ভেঙে পড়া মধ্যবিত্ত ও টিসিবির ট্রাকের পেছনে ‘কুণ্ঠিত দৌড়’

টিসিবির ট্রাকের দীর্ঘ লাইনে মধ্যবিত্তরাও গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন
ছবি : প্রথম আলো

তেল, চিনি, ডালসহ নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিসিবির লাইনে মানুষের লাইনও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে বিকেল গড়িয়ে গেলেও অনেককে ফিরে আসতে হচ্ছে খালি হাতে। ‘ভালো’ পোশাকের মধ্যবিত্তরাও গরিবদের সেই লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, টিসিবির একটা ট্রাকের পেছন পেছন দৌড়াচ্ছেন একদল মানুষ। শারীরিক ও মানসিকভাবে কুণ্ঠিত কয়েকজন (ভালো পোশাক পরিহিত) সেই দৌড়ে অবধারিতভাবে পিছিয়ে পড়ছেন। আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, এক নারী একটা পণ্যশূন্য টিসিবির ট্রাকের পেছনে ঝুলে পড়ে মিনতি জানাচ্ছেন চাল, তেল কিংবা অন্য কোনো খাদ্যপণ্যের জন্য।

পঞ্চাশ দশকে মুক্তি পাওয়া ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা ‘নাগরিক’। এই সিনেমায় তিনি স্বাধীনতা উত্তর শহর কলকাতার সমাজেরভাঙনের চিত্র তুলে এনেছেন শিল্পীর সংবেদনশীল মন দিয়ে। ভাঙনের কেন্দ্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। লেখাপড়া জানা মধ্যশ্রেণির প্রতিনিধি পরিবারটি। পরিবারের প্রধান চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে নিয়ে তাঁর ছোট্ট সংসার। অসুখের খরচ মেটাতে গিয়ে নিজের বাড়ি বিক্রি করে দিতে হয়েছে তাঁকে। পেনশনের আয়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে উঠে আসতে হয়েছে কলকাতার সস্তা ভাড়ার ঘিঞ্জি একটা পাড়ায়, ছোট পুরোনো একটা বাড়িতে। পরিবারের কন্যাটির ‘বয়স’ হয়ে গেলেও বিয়ে হয়নি। বয়সের কারণে পাত্রপক্ষ তাঁকে পছন্দ করে না।

ছেলেটি লেখাপড়া শেষ করে চাকরিপ্রত্যাশী। ইন্টারভিউ দিয়ে এসে ভীষণ আশাবাদী, এক মাসের মধ্যেই চাকরিটা হয়ে যাবে, ভাগ্য বদলে যাবে। ছেলেটা স্বপ্ন দেখে। পুরোনো ঘরের দেয়ালে টাঙানো একটা পুরোনো ক্যালেন্ডার। একটা মাঠ পেরিয়ে একটা লাল টালির বাড়ির ছবি। ছেলেটা স্বপ্ন দেখে, চাকরি হলে তাঁর প্রেমিকাকে বিয়ে করবে এবং এ রকম একটা বাড়িতে সবাই মিলে সুখে-শান্তিতে বাস করবে। দেখতে দেখতে এক মাস পেরিয়ে যায়। হয়ে যাওয়া চাকরিটা তাঁর হয় না। জীবন থেকে অনেকগুলো ‘এক মাস’ হারিয়ে গেলেও চাকরি আর হয় না।

ঋত্বিক একই সঙ্গে পাঁড় বাস্তববাদী ও আশাবাদী শিল্পী। তাই তিনি দূর ভবিষ্যতে কোনো একদিন সবকিছু পাল্টে যাবে—এমন আশা করেন। কিন্তু বর্তমানের নিরেট বাস্তবতার প্রতিই তাঁর মনোযোগ। ফলে ভাঙনের কালে একটা মধ্যবিত্ত পরিবার কীভাবে ফুটপাতে সবহারাদের কাতারে নেমে যায়, সেই চিত্রই তুলে ধরেন।

ঋত্বিকের ‘নাগরিক’ সিনেমার প্রতিপাদ্য যেন করোনাপরবর্তী বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের ভাঙন ও নাজুক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই এখন টিসিবির লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ঐতিহাসিকভাবে প্রতিবাদী ও বিদ্রোহী। এই শ্রেণির হাতেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। কামরুদ্দীন আহমেদের মতো সমাজ বিশ্লেষক গত শতকের ষাটের দশকে এ দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির এই প্রতিবাদী চরিত্রের সঙ্গে ফ্রান্সের ছাত্র-বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। সে সময় দুই দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিদ্রোহ সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

ঋত্বিকের ‘নাগরিক’ সিনেমার প্রতিপাদ্য যেন করোনাপরবর্তী বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের ভাঙন ও নাজুক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই এখন টিসিবির লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ঐতিহাসিকভাবে প্রতিবাদী ও বিদ্রোহী। এই শ্রেণির হাতেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। কামরুদ্দীন আহমেদের মতো সমাজ বিশ্লেষক গত শতকের ষাটের দশকে এ দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির এই প্রতিবাদী চরিত্রের সঙ্গে ফ্রান্সের ছাত্র-বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। সে সময় দুই দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিদ্রোহ সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

মধ্যবিত্ত শ্রেণি যতটা অর্থনৈতিক শ্রেণি, তার চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণি। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শনে তাদের অবদান থাকে প্রভাববিস্তারী। একই সঙ্গে রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ ও পরিবর্তনে তাদের প্রধান একটা ভূমিকা আমরা দেখেছি। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা আমরা দেখি। কিন্তু গত তিন দশকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে।

বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতিতে মুক্তবাজার ব্যবস্থা যতটাই গেঁড়ে বসেছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণি ততটাই নিছক অর্থনৈতিক শ্রেণি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ফলে শহুরে রিকশাচালক, বাসচালক, তরকারি বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা কিংবা প্রাথমিক শিক্ষক, বেসরকারি চাকুরে কিংবা ছোট ব্যবসায়ীরা আয়ের দিক থেকে একই শ্রেণিভুক্ত। দৈনিক ২ ডলার থেকে ৪০ ডলার যাঁদের আয়, তাঁদের মধ্যবিত্ত বলে ধরা হয়।

ক্ষমতাচক্রের সঙ্গে যুক্ত মধ্যবিত্তের একটা অংশ দ্রুত ধনীতে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশটার পরিস্থিতি গত তিন বছরে খারাপও হয়েছে। আয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাঁদের উপযুক্ত কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে না। দেশে মাত্র ১০-১২ শতাংশ কর্মসংস্থান হচ্ছে আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে। নিয়মিত বেতন, চাকরির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তাদের রয়েছে। কিন্তু বাকি ৮৮-৯০ শতাংশ কর্মসংস্থান অনানুষ্ঠানিক খাতের। ফলে আয় ও ক্রয়ক্ষমতার দিক থেকে যে শ্রেণিকে মধ্যবিত্ত ধরা হয়, সেই শ্রেণি ‘ঝুলন্ত দড়ির ওপর’ ঝোলে। করোনা বা অন্য যেকোনো ধাক্কায় তাদের বিপুল অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায়।

সাংস্কৃতিকভাবে ভেঙে পড়ার পর করোনা মহামারির অভিঘাতে অর্থনৈতিকভাবেও মধ্যবিত্ত ভাঙছে। নতুন করে আবার চোখ রাঙাচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ। করোনা মহামারির তিন বছরে বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। নতুন করে আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে, তাদের মধ্যে কত জন মধ্যবিত্ত, সে পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। অনেকের চাকরি চলে গেছে, অনেক মাঝারি ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তারা খুব দ্রুত নিচের স্তরে নেমে গেছে। করোনার তিন বছরে চাল, ডাল, আটা, তেল, চিনি, সবজি, মাছ-মাংসসহ প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে, ওষুধ-চিকিৎসা খরচ, বাসা ভাড়া, পরিবহন ব্যয়, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ সবই বেড়েছে। কিন্তু আয় বাড়েনি। বরং বেশির ভাগের ক্ষেত্রে সেটা কমেছে। এখন কোনোরকমে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার সংগ্রামে ‘ভালো পোশাক পরা লোকেরা’ এখন টিসিবির ট্রাকের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। কিন্তু টিসিবির পণ্যচাহিদার তুলনায় জোগান কম। সবচেয়ে বড় কথা, ব্যবস্থাপনাটাও অবমাননাকর। সকাল থেকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হবে, তারপর ৯টার ট্রাক আসবে দুপুর ১২টা থেকে বেলা ১টা কিংবা ২টায়। সেখানেও পণ্যদ্রব্য থাকবে অপ্রতুল। ফলে দৌড়াদৌড়ি, হুড়োহুড়ি, প্রতিযোগিতার চিত্র নিত্যদিনের।

রাষ্ট্র তো এই নিচের স্তরে নেমে যাওয়া মধ্যবিত্তের একাংশের কথা ভেবে ট্রাকের পেছনে ছুটতে ছুটতে খাদ্যপণ্য কেনার এই অবমাননাকর ব্যবস্থা করেনি। তারা সেটা করেছে গরিবদের জন্য। গরিবেরা অনুকম্পা পেতে ঠেলাঠেলি করবে, ধাক্কাধাক্কি করবে—এতে আর এমন কী? ‘ছোটদের বড়দের সকলের, গরিবের নিঃস্বের ফকিরের’—সব মানুষের দেশ হতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় নীতিতে বৈষম্যটাই এখন সবচেয়ে বড় সত্য। বৈষম্য পরিমাপের গিনি সহগে বাংলাদেশ চরম বৈষম্যপূর্ণ রাষ্ট্রের সীমারেখা ছুঁতে চলেছে। ২০১০ সালে গিনি সহগ ছিল শূন্য দশমিক ৪৫, সেটা ২০১৮ সালে হয়েছে শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশ। শূন্য দশমিক ৫০-এর ওপরে গেলে কিন্তু খুব খারাপ অবস্থা।

এক দেশ দুই অর্থনৈতিক নীতি, বৈষম্যের যে দেয়াল ভেঙে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, স্বাধীনতার ৫০ বছরে সেই বৈষম্যই এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত শব্দ। ইতিহাসবিদ ও অর্থনীতিবিদ রমেশ চন্দ্র দত্ত তাঁর ‘বাংলার কৃষক’ বইতে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখিয়েছিলেন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে কীভাবে বাংলা থেকে সম্পদ পাচার হয়ে যাওয়ায় কৃষকেরা দুর্দশার বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে পারেন না। পাকিস্তান আমলেও সম্পদ পাচার ছিল প্রধান সমস্যা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতেও সম্পদ পাচারের সেই বৃত্ত থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। ফলে উদ্বৃত্ত সম্পদ দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

ঋত্বিক ঘটকের ‘নাগরিক’ সিনেমার শেষ দৃশ্যটায় আমরা দেখতে পাই, একটা বৃষ্টির সন্ধ্যায় ভাই ও বোন ঘিঞ্জি পাড়ার সেই ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে রওনা হচ্ছে। সেই মুহূর্তেই একটি ট্যাক্সি এসে বাড়িটির দোরগোড়ায় থামছে। আরও দুই ভাই-বোন জিনিসপত্র নিয়ে ট্যাক্সি থেকে নামে। জমে থাকা ময়লা কাদায় পা আটকে যায় মেয়েটির। বলে ওঠে, ছি! কী ময়লা! ছেলেটা তাকে আশ্বস্ত করে, মাত্র তো একটা মাস, কষ্টেসৃষ্টে কাটিয়ে দাও। চাকরিটা তো হয়েই যাচ্ছে...।

ভাঙনের কালে সেই এক মাস কত দিনে শেষ হয়, কেউ কি বলতে পারে? করোনা মহামারির ধাক্কায় দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ যে চরম দুর্দশায় আছে, সেই বাস্তবতাকে স্বীকার করতে নীতিনির্ধারকদের সমস্যা কোথায়? এই দুঃসময়টা তারা যাতে কাটিয়ে উঠতে পারে, সে জন্য সম্মানজনক কোনো ব্যবস্থায় কেন সরকারি সহায়তা দেওয়া যাবে না? গরিব হোক, মধ্যবিত্ত হোক—সবাই রাষ্ট্রের নাগরিক। নাগরিকের আত্মমর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।

মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক