মতামত

ভূরাজনীতির গোলকধাঁধায় আফগানিস্তান

ভৌগোলিক অবস্থানের অভিশাপ বইতে হচ্ছে আফগানিস্তানকে।
ছবি: এএফপি

আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় তালেবানের প্রত্যাবর্তন অবশ্যম্ভাবী ধরে নিয়েই এখন সব ধরনের আলোচনা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর সৈন্য প্রত্যাহারের পর কাবুলে ক্ষমতাসীন সরকার আর কত দিন টিকে থাকতে পারবে, তা নিয়ে প্রায় সবাই-ই সংশয় প্রকাশ করছেন। সবার স্মরণে আছে যে ১৯৮৯ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্যরা আফগানিস্তান ত্যাগের পর তাদের সমর্থিত নাজিবুল্লাহ সরকার টিকে ছিল ১৯৯২ সাল পর্যন্ত। সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়ে দ্বিগুণ সময় মার্কিন ও আন্তর্জাতিক বাহিনীর উপস্থিতি এবং তার চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় ও প্রাণনাশের পরও এটাই বাস্তব যে আফগানিস্তানে এমন কোনো রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে ওঠেনি, যা তালেবানদের আদর্শ ও সামরিক অভিযান মোকাবিলা করতে পারে।

কেন আফগানিস্তানে এমন রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারেনি, যেখানে তালেবানের বিকল্প শক্তি তৈরি হয়, কেন তালেবানের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকল, সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। গত এক দশকে বিশ্লেষকেরা বিভিন্নভাবেই এটা বলেছেন যে আফগানিস্তানে যে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে, শাসনকাঠামো যেভাবে দুর্নীতিকে আশ্রয় দিয়েছে, অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টায় যে ব্যর্থতা থেকে গেছে এবং বিদেশি প্রভাব যেভাবে দৃশ্যমান থেকেছে, তাতে করে তালেবানকে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করা সম্ভব হয়নি। আফগান সমাজে তালেবানের সমর্থক আছে, তাদের রাজনৈতিকভাবে অঙ্গীভূত না করে সামরিকভাবে মোকাবিলা করতে গিয়ে অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। তবে এটাও ঠিক যে এই সময়ে আফগানিস্তানের সমাজে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনও ঘটেছে, যেগুলো তালেবান ক্ষমতায় থাকার সময়ে অকল্পনীয় ছিল। এ রকম প্রেক্ষাপটেই তালেবানের সঙ্গে শান্তি আলোচনা হয়েছে, কিন্তু তাতে অগ্রগতি হয়েছে সামান্যই।

তালেবানের প্রত্যাবর্তনের যে হিসাব-নিকাশ হচ্ছে, তাতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ভূরাজনীতির প্রশ্ন। আফগানিস্তানের ইতিহাস বলে যে দেশটি হাজার হাজার বছর ধরেই বড় শক্তিগুলোর ভূরাজনীতির খেলার ময়দান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। পারস্য সাম্রাজ্যের আক্রমণ, আলেকজান্ডারের অভিযান, চেঙ্গিস খানের হামলা, ব্রিটিশদের যুদ্ধ, সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন, মার্কিনদের উপস্থিতির পেছনে থেকেছে ভূরাজনৈতিক বিবেচনা। বিংশ শতাব্দীতে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আঞ্চলিক শক্তি পাকিস্তান ও ভারত; প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই দুই দেশ আফগানিস্তানে প্রভাব রেখেছে। তুরস্ক ও ইরানও তাদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার প্রবেশদ্বারে থাকা দেশটি দখল বা অন্ততপক্ষে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে সবাই। ভূগোলের অভিশাপ বইতে হয়েছে আফগানিস্তানের জনগণকে। তারা প্রতিটি চেষ্টাকেই নস্যাৎ করেছে, কিন্তু এর জন্য তাদের গুনতে হয়েছে বড় রকমের মাশুল।

এখনো যখন আলোচনার কেন্দ্রে এই ভূরাজনীতির বিবেচনাই প্রাধান্য পাচ্ছে, তখন মনে রাখা দরকার যে এই খেলার ক্রীড়নক ও কুশীলবেরা ভিন্ন হলেও এর পরিণতি ভিন্ন হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। এখনকার প্রধান কুশীলব হচ্ছে পাকিস্তান, ভারত, চীন ও রাশিয়া। ২০০১ সালের পর থেকে কাবুলে প্রতিষ্ঠিত সরকারের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সখ্যের কারণে এবং যেহেতু তালেবান পাকিস্তানের মদদপুষ্ট, সেহেতু সবার প্রশ্ন হচ্ছে, তালেবান ক্ষমতায় এলে ভারত কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ভবিষ্যতে পাকিস্তানের ভূমিকা কী হবে। চীনের সঙ্গে তালেবানের যোগাযোগ ২০১৮ সাল থেকেই, কিন্তু সম্প্রতি তালেবান প্রতিনিধি মোল্লা বারাদার আখুন্দের সঙ্গে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর বৈঠকের কারণে গণমাধ্যমে আলোচ্য বিষয় হচ্ছে চীন আফগানিস্তানে কী চায় এবং দক্ষিণ এশিয়ায় এর কী প্রতিক্রিয়া হবে।

এসব প্রশ্নের উত্তর একার্থে খুব জটিল নয়। পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে তালেবানকে আশ্রয় দিয়েছে আফগানিস্তানে তাদের পছন্দের সরকার নিশ্চিত করতে, ভারতের প্রভাব হ্রাস এবং মধ্য এশিয়ায় প্রবেশের পথ করতে। ভারতের ক্ষেত্রেও উদ্দেশ্য একই; তবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তালেবানের সঙ্গে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে দেশটির উদ্বেগ।

তালেবান নেতাদের সঙ্গে চীনের যোগাযোগ ও বৈঠকে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। চীনের লক্ষ্য হচ্ছে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের একটি প্রধান প্রভাবশালী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হওয়া এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমা দেশগুলোর নেতৃত্বে যে উদার বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তার বিকল্প হাজির করা। সেই লক্ষ্যেই ২০১৩ সালে বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের সূচনা। আফগানিস্তান সেই অর্থে ভিন্ন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চাদপসরণ চীনকে সেই সুযোগ করে দিয়েছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে চীনের কাছে আফগানিস্তানের আরও দুটি গুরুত্ব আছে।

প্রথমত, নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট। ১৯৮২ সালের নভেম্বরে তৎকালীন চীনা নেতা দেং শিয়াও পিং বলেছিলেন, ‘আফগানিস্তানের সমস্যার বৈশ্বিক কৌশলগত গুরুত্ব আছে। চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যে সীমান্ত আছে, এটা ভৌগোলিকভাবে চীনকে ঘিরে ফেলার কাজে ব্যবহার হতে পারে।’ চীনের এখনকার নেতারা এটা ভুলে যাননি। এখন বরং উইঘুরের মুসলিমদের ওপর নিবর্তনমূলক ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে চীন উদ্বিগ্ন যে তার জিয়াংজিং প্রদেশে সহিংস উগ্রবাদ বিস্তার লাভ করে কি না। এ জন্য চীন ইস্ট তুর্কেস্তান ইসলামিক মুভমেন্টকে (ইটিআইএম) দায়ী করে। তারা চায়, আফগানিস্তানের সরকার ইটিআইএমকে আশ্রয়-প্রশ্রয় যেন না দেয়। সেটা নিশ্চিত করতেই তালেবানের ওপর নির্ভর করছে চীন।

শুধু ইটিআইএম নয়, চীন আফগানিস্তানে আল-কায়েদা বা আইসিসের উপস্থিতির আশঙ্কাও করে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে অর্থনৈতিক। গত কয়েক বছরে চীন আফগানিস্তানে যা বিনিয়োগ করেছে, তা সুরক্ষা করতে চায়। এই দুই কারণে চীনের দরকার স্থিতিশীল আফগানিস্তান, সেখানে কে ক্ষমতায় থাকল, তা তার বিবেচ্য নয়।

দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার প্রবেশদ্বারে থাকা আফগানিস্তানকে দখল বা অন্ততপক্ষে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে সবাই। ভূগোলের অভিশাপ বইতে হয়েছে আফগানিস্তানের জনগণকে। তারা প্রতিটি চেষ্টাকেই নস্যাৎ করেছে, কিন্তু এর জন্য তাদের গুনতে হয়েছে বড় রকমের মাশুল।

স্থিতিশীলতা এবং কোনোভাবে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হওয়ার বিবেচনা কেবল চীনের নয়, একই চিন্তা ইরানেরও। ফলে তালেবানের ব্যাপারে ইরানের দৃষ্টিভঙ্গিও আর আগের মতো নেই। ইরান এতেই আনন্দিত যে তার দোরগোড়ায় যুক্তরাষ্ট্র উপস্থিত থাকছে না। চীন তালেবান সামলালে তাতে ইরানের লাভ। রাশিয়া সরকারিভাবে তালেবানকে সন্ত্রাসী সংগঠন বললেও জুলাইয়ে তাদের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেছে এবং আশা করছে যে তালেবানের সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে মধ্য এশিয়ায় বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোতে সন্ত্রাসী সংগঠনের বিস্তার বন্ধ করা যাবে।

বিশ্লেষক ও বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারকেরা আশা করছেন, গত ২০ বছরে তালেবান নেতৃত্বের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন ঘটেছে। সেই পরিবর্তনের কী লক্ষণ দেখা গেছে, তা স্পষ্ট নয়। একইভাবে ক্ষমতায় থাকার সময় তালেবান যে নিপীড়নমূলক শাসন চালিয়েছে, ভবিষ্যতে তা থেকে সরে আসবে, এমন কোনো প্রতিশ্রুতি তালেবান দেয়নি। যেসব এলাকায় তালেবান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে, সেখানে তাদের আচরণ এমন কোনো পরিবর্তনেরও ইঙ্গিত দেয় না। ফলে তালেবানের ক্ষমতায় আসীন হওয়া নিয়ে উদ্বেগ যথাযথ।

কাবুলে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে তালেবানের অন্যতম অভিযোগ হচ্ছে, এই সরকার আফগানিস্তানের জনগণের এক বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব করে না। প্রশ্ন হচ্ছে, তালেবান যদি ক্ষমতায় যায়, তারা আফগানিস্তানের বহুত্ববাদিতাকে, ভিন্নমতকে সম্মান করবে কি না। নাগরিকদের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার, নারীদের সমানাধিকার, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, শিক্ষার বিস্তারসহ বিভিন্ন বিষয়ে গত দুই দশকে যেসব পরিবর্তন ঘটেছে; সেগুলোকে তালেবান ধ্বংস করে দেবে না, এর নিশ্চয়তা কোথায়? মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার গ্যারান্টি তালেবানের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে, এমন নয়।

দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, ভূরাজনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থ বিবেচনা করে চীন, রাশিয়া, ইরান তালেবানের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলছে; কিন্তু আফগান নাগরিকদের ভাগ্যে কী ঘটবে, তা নিয়ে কেউই তালেবানকে প্রশ্ন করছে না। আফগান সমাজে তালেবানের আদর্শের বাইরে নাগরিকেরা আছে, বিশেষ করে গত দুই দশকে পরিবর্তনের কারণে যে জনগোষ্ঠীর বিকাশ ঘটেছে, তাদের বাদ দিয়ে অংশগ্রহণমূলক শাসন গড়ে তোলা যাবে না। তালেবান এককভাবে বা অন্যদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে ক্ষমতায় গেলে, সেটা করতে রাজি আছে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট