–যোগ্যতা আমাদের কমিশনের নেই এবং সেভাবে বলারও সুযোগ নেই যে কী কারণে হচ্ছে, কাদের কারণে হচ্ছে, কারা দায়ী।’ সংবিধানে নির্বাচন–সম্পর্কিত সব বিষয়ে কমিশনকে ব্যাপকভাবে ক্ষমতায়িত করার পরও তিনি যদি অনিয়মের জন্য কারা দায়ী, তা বলতে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারেন, তাহলে তা স্বাভাবিকভাবেই অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়।
জীবনের ভয়ে নির্বাচন কমিশনারদের দেশ ছেড়ে পালানোর সাম্প্রতিকতম একটি দৃষ্টান্তের কথা এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যায়। মালদ্বীপের কর্তৃত্ববাদী প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন নানা ধরনের দমন-পীড়ন এবং বাধা তৈরির পরও যখন নির্বাচনে বিরোধীদের কাছে হেরে গেলেন, তখন ফল পাল্টে দেওয়ার জন্য তিনি কমিশনের সদস্যদের ওপর যে ধরনের চাপ প্রয়োগ করেন, তাতে প্রাণভয়ে চারজন কমিশনার পালিয়ে শ্রীলঙ্কায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন (ফোর মালদ্বিভস ইলেকশন অফিশিয়ালস ফ্লি টু শ্রীলঙ্কা, সাইটিং থ্রেটস। রয়টার্স, ১৩ অক্টোবর ২০১৮)। যে প্রেসিডেন্ট সৈন্য পাঠিয়ে প্রধান বিচারপতিকে গ্রেপ্তার করিয়ে জেলে ভরতে পারেন, সেই শাসকের চাপে তাঁদের পালিয়ে যাওয়ারই কথা। তবে তাঁরা কিন্তু জনরায়ের পবিত্রতা অক্ষুণ্ন রাখতেই সেটি করেছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের কমিশন এখন কেন অক্ষমতা ও অযোগ্যতার কথা বলছে? আর এই অযোগ্যতার স্বীকারোক্তির পর তাদের দায়িত্বে থাকার বিষয়টিই তো প্রশ্নের মুখে পড়ে।
আমেরিকার বিচারব্যবস্থায় ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে বিষাক্ত গাছের ফলকেও বিষ (ফ্রুট অব দ্য পয়জনাস ট্রি) বলে গণ্য করা হয়। সামাজিকভাবেও এর স্বীকৃতি রয়েছে। যে কারণে বলা হয় ঘুষ-চুরির টাকায় দান-খয়রাত করলেও পুণ্য অর্জন হয় না। তাহলে রাতের বেলায় বাক্স ভর্তিসহ নানা ধরনের অনিয়মে দূষিত ভোটের ফল কোন যুক্তিতে স্বীকৃতি পায়? যেসব অনিয়মের কথা একটু একটু করে স্বীকার করা হচ্ছে, সেগুলোর বিষয়ে দেশের ভেতরে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে তদন্তের যে দাবি উঠেছিল, সেদিকে কেন নজর দেওয়া হবে না?
কমিশন এখন উপজেলা নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার চেষ্টায় বেশ জোরেশোরে হুংকার দিচ্ছে। কয়েকজন সাংসদকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে, তিনটি উপজেলায় ভোটের পরিবেশ না থাকায় নির্বাচন স্থগিত করেছে। কিন্তু নির্বাচনী ব্যবস্থার সর্বনাশ সাধনের পর তাদের এসব নাটকীয়তায় কোনো কাজ হবে বলে মনে হয় না। দেশের ৪৮১টি উপজেলার মধ্যে ইতিমধ্যেই ৯৬টিতে (প্রতি পাঁচটির একটিতে) চেয়ারম্যান পদে ভোটের প্রয়োজন পড়ছে না। এই বাস্তবতায় বাম জোটের অবস্থানকে অযৌক্তিক বলার উপায় আছে কি? ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর জোটটি এক বিবৃতিতে জনগণের ট্যাক্সের টাকা অপচয় করে নির্বাচনের নামে ‘তামাশা’ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, ভোটের নামে জনগণের সঙ্গে এই প্রতারণা বন্ধ করতে হবে (ভোটের নামে ‘তামাশা’ বন্ধ চায় বাম জোট, সমকাল, ২ মার্চ ২০১৯)।
বাংলাদেশ জাসদের ভাষায় ‘অতি উৎসাহী’, কিংবা সাবেক মন্ত্রী মেননের কথায় ‘অশুভ শক্তি’, কিন্তু ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ’ কারা তা তাঁরা কেউই স্পষ্ট করে বলেননি। অথচ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অক্ষম। এ রকম অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের প্রতীকে নির্বাচন করা মেনন দেশে গণতান্ত্রিক স্পেস না থাকার অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেছেন, যদি গণতান্ত্রিক স্পেস না থাকে, তাহলে কেউ সংগঠন নিয়ে, আন্দোলন নিয়ে, ভোট নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে না। গণতন্ত্রের এই স্পেস ধ্বংস করার দায় তাঁরা কেন অস্বীকার করছেন, সেই প্রশ্নের অবশ্য কোনো জবাব নেই। সেই জবাবদিহি ছাড়া গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের আলোচনাকে রাজনৈতিক কৌশল ছাড়া ভিন্ন কিছু ভাবার অবকাশ কই।
জাতীয় পরিসরে নির্বাচনব্যবস্থায় এই দূষণের ছায়া এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনেও পড়তে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কয়েক দিন আগে সাংবাদিক সোহরাব হাসান আশাবাদ প্রকাশ করে লিখেছিলেন, ‘হুদা কমিশন নেই এটাই ডাকসুর ভরসা।’ কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন যে বহুদিন ধরেই ক্ষমতাসীন দলের সহযোগীর ভূমিকা পালন করে আসছে—সে কথাটি হয়তো তিনি বিস্মৃত হয়েছেন। যে উপাচার্য ছাত্রবিক্ষোভের মুখে নিরাপত্তার জন্য পুলিশের বদলে ছাত্রলীগের শরণাপন্ন হন, তাঁর কাছে প্রত্যাশাটা একটু বেশিই হয়ে গেছে। ছাত্রলীগের উপর্যুপরি আচরণবিধি লঙ্ঘন এবং প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী নির্দলীয় সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্রার্থীদের প্রচারে হয়রানির ঘটনাগুলোতে তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। আজকের ভোটে যদি ব্যতিক্রমী কিছু হয়, তাহলে তার কৃতিত্ব ছাত্রদেরই।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক