২৬ নভেম্বর ঢাকায় সূর্য ওঠার আধা ঘণ্টা আগে একটি ঝাঁকুনি অনুভূত হয়। এ সময় বেশির ভাগ মানুষই ঘুমিয়ে থাকায় ঝাঁকুনিটা টের পায়নি। যাঁরা সময়মতো নামাজ পড়ার তাগিদে বা অন্য কোনো কারণে উঠেছেন, তাঁরা টের পেয়েছেন। তাঁদের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভূমিকম্পটির কথা জানান দিয়েছেন। অনেকেই শুকরিয়া আদায় করেছেন এর চেয়ে বড় ঝাঁকুনি কিংবা বড় ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্তের কাছে অবস্থিত মিয়ানমারে চিন রাজ্যের রাজধানী হাখা শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ৪২ কিলোমিটার মাটির গভীরে। এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৮; ঘটেছে বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টা ৪৫ মিনিটে।
ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল চট্টগ্রাম থেকে ১৯০, কক্সবাজার থেকে ২১০ ও ঢাকা থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে। এই ভূমিকম্পের কারণে ঢাকা বা চট্টগ্রাম কতটা তীব্রতায় (মোডিফাইড মার্সিলি ইনটেনসিটি স্কেল বা এমএমআই স্কেল) কেঁপেছে, সেটাই আমাদের কাছে গুরুত্বের। এর মাত্রা, গভীরতা ও দূরত্বের বিচারে চট্টগ্রাম রোমান পাঁচের কম ও ঢাকা চার স্কেলে হতে পারে বলে মনে হয় (নিবন্ধকারের ব্যক্তিগত মতামত)। এসব মৃদু কম্পন বলে মানুষ টের পেলেও বিধ্বংসী নয়। তবে দুর্বল ভিতের কোনো স্থাপনা হেলে পড়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। তবে এমন ছোট তীব্রতার ভূকম্পন হলেও বাংলাদেশে যাঁরা টের পান, তাঁরা দৌড়ঝাঁপ করার প্রবণতায় থাকেন। এবারের ভূমিকম্পের কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র হলের দোতলা থেকে লাফ দিয়েছেন।
কম্পন হলে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে দৌড়ঝাঁপ করবেই। তাই ভূমিকম্পসহনীয় ভবন নির্মাণ করলে সেখানে বাস করা বাসিন্দারা ঝাঁকুনির সময় ভবনের ওপর আস্থা থাকায় আতঙ্কিত হয়ে দৌড়ঝাঁপ করবে না। ভূমিকম্পসহনীয় ভবন নির্মাণের পূর্বশর্ত হতে হবে দেশের প্রচলিত বিল্ডিং কোড মেনে ভবনের ডিজাইন করা। এ বিষয়ে সদিচ্ছা না থাকলে ভবন বিধ্বস্ত হতে যে ভূমিকম্পও দরকার হয় না, তা আমরা রানা প্লাজার ঘটনায় দেখেছি।
এমন ভূমিকম্প বছর কয়েক ধরে ঘটেছে নেপাল (এপ্রিল ২০১৫, মাত্রা ৭.৮), ভারত (জানুয়ারি ২০১৬, মাত্রা ৬.৯) ও মিয়ানমারের (এপ্রিল ২০১৬, মাত্রা ৬.৭) ভূখণ্ডে। ভূমিকম্পগুলো ঢাকাসহ দেশের বড় শহর থেকে অনেক দূরে হওয়ার কারণে বড় তীব্রতায় কাঁপেনি। ক্ষয়ক্ষতি বলতে আতঙ্কিত হয়ে কিছু প্রাণহানি। ভবন বা অন্যান্য কাঠামগত ক্ষয়ক্ষতি উল্লেখযোগ্য নয়। গত মে মাসের শেষ দিকে সিলেটের অদূরে কম সময়ের ব্যবধানে কয়েকটি মৃদু ভূমিকম্প ঘটে সিলেটবাসীকে আতঙ্কিত করেছিল। এসব ঘটনা ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ভারতের আসাম বেসিনে রিখটার স্কেলে ৮-এর অধিক মাত্রায় ঘটা দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েকের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কারণ, ওই ভূমিকম্প আবার কোনো রিটার্ন পিরিয়ডে ফিরে আসতে পারে। এমন বেশি মাত্রার ভূমিকম্প ভারতের আসাম বেসিনে ঘটলে ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলো অধিক তীব্রতা, যথা এমএমআই স্কেলের রোমান সাত বা তার বেশি স্কেলে কাঁপবে।
ভূমিকম্পের জন্য অবকাঠামোগত প্রস্তুতি আমাদের কতটা আছে, সেটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের। জাপানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প বারবার প্রমাণ করেছে ভূমিকম্পে প্রস্তুতি ও সচেতনতা ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারে। মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই যে ভবন, সেটি যদি থাকে ত্রুটিপূর্ণ, তবে কম্পন হলে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে দৌড়ঝাঁপ করবেই। তাই ভূমিকম্পসহনীয় ভবন নির্মাণ করলে সেখানে বাস করা বাসিন্দারা ঝাঁকুনির সময় ভবনের ওপর আস্থা থাকায় আতঙ্কিত হয়ে দৌড়ঝাঁপ করবে না। ভূমিকম্পসহনীয় ভবন নির্মাণের পূর্বশর্ত হতে হবে দেশের প্রচলিত বিল্ডিং কোড মেনে ভবনের ডিজাইন করা। এ বিষয়ে সদিচ্ছা না থাকলে ভবন বিধ্বস্ত হতে যে ভূমিকম্পও দরকার হয় না, তা আমরা রানা প্লাজার ঘটনায় দেখেছি।
ভবন ডিজাইন ও নির্মাণে মোটাদাগে নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করছি:
(১) প্লটগুলো সাধারণত আয়তাকার হয়ে থাকে। পরিকল্পনা করেন যে স্থপতি, তাঁকে আয়তাকার প্লটটিতে যতটা সম্ভব একটি ভারসাম্য নকশা করতে হবে। শতভাগ ভারসাম্য রক্ষাকারী নকশা কখনো সম্ভব নয়, তবে যত দূর সম্ভব কম একসেনট্রিসিটির নকশা করা দরকার। কাত হওয়া একটি জাহাজ সাগরে চলতে গিয়ে ঝড়ের কবলে পড়ে যেমন সহজেই ডুবে যেতে পারে, তেমনি বেশি একসেনট্রিক ভবন সহজে ধসে পড়বে।
(২) নকশা হয়ে গেলে কাঠামো প্রকৌশলী ডিটেইল ডিজাইন করে ওয়াকিং ড্রয়িং করবেন। ভূমিকম্পসহনীয় ভবন নির্মাণ করতে কাঠামো প্রকৌশলী সবচেয়ে গুরুত্ব ভূমিকা রাখেন। দেশের প্রচলিত বিল্ডিং কোড মেনে ডিজাইন করবেন। বাংলাদেশে হাজারো বিল্ডিং ডিজাইনে এ পর্যন্ত যেসব ভুলগুলো করা হয়েছে, তা তাঁকে এড়িয়ে চলতে হবে।
(ক) আজকাল খাল, বিল, ঝিল ও পুকুর ভরাট করে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। ছোট দেশ, লোক বেশি বলে কথা। ভরাটের আগে পরীক্ষা করা দরকার খারাপ মাটি আছে কি না। থাকলে বালু দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে। তারপর ভরাট করতে পুরকৌশলের কৌশলগুলো প্রয়োগ করতে হবে জিওটেক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে দক্ষ ফার্ম বা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুসারে। তা না হলে যতই ৭০ থেকে ১০০ ফুট পাইল করা হোক, ভূমিকম্পে ভবন হেলে পড়ার শঙ্কা থেকে যাবে। কারণ, পাইলগুলো ভবনের উলম্বের ভর বহন করার সক্ষমতা থাকলেও ভূমিকম্পের পার্শ্বশক্তি ঠেকানোর সক্ষমতা নাও থাকতে পারে। পাইলের ক্যাপগুলো আরসিসির নির্মিত টাই-বিম দ্বারা যুক্ত করে দিতে হবে, যেন পার্শ্বশক্তি প্রতিরোধে সব পাইল একযোগে কাজ করতে পারে।
(খ) কার পার্কিংয়ের তলাটির সঠিক ডিজাইন হচ্ছে না। কার পার্কিংয়ের তলার ঠিক ওপরে বসবাসের তলাটিতে অনেকগুলো ইটের তৈরি ওয়াল নির্মাণ করা হয়, যা ভূমিকম্পের মুহূর্তে কলামের সঙ্গে পার্শ্বশক্তির জোগান দেয়। কার পার্কিংয়ের তলাটিতে শুধু কলাম থাকায় ওপরের তলাটির চেয়ে এই তলা দুর্বল। অথচ এই তলায় ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট পার্শ্বশক্তি সবচেয়ে বেশি কাজ করে। তাই এই তলায় কলামের সঙ্গে সাহায্যকারী শেয়ার-ওয়াল, উইং-ওয়াল, ব্রেসিং, কলাম-জ্যাকেটিং ইত্যাদি ব্যবহার করা দরকার। ফ্ল্যাট স্ল্যাব দিয়ে আবাসিক ও কম উঁচু ভবন ডিজাইন না করাই ভালো।
(৩) কাঠামো প্রকৌশলী ওয়াকিং ড্রয়িং করেন অফিসের ডেস্কে বসে। সেই ওয়াকিং ড্রয়িং অনুসারে সাইটে কাজ যদি না হয়, তবে সব কষ্ট বৃথা। সাইটে একজন নির্মাণ তদারকিতে পারদর্শী ও অভিজ্ঞ প্রকৌশলী নিয়োগ করা দরকার। তাঁর দায়িত্বে ব্যবহৃত সব ম্যাটেরিয়ালের ইঞ্জিনিয়ারিং টেস্ট হতে হবে। এ ছাড়া বিম, কলাম, স্ল্যাব ও বিম-কলাম জয়েন্টে ব্যবহৃত রডের বিন্যাস সঠিকভাবে হতে হবে। নির্মাণ সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, তা যাচাই করার জন্য রাজউক অনুমোদিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ হওয়া দরকার।
ভবন নির্মাণে আমাদের সদিচ্ছার অভাব থাকা এবং ভবনধসে চাপা পড়ে এত লোক মারা যাবে বলে আতঙ্কিত হওয়ার মধ্যে নেতিবাচক ছাড়া ইতিবাচক কিছু নেই। ভবন নির্মাণে সদিচ্ছার অভাব কী অভাবনীয় পরিণতি ডেকে আনে, তা আমরা রানা প্লাজা থেকে দেখেছি। নিরাপদ বাসস্থান নির্মাণ জীবনের সবচেয়ে বড় বিমা হবে, যদি একটি মধ্য তীব্রতার (এমএমআই ৭-৮) ঝাঁকুনিতে কাপে বাংলাদেশ।
ড. আলী আকবর মল্লিক কাঠামো প্রকৌশলী, ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ