মতামত

ভোটার দিবস ও প্রজাতন্ত্রের মালিকদের ভোটের অধিকার

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ৫০ বছর পেরিয়েছে। কিন্তু শক্ত ভিত্তি পায়নি এ দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক হয়নি নির্বাচনী সংস্কৃতি
ছবি : প্রথম আলো

বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভোট উৎসব। এ দেশের মানুষ ভোটের মাধ্যমে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বদল করেছে, তা সেই ’৪৬-এর নির্বাচন হোক, ’৭০-এর নির্বাচন হোক। আবার স্বাধীনতা-উত্তর যেসব গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই ভোট ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে কেন্দ্র করে ঘটেছে। কিন্তু যে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের যে এত সংগ্রাম, এত আত্মত্যাগ, সেখানেই বারবার বঞ্চিত হওয়াটা যেন নিয়তিতে পরিণত হয়েছে।

২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পিউ রিসার্চ উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতির ৩৩টি দেশের মানুষের রাজনৈতিক সক্রিয়তা নিয়ে একটি জরিপ চালায়। তাতে দেখা যায়, সেসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষই রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। দেশের ৬৫ ভাগ মানুষ রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে সক্রিয়ভাবে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। মধ্যম সারির অংশগ্রহণ ২৯ এবং কম অংশগ্রহণ করে ৫ শতাংশ মানুষ। এ জরিপের ফলাফল বলছে, এ দেশের ৯৯ ভাগ মানুষই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোনো না কোনোভাবে সক্রিয়।

পিউ রিসার্চের জরিপের ফল অনুযায়ী, বাংলাদেশের ভোটারদের ৭৮ শতাংশ নির্বাচনে ভোট দেন। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ বা প্রচারণায় যোগ দেন ৪৮ শতাংশ। সুসংগঠিত কোনো প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেন ৩৭ শতাংশ মানুষ। আর ৩২ শতাংশ মানুষ রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য। রাজনৈতিক বিষয়ে অনলাইনে সক্রিয়তার দিক দিয়েও এগিয়ে আছে বাংলাদেশের মানুষ, ৩৩ দেশের মধ্যে অবস্থান দ্বিতীয়।

যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে রাজনীতি ও ভোটের প্রতি জনগণের আগ্রহ গত কয়েক দশকে কমেছে। ২০০০ সাল থেকে অনুষ্ঠিত ছয়টি নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি গড়ে ৫৫ শতাংশের বেশি নয়। ইউরোপের দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি সচেতনতার পরও ভোটের প্রতি জনগণের একটা বড় অংশই আগ্রহ পান না।

শুধু পিউ রিসার্চের জরিপ নয়, সদ্য সমাপ্ত সাত ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের (ইউপি) দিকে দৃষ্টি দিলেও একই চিত্র আমরা দেখতে পাব। যদিও দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় স্থানীয় সরকার পর্যায়ের এ নির্বাচনের উৎসবমুখরতা অনেকটাই কমেছে। আবার বিএনপিসহ কয়েকটি বিরোধী রাজনৈতিক দল আনুষ্ঠানিকভাবে এবারের ইউপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ১০০-এর বেশি ইউপিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছে। সাত ধাপে গড়ে ৭০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পড়েছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতাসহ ২ হাজার ৪৩ জন নৌকা প্রতীকে জিতেছেন। ১ হাজার ৬৯৪টি ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী নৌকার প্রার্থীকে হারিয়েছেন। ফরিদপুর, মাদারীপুরসহ নৌকার পুরোনো অনেক ঘাঁটিতে আওয়ামী লীগের সিংহভাগ প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে। বিএনপির মতো মাঠের বিরোধী দলের সক্রিয় অংশগ্রহণ না থাকা, প্রশাসন ও দলীয় ক্যাডারদের ব্যবহার করা ও ভোটের মাঠে ভয়ের আবহ সৃষ্টি করার মতো গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও মানুষ যেখানে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে, সেখানেই কিন্তু নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করেছেন।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ৫০ বছর পেরিয়েছে। কিন্তু শক্ত ভিত্তি পায়নি এ দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক হয়নি নির্বাচনী সংস্কৃতি। ফলে কোনো রাজনৈতিক দল একবার ক্ষমতায় গেলে বিরোধীদের দমন আর নিজেদের ক্ষমতাকে পরের পাঁচ বছরের জন্য নবায়নের জন্য নানা কৌশল আবিষ্কারের দিকেই মনোযোগ কেন্দ্রীভূত রাখে। ফলে কে কার চেয়ে বেশি শক্তিশালী কিংবা আন্দোলনের মাধ্যমে কে কার পতন ঘটাতে পারছে, সেটাই ক্ষমতায় আসার উপায় হয়ে যাচ্ছে। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা না থাকা আর ‘জনগণ যে সকল ক্ষমতার উৎস’ সেটা শুধু কেতাবি আপ্তবাক্য হয়ে থাকায় ঘুরেফিরে একই সংকটের বৃত্তে ঘুরপাক খেতে হয়।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় খুঁটি ভোটব্যবস্থা। জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটে ভোটে। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। সেই মালিকেরাই পাঁচ বছর পর তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে জাতীয় সংসদে পাঠান। সাংসদেরা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবেই আইন প্রণয়নসহ নানা নীতি নির্ধারণ করেন। আবার পাঁচ বছর পর তাঁরা জনগণের কাছে তাঁদের প্রতিশ্রুতি ও কাজের খতিয়ান তুলে ধরেন। ভোটের মাধ্যমে জনগণ নির্ধারণ করেন তাঁরা আরও পাঁচ বছর থাকতে পারবেন, নাকি নতুন কেউ সরকার গঠন করবে। এটা সর্বজনীন গণতান্ত্রিক রীতি। এতে জনগণের সঙ্গে সরকার ও জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্ক স্থাপনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ভোট।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ৫০ বছর পেরিয়েছে। কিন্তু শক্ত ভিত্তি পায়নি এ দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক হয়নি নির্বাচনী সংস্কৃতি। ফলে কোনো রাজনৈতিক দল একবার ক্ষমতায় গেলে বিরোধীদের দমন আর নিজেদের ক্ষমতাকে পরের পাঁচ বছরের জন্য নবায়নের জন্য নানা কৌশল আবিষ্কারের দিকেই মনোযোগ কেন্দ্রীভূত রাখে। ফলে কে কার চেয়ে বেশি শক্তিশালী কিংবা আন্দোলনের মাধ্যমে কে কার পতন ঘটাতে পারছে, সেটাই ক্ষমতায় আসার উপায় হয়ে যাচ্ছে। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা না থাকা আর ‘জনগণ যে সকল ক্ষমতার উৎস’ সেটা শুধু কেতাবি আপ্তবাক্য হয়ে থাকায় ঘুরেফিরে একই সংকটের বৃত্তে ঘুরপাক খেতে হয়। বারবার হোঁচট খেতে খেতে মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় আসার জন্য জনগণকে বাদ দিয়ে আমলা, ব্যবসায়ী কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বাদ পড়ে যায় ক্ষমতার মালিক জনগণ।

নির্বাচন পরিচালনাকারী নির্বাচন কমিশন নিয়েই সবচেয়ে বেশি আলোচনা ও বিতর্ক হয় মানুষের মাঝে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিকগুলো মনে করে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানে নিজেদের পছন্দের ও অনুগত লোক বসাতে পারলেই নির্বাচনী মাঠের বড় প্রতিবন্ধকতা জয় করা যায়। এ সপ্তাহেই সাবেক আমলা হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। তাঁদের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ ২০২৩ সালের জাতীয় সংবাদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য করা এবং সেখানে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। নতুন কমিশন নিয়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা বিতর্ক চলছে। বিএনপি, সিপিবি, বাসদসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য অনুসন্ধান কমিটির ডাকে সাড়া দেয়নি। তাদের কেউ কেউ নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিও তুলেছে। এসব বিতর্ক যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক মাঠ উত্তপ্ত করে রাখবে, তা বলাই চলে।

২০১৪ ও ২০১৯—সর্বশেষ দুটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ ও নূরুল হুদা কমিশনের অধীন। প্রথমটিতে ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে বিএনপি জোট অংশ নেয়নি। ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিএনপি জোট অংশ নিলেও সরকার ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ‘দিনের ভোট রাতে করার’ অভিযোগ তুলেছে। শেষ দুটি জাতীয় নির্বাচন একতরফা হওয়ায় সাধারণ মানুষ ভোটের ব্যাপারে আগ্রহ হারায়। রকিব ও হুদা কমিশনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের মূল অভিযোগ, তাঁরা দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে অকেজো করে ফেলেছেন।

দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার সংস্কৃতি পরিবর্তন না হলে আগামী নির্বাচনে নবগঠিত নির্বাচন কমিশন ‘জাদুকরী’ কিছু করতে পারবে, এমনটা ভাবা অনেক বেশি দূরকল্পী কল্পনা হয়ে যাবে। ‘গণতন্ত্র, নির্বাচন ও ভোটাধিকার বিষয়ে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে’ প্রতিবছর ২ মার্চ দেশে ‘জাতীয় ভোটার দিবস’ পালন করা হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য, ‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, রক্ষা করব ভোটাধিকার’।

২০২১ সালের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ১৭ লাখ। এঁদের একটা বড় অংশই তরুণ ভোটার, যাঁরা গত এক দশকে দেশে নতুন ভোটার হয়েছেন। কিন্তু ভোট এলেই যে সাজ সাজ রব, চায়ের দোকান থেকে অফিস—সবখানেই যে তর্ক-বিতর্ক, গান-স্লোগান-মিছিল, দলাদলি শেষে গলাগলির যে উৎসবমুখরতা, তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাঁরা। আজ সারা দেশে নানা বর্ণাঢ্য কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতীয় ভোটার দিবস পালিত হচ্ছে। কিন্তু ভোটের প্রাণ ভোটাররা যদি নির্বাচন থেকে বাদই পড়ে যান, তাহলে এই আনুষ্ঠানিকতা কী অর্থ বহন করে?

মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক