বিরোধীদের প্রত্যাখ্যান, আন্তর্জাতিক সমালোচনা সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে ১০ জানুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদে শপথ নিলেন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো। ২০১৮ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচন বয়কট করেছিল বিরোধী দল। অভিযোগ উঠেছিল ভয়াবহ কারচুপির। আন্তর্জাতিক মহল থেকে একের পর এক সমালোচনা ছুটে এসেছে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রসহ আমেরিকার ১৩টি দেশের নেতৃবৃন্দ মাদুরোর প্রেসিডেন্সিকে স্বীকৃতি দেবেন না বলে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন। তবে কারাকাসে অনুষ্ঠিত শপথ অনুষ্ঠান নিকারাগুয়ার প্রেসিডেন্ট ডেনিয়েল ওর্তেগা ও বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তাঁদের এই সমর্থন মাদুরোকে কতটা গ্রহণযোগ্য করবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
নিকোলা মাদুরোর এই শপথ অনুষ্ঠান এমনকি ভেনেজুয়েলার সংবিধান অনুসরণ করেও হয়নি। দেশটির সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টকে জাতীয় আইনসভায় শপথ নিতে হবে। কিন্তু অনুষ্ঠানটি হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। কারণ, আইনসভার নিয়ন্ত্রক বিরোধী দল মাদুরোর নির্বাচিত হওয়াকে ‘ভুয়া’ ও ‘বেআইনি’ বলে বর্ণনা করে আসছে। বিপরীতে নামে ‘স্বাধীন’ ভেনেজুয়েলার আদালত এখনো মাদুরোর অনুগত। এই বিরোধিতা এতটাই যে মাদুরোকে দ্বিতীয় মেয়াদে শপথ নিতে হয়েছে রীতিমতো নিরাপত্তাবলয়ে ঢুকে। বিবিসি জানাচ্ছে, এত সতর্কতার পরও মাদুরোবিরোধীরা পথে ছিলেন।
সংবিধানের নির্দেশনা না মেনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথগ্রহণের স্থান বদলের এই ঘটনাই বড় আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। ক্ষমতা ধরে রাখতে তাঁর দিন দিন কঠোর হয়ে ওঠার আভাস এই স্থান পরিবর্তন। যত সময় যাচ্ছে, মাদুরো ততই একনায়ক হয়ে উঠছেন। তাঁর প্রথম মেয়াদ নিশ্চিতভাবেই ছিল বিপর্যয়কর। দৃশ্যত, তিনিই এখন বিশ্বের সবচেয়ে কম সফল শাসক। যদিও তাঁর ব্যর্থতার বীজ বোনা হয় তাঁর পূর্বসূরি হুগো চাভেজের সময়ই, যিনি ২০১৩ সালে মারা যান। চাভেজ দরিদ্রদের সহায়তার পন্থা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি ও বাজার নিয়ন্ত্রণকে।
শুধু তা-ই নয়, তাঁর সময়ই ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি তেল কোম্পানি পিডিভিএসএর শীর্ষ কর্মকর্তায় রদবদল আনেন, যা দেশটির সরকারি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। এ কাজ তিনি করেছিলেন শুধু এ কারণেই যে ওই কর্তারা তাঁর রাজনীতিকে সমর্থন করেন না। কিন্তু চাভেজ ভাগ্যবান ছিলেন। কারণ, তাঁর ১৪ বছর মেয়াদে জ্বালানি তেলের দাম ছিল চড়া। ফলে, বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পরিসরে চাভেজের রাজনীতির কথাও বলতে হয়। তেলসমৃদ্ধ দেশ ও জোটের ওপর প্রভাব বিস্তারে অবদান তাঁর ছিল। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর ভেনেজুয়েলার অর্থনীতিতে মন্দাভাব সৃষ্টি হয়। কিন্তু অতটা প্রকট ছিল না, যতটা মাদুরোর প্রথম মেয়াদে হয়েছে। চাভেজের মতোই দরিদ্রদের জন্য কাজ করতে উদ্গ্রীব মাদুরোর প্রথম মেয়াদে নির্বাচিত হওয়া নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু ওই বিতর্ক মুছে দেওয়ার বদলে তিনি তা গাঢ়ই করেছেন কেবল। আর এ ক্ষেত্রে ২০১৪ সাল থেকে কমতে থাকা জ্বালানি তেলের দাম তাঁকে বিপাকে ফেলেছে সবচেয়ে বেশি।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও মাদুরো চাভেজের পথ থেকে সরে দাঁড়াননি। আর এ জন্য অদ্ভুত সব পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধের জন্য তিনি আমদানি কমিয়েছেন, যা ভেনেজুয়েলাকে ঠেলে দিয়েছে দারিদ্র্য ও ক্ষুধার দিকে। বাজেটঘাটতি মেটাতে মুদ্রা বলিভার ছাপেন তিনি, যা মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ে গেছে ভয়াবহ পর্যায়ে। বর্তমানে বছরে মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে ১৪ লাখ শতাংশ। এটি মোকাবিলা করতে মুদ্রা বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে ধরে রাখতে গিয়ে অর্থবাজারকে এক সীমান্তিক অবস্থায় নিয়ে এসেছেন। বাজারের নিয়ন্ত্রণ ছাড়েননি একচুলও। ফলে চোরাচালানি বেড়েছে, যা কতিপয় লোককে পরিণত করেছে শত কোটিপতিতে। এসবের কারণে মাদুরোর প্রথম মেয়াদে দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) অর্ধেকে নেমে এসেছে।
বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় পিডিভিএসএর বন্ডের খেলাপি হন তিনি ২০১৭ সালে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় তাঁকে। চীন ও রাশিয়ার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত কোম্পানির কাছে বন্ধক রাখা তেল-গ্যাস ও স্বর্ণের খনি মুক্ত করে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেওয়া সম্ভব হয়। গত আগস্টে লাখ মূল্যমানের মুদ্রা বাজার থেকে তুলে নিলেও যথাযথ নীতি গ্রহণ না করায় বলিভারের অবমূল্যায়ন ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। ডলারের বিপরীতে বলিভারের দরপতন হয়েছে ৯৫ শতাংশ। ব্যাংকগুলো এরই মধ্যে দুই বলিভারের নোট নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
এই অবস্থায় জ্বালানি তেলের দাম আবার বাড়লে ভেনেজুয়েলার তা থেকে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, ভেনেজুয়েলার সরকারই পিডিভিএসএ লুট করেছে। না, পকেটে পোরেনি। চাভেজের সময়ে ভেনেজুয়েলার মানুষকে প্রায় বিনা মূল্যে পেট্রল দেওয়া হয়েছে। কিউবার মতো বন্ধুদেশগুলোয় অত্যন্ত কম দামে ও সহজ শর্তে জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়েছে। এ কারণে বিনিয়োগ ও নতুন ক্ষেত্র অনুসন্ধানকাজ থমকে গেছে। এই পরিস্থিতি আরও বাজে হয়েছে মাদুরো আসার পর। কারণ, সাবেক এই সেনা কর্মকর্তারা জ্বালানি খাত নিয়ে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। ফলে যা হওয়ার হয়েছে। শ্রমিক অসন্তোষ থেকে শুরু করে এই খাত এখন অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত। বর্তমানে ভেনেজুয়েলা ১৯৫০ সালের চেয়েও কম জ্বালানি তেল উৎপাদন করে। আর মাথাপিছু উৎপাদন ধরলে ফিরে যেতে হবে ১৯২০-এর দশকে।
অর্থনীতির প্রধান ভিতটির এই ধসে যাওয়া কারণে দুর্ভোগ পাখা মেলেছে। বিদ্যুৎ, পানিসহ সব খাতকে চেপে ধরেছে দুর্নীতি। বিনিয়োগস্বল্পতা ও কর্মীদের অনুপস্থিতি ভোগাচ্ছে সব খাতকে। স্বাস্থ্যসেবা-ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। ছড়িয়ে পড়েছে সহিংসতা। ভেনেজুয়েলার জনসংখ্যার ১০ ভাগের ১ ভাগ (৩০ লাখ) এরই মধ্যে পাড়ি জমিয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
ব্রুকিং ইনস্টিটিউশনের তথ্যমতে, এই অবস্থা চলতে থাকলে আরও অন্তত ৫০ লাখ মানুষ পালিয়ে বাঁচতে চাইবে। বিষয়টি নির্ভর করছে জ্বালানি খাত ও শ্রমবাজারের ওপর। অন্যভাবে বললে বলতে হয় মাদুরোর ওপর। তাঁর ক্ষমতা যত দীর্ঘস্থায়ী হবে, ভেনেজুয়েলার সাধারণ মানুষের ভোগান্তি তত বাড়বে। দক্ষিণ আমেরিকান দেশগুলো ও কানাডার জোট লিমা গ্রুপ এরই মধ্যে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদকে স্বীকৃতি না দেওয়ার প্রস্তাব তুললেও তা মেক্সিকোর নতুন প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাদরের বিরোধিতায় আটকে গেছে। কিন্তু তাতে অসম্মতি পাল্টে যায়নি। ফলে, মাদুরো এই অস্থির ভেনেজুয়েলায় আন্তর্জাতিক চাপের মুখে কত দিন টিকবেন, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
মাদুরো টিকলেও ভেনেজুয়েলা কীভাবে টিকবে, তা এখন বড় প্রশ্ন। কারণ, অন্ধের মতো চাভেজকে অনুসরণ করতে গিয়ে তিনি এরই মধ্যে ভেনেজুয়েলাকে খাদের কিনারে এনে দাঁড় করিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংস্কার না করলে, নীতি পরিবর্তন করে ব্যাপক পুনর্গঠনপ্রক্রিয়া শুরু না করলে মাদুরো ভেনেজুয়েলাকে নিয়েই পতিত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন। লিমা গ্রুপ ভেনেজুয়েলার আইনসভাকে স্বীকৃতি দিয়ে মাদুরোকে অনুরোধ করেছে ক্ষমতা আইনসভার কাছে হস্তান্তরের। আইনসভার বর্তমান নিয়ন্ত্রণ ভলান্ট্যাড পপুলার দলের হাতে। দলটির নেতা লিওপোলডো লোপেজ বর্তমানে গৃহবন্দী। দলটির প্রতিষ্ঠাতা গুয়াইদো মাদুরোর প্রেসিডেন্সিকে ‘বেআইনি’ আখ্যা দিয়ে সেনাবাহিনীকে সাংবিধানিক ধারা ফেরাতে সহায়তা করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
মাদুরো বলতে গেলে শাঁখের করাতের ওপর রয়েছেন। চাভেজিজম অনুসরণ করলে অভ্যন্তরীণ অবস্থা একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর এই পথ থেকে হঠাৎ মুখ ফেরালে নিজের বলয়টি আবার ছোট হয়ে আসার ঝুঁকি রয়েছে। ফলে, হঠাৎ করে তাঁর পক্ষে কিছু বদলে ফেলা সম্ভব নয়। এদিকে তাঁর অনেক অনুগত ব্যক্তিই এখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। সর্বশেষ ৬ জানুয়ারি তাঁর একসময়ের বিশ্বস্ত সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ক্রিশ্চিয়ান জারপা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে মাদুরোর শাসনকে সরাসরি ‘স্বৈরাচারী’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ ক্ষয়টি শুরু হয়ে গেছে। সংবিধান ভেঙে আইনসভা এড়িয়ে সামরিক নিরাপত্তার মধ্যে শপথ গ্রহণ করা প্রেসিডেন্ট এই ক্ষয় আদৌ রোধ করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে ব্যাপক সংশয় রয়েছে। শপথ অনুষ্ঠানে ভেনেজুয়েলার সংকটকে স্বীকার করে তা নিজেরাই নিরসনের যে প্রত্যয় তিনি জানিয়েছেন, তাঁর ওপর মানুষ আদৌ আস্থা রাখে কি না, তা-ই এখন দেখার বিষয়।