ভোক্তা হিসেবে নিরাপদ খাদ্য কিংবা ভেজালমুক্ত পণ্য কিংবা প্রতারণাহীন সেবা পাওয়ার অধিকার যে নাগরিকের রয়েছে, সেই ধারণাটিই আমাদের এখানে নতুন। খাদ্যে ভেজাল মেশানো, আম–কলা বা অন্য কোনো ফল পাকাতে যথেচ্ছ রাসায়নিক ব্যবহার, মাছ–মাংসে রং ও ফরমালিনের ব্যবহারের খবর গত কয়েক দশক ধরেই ছাপা পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের খবরের শিরোনাম হয়ে আসছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা ভোক্তাদের অধিকার যাতে সংরক্ষিত হয়, সে ধরনের তদারকি সংস্থা করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু মাত্র ২০০৯ সালে সরকার পক্ষ থেকে ভোক্তা অধিকার আইন করা হয়। ভোক্তা বা ক্রেতার স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য দেখভাল বা তদারকির প্রতিষ্ঠান জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
নাগরিক অধিকারকে সুরক্ষিত রাখার জন্য সরকারের অন্যান্য সংস্থার মতোও (মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন) ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে হাত–পা বেঁধে চলাচলের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে ভোক্তা অধিকারও কাগুজে অধিকারের বাইরে বের হতে পারে না।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ অনুযায়ী ক্রেতা বা ভোক্তা যে সব অধিকার পাওয়ার কথা, তা নিশ্চিত করা গেলে দেশে হয়তো সম্রাট অশোকের ধর্মরাজ্য (ধর্ম এখানে জনগণের কল্যাণ বা হিত অর্থে) প্রতিষ্ঠা হয়ে যেত। এ আইনের আওতায় ক্রেতারা যেসব বিষয়ে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন, তা হলো বিক্রেতার পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করা, মূল্যতালিকা প্রদর্শন না করা, সেবার তালিকা সংরক্ষণ ও প্রদর্শন না করা, অধিক মূল্যে পণ্য বিক্রয় করা, পণ্য মজুত করা, ভেজাল পণ্য বিক্রয়, খাদ্যপণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রণ, অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন, মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা প্রতারণা, প্রতিশ্রুত পণ্য সরবরাহ না করা, ওজনে ও পরিমাপে কারচুপি, দৈর্ঘ্য পরিমাপের ক্ষেত্রে গজফিতায় কারচুপি, নকল পণ্য প্রস্তুত, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রয়, অবহেলা।
যে বিক্রেতা রং মিশিয়ে মাছ বিক্রি করছেন, তিনিই তো আবার তাঁর সন্তানের জন্য তেলাপোকা মেশানো মিষ্টি কিনছেন, আবার যে ফল ব্যবসায়ী রাসায়নিক দিয়ে আম পাকাচ্ছেন, তিনিই আবার বাজার থেকে রং মেশানো শর্ষের তেল কিনে নিয়ে আসছেন। এভাবেই সবাই যেন একটা ভেজাল আর প্রতারণার বৃত্তে ঢুকে যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, এই আত্মঘাতী সুযোগটা কে করে দিচ্ছে? নিরাপদ খাদ্য কিংবা ভেজালমুক্ত পণ্য কিংবা পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার অধিকার সুনিশ্চিতভাবেই সব নাগরিকের। সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।
এর মানে ভোক্তা অধিকার আইনের যে পরিসর তাতে বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক যেকোনো জায়গা থেকে (সুপারশপ থেকে ফুটপাথ) পণ্য কিনলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে ভোক্তার অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার অভিযোগে নালিশ জানাতে পারেন। যদি সত্যি সত্যি তা হতো, তাতে অভিযোগের ঠেলায় ভোক্তা অধিকারের ওয়েবসাইট কিংবা মেইল ব্যবস্থা ভেঙে পড়ত। আর যদি এসব অভিযোগ ডাকযোগে আসত, তাহলে খাম খুলতে খুলতে আর অভিযোগ যাচাই–বাছাই করতে করতে প্রতিষ্ঠানের লোকজনের কর্মঘণ্টা শেষ হয়ে যেত। কিন্তু সে রকমটা কিছু ঘটছে না। তার মানে নাগরিকদের মধ্যে ভোক্তা হিসেবে তাদের অধিকারের বিষয়টি পরিষ্কার নয়।
সরকার একটা আইন করে, একটা তদারকি প্রতিষ্ঠান করে দিয়ে এবং কিছু লোকবল নিয়োগ করে তার দায়িত্ব সেরেছে। এ ধরনের গুরুদায়িত্ব পালন করতে গেলে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গড়ে তোলা জরুরি। ভেজালমুক্ত কিংবা নিরাপদ খাদ্য ও পণ্য নাগরিক যাতে পায়, সেটা নিশ্চিতের সত্যিকার অর্থে কি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে?
প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল এ সংস্থাটি শুধু গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলেই নড়েচড়ে বসে। বিশেষ করে, করোনা মহামারির সময়ে যখন নামীদামি থেকে শুরু করে একেবারে অপরিচিত ই–কমার্স, এফ–কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ভোক্তারা বড় ধরনের প্রতারণার শিকার হচ্ছিল, সে সময়ে জোরেসোরে অধিদপ্তরের নিষ্ক্রিয়তার প্রশ্নটি উঠে আসছিল। অনেকের এ অভিযোগও ছিল, যে অভিযোগ দেওয়ার পর সেটা নিষ্পত্তি হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়।
সম্প্রতি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ অভিযানের বেশ কিছু ভিডিও পাওয়া যায়। ভিডিওগুলো পরপর মনোযোগ দিয়ে দেখলে বাংলাদেশে ভেজাল, প্রতারণা, দাম বেশি রাখা বা ঠকানো, মিথ্যা তথ্য দেওয়ার মতো অপরাধ যে কতটা গভীর সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, তার একটা পিলে চমকানো চিত্র পাওয়া যায়। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে এ ধরনের অপরাধ নির্বিকারভাবে করে যাচ্ছে উৎপাদক, আমদানিকারক কিংবা বিক্রেতারা। এ ক্ষেত্রে সুপারশপ থেকে শুরু করে ফুটপাতের খাবার বিক্রেতা সবাইকে একপাল্লায় মাপা সম্ভব। নামী ব্যান্ড থেকে শুরু করে ব্যক্তি উদ্যোগ সবার মধ্যেই যেন আইন না মানা কিংবা লোক ঠকানোর প্রতিযোগিতা। শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত দামী ব্র্যান্ডের মিষ্টির দোকানে মিষ্টিতে ভাসছে তেলোপোকা, ঘানিতে ভাঙা খাঁটি শর্ষের তেলে মেশানো হচ্ছে রং ও কৃত্রিম ঝাঁজ, মাছকে তরতাজা দেখাতে মেশানো হচ্ছে রং, কেক–পেস্টির মতো খাবার তৈরির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে কাপড়ের রং। কাঁচাবাজার ও নিত্যপণ্য, মাছ–মাংসে বিক্রেতাদের বাধ্যতামূলক মূল্যতালিকা টাঙানোর কথা থাকলেও তারা কেউই মানছেন না। পিসে তরমুজ কিনে বিক্রেতারা ইচ্ছামতো কেজিতে বিক্রি করছেন। লাগেজে করে বিদেশ থেকে জামাকাপড়, কসমেটিকস এনে ভ্যাট–শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ইচ্ছামতো মূল্য নির্ধারণ করে বিক্রি করছেন। শিশুখাদ্যও বিক্রি হচ্ছে মেয়াদের তারিখ মুছে দিয়ে। বিশাল মূল্যছাড়ের বিজ্ঞাপন দিয় জামাকাপড় বিক্রি চলছে আগের দামের ট্যাগলাইনের ওপর নতুন করে ট্যাগলইন বসিয়ে।
প্রতিটি ভিডিও এ রকম আইন না মানার গল্পে ভর্তি। ভোক্তা অধিকার যেখানেই অভিযান চালায় সেখানেই অনিয়ম ও প্রতারণার এমন সব ভয়াবহ ঘটনার সন্ধান পাওয়া যায়। অভিযানকারীরা বিক্রেতাদের যখন প্রশ্ন করেন কেন, তারা এই অনিয়ম করেন। প্রায় প্রত্যেকের উত্তর থাকে, তাঁরা জানেন না। কিংবা এমন একটা অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন, ‘আরে এ তো সবাই করে। এটাই তো নিয়ম।’ বিক্রেতাদের তাঁরা বোঝান, কখনো ধমকান, কখনো জরিমানা করেন। কিন্তু এতে কি উৎপাদক কিংবা বিক্রেতার দৃষ্টিভঙ্গি বদল হচ্ছে? নাকি তাঁরা ‘মাসুদ তুমি আর ভালো হলে না’– সংলাপের আলোচিত ‘মাসুদ’ই থেকে যাচ্ছেন।
যে বিক্রেতা রং মিশিয়ে মাছ বিক্রি করছেন, তিনিই তো আবার তাঁর সন্তানের জন্য তেলাপোকা মেশানো মিষ্টি কিনছেন, আবার যে ফল ব্যবসায়ী রাসায়নিক দিয়ে আম পাকাচ্ছেন, তিনিই আবার বাজার থেকে রং মেশানো শর্ষের তেল কিনে নিয়ে আসছেন। এভাবেই সবাই যেন একটা ভেজাল আর প্রতারণার বৃত্তে ঢুকে যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, এই আত্মঘাতী সুযোগটা কে করে দিচ্ছে? নিরাপদ খাদ্য কিংবা ভেজালমুক্ত পণ্য কিংবা পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার অধিকার সুনিশ্চিতভাবেই সব নাগরিকের। সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।
ভোক্তার অধিকার সুরক্ষার সিদ্ধান্তটা রাজনৈতিক। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের যে অভিযান তা ভেজাল ও প্রতারণার বিরুদ্ধে খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার যুদ্ধের মতো এক বাস্তবতা। হাত–পা বেঁধে রেখে কিংবা নিয়ন্ত্রিত অভিযান চালানোর সুযোগ দিয়ে ভোক্তার অধিকার কতটা আর রক্ষা করা যাবে।
মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যোষ্ঠ সহ–সম্পাদক