গত ২৯ ও ৩০ মে সিলেট শহরের কাছে ৩ থেকে ৪ মাত্রার কয়েকটি ভূমিকম্প হয়েছে। বিশেষ কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া না গেলেও সিলেট শহর এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ৬টি মার্কেট এবং ২১টি ভবনের কার্যক্রম ১০ দিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই কম্পন আশীর্বাদও হতে পারে। একটি বড় ভূমিকম্পের শক্তি এসব ছোট ভূমিকম্পের মাধ্যমে অনেকটা কমে আসে। আবার এমনও হতে পারে, এসব কম্পন বড় একটি ভূমিকম্পনের পূর্বাভাস। মানুষ সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারে না, সেটাই মানুষের সীমাবদ্ধতা। তবে আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রস্তুতি গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।
পৃথিবীর যে ছয়টি অঞ্চলকে ভূমিকম্পের দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হয় তার একটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল। সিলেট থেকে বেশি দূরে নয় এই অঞ্চল। এখানে ১৮৯৭ সালের ১২ জুন বিকেল ৫টা ১১ মিনিটে ৮ দশমিক ১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। এটি আসাম আর্থকোয়েক বা দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক নামে পরিচিত। উৎসস্থল কমবেশি ঢাকা থেকে ২৫০, সিলেট থেকে ১৩০, ময়মনসিংহ থেকে ১৫০ এবং ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে ছিল। ১৮১২, ১৮৮৫ ও ১৯১৮ সালে বাংলাদেশে যেসব ভূমিকম্প হয়েছিল, আসাম ভূমিকম্পে তার চেয়ে বেশি তীব্রতায় কেঁপে উঠেছিল আজকের বাংলাদেশ। তখন লোকসংখ্যা ও পাকা স্থাপনা—দুটোই খুব কম ছিল। তাই এই ভূমিকম্পে পুরো ভারতে লোক মারা যায় ১ হাজার ৫৪২ জন। তার মধ্যে ঢাকায় মারা যায় দুই বিদেশিসহ পাঁচজন। তখনকার দেড় লক্ষাধিক টাকার মধ্যেই ঢাকার বিধ্বস্ত পাকা দালান, রাস্তাঘাট এবং অন্যান্য স্থাপনা পুনর্নির্মাণ করা সম্ভব হয়। সেই ভূমিকম্পটির বয়স ১২ জুন ১২৪ বছর হবে।
একটা ঝাঁকুনি দিলেই আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। আতঙ্কিত না হয়ে ভূমিকম্প আবারও হতে পারে, এটা মাথায় রেখেই সে মতো আমাদের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। কারণ ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, টেকটনিকের ইতিহাস এবং ভূমিকম্প—এই তিনের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্ক বলছে, একবার যেখানে ভূমিকম্প হয় শত বছর পর আবারও সেখানে একই মাত্রায় ঘটতে পারে। তবে ঠিক কত বছর পর আবার ফিরে আসবে, বিশেষজ্ঞের পক্ষেও তা সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। এ জন্য প্রয়োজন ভূমিকম্প মোকাবিলায় সচেতনতা ও প্রস্তুতি। ১৮৯৭-এর ভূমিকম্পটি যদি আবার ঘটে, তবে কী হবে? সেবার ঢাকা কেঁপেছিল মডিফাইড মার্সিলি ইনটেনসিটি (এমএমআই) স্কেলের রোমান ৭-এর অধিক তীব্রতায়। তখন পাকা দালান এবং জনসংখ্যা খুব কম থাকায় ক্ষয়ক্ষতি এবং হতাহত হয়েছিল খুবই কম। সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের আজকের বাংলাদেশ কয়েক কোটি লোক কয়েক লাখ পাকা দালানে ধারণ করা একটি দেশ।
ভূমিকম্পে মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত ভূমিকম্পসহনশীল ভবন।
আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সনাতনী ইট দিয়েই নির্মাণ করা হতো পাঁচতলা ভবন। তারপর থেকে ক্রমে আরসিসি (রিইনফোর্সড সিমেন্ট কনক্রিট) ফ্রেমের ওপর দালান নির্মাণ হতে থাকে। তারপরও ভূমিকম্পের দৃষ্টিকোণ থেকে নতুন এই ভবনে অনেক রকমের ত্রুটি বর্তমান। দেশের শহরগুলোতে ইদানীং তৈরি হওয়া ভবনগুলোর ত্রুটি চিহ্নিত করে সেগুলো শক্তিশালী করা দরকার। দেখা যাক এই ভবনগুলোতে মূল ত্রুটিগুলো কী কী।
ভবনের কার পার্কিং তলাটিতেই সবচেয়ে বড় ত্রুটি বিদ্যমান। প্রায় প্রতিটি নতুন আবাসিক ভবনেই এই ত্রুটি দেখা যায়। ইউএনডিপির অর্থায়নে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরোর এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় সব আবাসিক ভবনের নিচতলার কার পার্কিং তলাটি শুধু কলামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু একই ভবনের ওপরের তলাগুলোতে, যেখানে মানুষজন বাস করে, বিম-কলাম কাঠামোর মধ্যে ইটের কাজ করা বহু দেয়াল থাকে। ফলে পার্শ্বশক্তি সহনশীলতার বিচারে কার পার্কিং তলাটি ওপরের বাসযোগ্য তলার চেয়ে দুর্বল। প্রকৌশলের ভাষায় এ ধরনের তলাকে বলে সফট স্টোরি।
ভূমিকম্পের মুহূর্তে একটি ভবন কর্তনীয় ও বক্রনীয় পীড়ন দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই দুই পীড়নের প্রভাব একটি ভবনের ওপর থেকে যতই নিচের দিকে নামতে থাকে, ততই বাড়তে থাকে। যেহেতু কার পার্কিং তলাটি ভবনের সর্বনিম্ন তলা, তাই এই তলায় সবচেয়ে বড় মাত্রার কর্তনীয় ও বক্রনীয় পীড়ন কাজ করে। তবে নিম্ন বা মধ্য উঁচু তলা ভবনের ক্ষেত্রে বক্রনীয়র চেয়ে কর্তনীয় পীড়নের প্রভাব বেশি, এই কারণেই ভবন সহজে বিধ্বস্ত হয়। বাংলাদেশে এই বিষয়ে সচেতনতার প্রচণ্ড অভাব।
আরেকটি ত্রুটি হচ্ছে বিম বাদ দিয়ে শুধু পুরু স্ল্যাব দিয়ে ভবন নির্মাণ। এতে নির্মাণ ব্যয় অধিক, তারপরও নির্মাতা-ক্রেতা সবার কাছে এটা জনপ্রিয়, কারণ বিম থাকে বলে দেখতে সুন্দর, ফ্ল্যাটের ভেতরে কক্ষ পুনর্বিন্যাস ও নির্মাণকাজ সহজ। কিন্তু মোটা পুরু স্ল্যাবের কারণে ভবনের প্রতি তলার ওজন বেড়ে যায়। ভূমিকম্পের মুহূর্তে এই ওজন বেশি পার্শ্বশক্তির জোগান দেয়, ফলে সহজেই বিধ্বস্ত হয় ভবন। ভারী ম্ল্যাবটি ভূমিকম্পের মুহূর্তে দুর্বল কলামটিকে কর্তনীয় পীড়নে বিধ্বস্ত করে।
এ জন্য স্ল্যাবের পুরুত্ব যত বেশি, ভবন তত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। একটির ওপর আরেকটি ফ্ল্যাট প্লেট বিধ্বস্ত হয়ে স্যান্ডউইচ আকার ধারণ করে, এ কারণে প্রাণহানি হয় বেশি। তাই ফ্ল্যাট প্লেট পরিহার করে বিম-স্ল্যাব দিয়ে ভবন করতে হবে।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ভবনের নিচে পাইলের ক্যাপগুলো (মাথা) টাইবিম দিয়ে সংযুক্ত না করা। কম্পনের মুহূর্তে পাইলগুলো পার্শ্বশক্তির বিরুদ্ধে যাতে একজোট হয়ে কাজ করে, সে জন্য পাইলের ক্যাপগুলো টাইবিম দিয়ে সংযুক্ত করে দেওয়া অত্যাবশ্যক। বেশির ভাগ ভবনেই এই ত্রুটি বিদ্যমান। এই ত্রুটি পর আর সংশোধনের উপায় নেই। কারণ এটি ভবনের নিচে, মাটির তলের সমস্যা। নতুন ভবন তৈরির সময় তাই পাইলের মাথাগুলো আরসিসির টাইবিম দিয়ে সংযুক্ত করে দেওয়া দরকার।
যেসব ভবন সফট স্টোরি বা পুরু স্ল্যাব দ্বারা তৈরি হয়ে আছে, সেসবের নিচতলা রেট্রোফিটিং করা দরকার। রেট্রোফিটিং হলো একটি দুর্বল কাঠামোকে শক্তিশালীকরণ। কাঠামোটি যখন নির্মিত হয়েছিল, তখন অজ্ঞতাবশত বা যেকোনো কারণেই হোক, দুর্বলভাবে নির্মিত হয়েছিল। দুর্বলতার বিষয়টি নজরে আসার পর তাকে প্রয়োজনীয় শক্তিশালীকরণই হচ্ছে রেট্রোফিটিং। ফাটল ধরা পড়ার পর রানা প্লাজার কলামগুলো যদি রেট্রোফিটিং করা হতো, তবে খুব সহজেই বিপর্যয় এড়ানো যেত। কলামকে আরসি জ্যাকেটিং করে এবং দুই কলামের মাঝে ব্রেসিং, সিয়ার ওয়াল বা উইং ওয়াল করে দুর্বল কার পার্কিং তলাটিকে রেট্রোফিটিং করা যায়। তার জন্য সবার আগে দরকার ভবনমালিকদের সচেতনতা। মনে করি, একটি ভবনে ২৪টি ফ্ল্যাট। অর্ধেক মালিক হয়তো রেট্রোফিটিং করতে রাজি হলেন, বাকিরা হলেন না। ভূমিকম্প কবে হবে না হবে, সে জন্য তাঁরা টাকা খরচ করতে নারাজ। অথচ ২০-২৫ কোটি টাকার একটি ভবনের ত্রুটি ২০ লাখ টাকা খরচ করেই সংশোধন করা যেত।
ভবনের নকশা ও কাঠামোর ডিজাইন করার সময় উল্লিখিত ত্রুটির বিষয়গুলো স্থপতি ও কাঠামো প্রকৌশলীর মাথায় থাকা দরকার। ঢাকার রাজউকসহ দেশের অন্যান্য শহরে প্ল্যান অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ যেন কার পার্কিং তলাটিতে বিম-কলামের সঙ্গে আরসি ব্রেসিং বা সিয়ার ওয়াল বা উইং ওয়াল থাকা বাধ্যতামূলক করে। ফ্ল্যাট প্লেট দিয়ে যেন ভবন না করে। নির্মাণের প্রাথমিক পর্যায়ে এসব আরসি ব্রেসিং বা সিয়ার ওয়াল বা উইং ওয়াল সঠিকভাবে নির্মাণ করলে অনেক কম খরচে ত্রুটিমুক্ত ভবন নির্মাণ সম্ভব হবে। এ ছাড়া দেশের পাঁচটি কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় ও সব কটি কারিগরি প্রতিষ্ঠানে রেট্রোফিটিং বিষয়টি পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা খুবই জরুরি।
ড. আলী আকবর মল্লিক কাঠামো প্রকৌশলী ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ