ভূমধ্যসাগর নয়, এই দূষণ মনোমধ্য সাগরের

আকাশপথে নিউইয়র্ক থেকে কাতার হয়ে ঢাকা ফিরেছি। কাতার থেকে ঢাকার ফ্লাইটে আমার আসন পড়েছিল বিমানের বাঁ দিকে। সকালবেলা বিমানের জানালা দিয়ে হিমালয় পর্বতমালার চূড়া দেখা যাচ্ছিল। স্পষ্ট, ঝকঝকে। সকালের রোদ পড়েছে চূড়ায়।

আহা, এই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দার্জিলিং গিয়ে পরপর দুদিন ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে টাইগার হিল না যেন কোন চূড়ায় গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। দুদিনই মেঘ ছিল, কুয়াশা ছিল, দেখার সৌভাগ্য হয়নি। অথচ যেদিন প্রথম দার্জিলিং গিয়ে পৌঁছেছিলাম, তার পরদিন সকালে হোটেলের বারান্দা থেকে, মল থেকে, বাজার থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা এমনিতেই দেখা যাচ্ছিল। আপনা এসে ধরা দিয়েছিল বলে দাম দিইনি। আর পরে নিজে অন্ধকার রাতে শীতে কাঁপতে কাঁপতে জিপে চড়ে পাহাড়ি পথ পেরিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে গিয়ে দেখতে না পেয়ে মনে হয়েছিল, কী হারালাম। এই জন্যই লোকে বলে, কারও কাছে নিজে থেকে গিয়ে ধরা দেবে না। সব সময় নিজেকে দুষ্প্রাপ্য রহস্যময় করে রাখবে। তাহলে দাম পাবে!

তো এই ডিসেম্বরের ৫ তারিখের সকালে বিনা পয়সায় হিমালয় রেঞ্জ দেখলাম প্লেনের জানালায় বসে। এই রেঞ্জ দেখতে নেপালের নাগরকোটে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে হোটেলের ছাদের ঘরে বসে থেকেছি। ১০০ ডলার করে টিকিট কেটে নেপালের উড়োজাহাজ অগ্নিতে উঠে বিশেষ উড়াল দিয়েছি। সে আরেক মর্মান্তিক কাহিনি। অগ্নি এয়ারলাইনসের তিনটা উড়োজাহাজ ছিল। আমাদের নিরাপদে নামিয়ে দেওয়ার তিন মাসের মধ্যে তিনটাই অ্যাকসিডেন্ট করেছে। বহু ট্যুরিস্ট, বিমানসেবিকা, পাইলট মারা গেছেন। বেঁচে যে আছি, সেটাই বিস্ময়। এখনো নিজের গায়ে নিজে চিমটি কাটছি। বেঁচে আছি তো!

এবার তো পঞ্চগড় থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গেছে। এই নিয়ে ফেসবুকাররা দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। আমাদের বিভক্তির জন্য ইস্যু লাগে না। আমরা এমনি এমনি বিভক্ত থাকি!

তো, কাতার টু ঢাকা সারাটা পথ ঝকঝকে দিন, মেঘের ওপরে সূর্য, নিচে ভেড়ার গায়ের মতো ফোলা ফোলা মেঘমালা দেখতে দেখতে আসছি। একটু পরেই বোঝা গেল, বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছি। কেমন করে?

কৌতুকটা বলে নিই।

এক লোক বলছে, আমি লন্ডন গেলাম গাড়িতে, জানালা দিয়ে বাইরে হাত রাখতেই বুঝলাম, এটা লন্ডন। ঠান্ডা আর বৃষ্টি। একজন বলল, আমি গেলাম মেলবোর্ন। জানালা দিয়ে বাইরে হাত রাখতেই বুঝলাম, এটা মেলবোর্ন। রোদের মধ্যে আল্ট্রা ভায়োলেট রে। আরেকজন বলল, আমি গেলাম ঢাকা। জানালা দিয়ে বাইরে হাত রাখতেই বুঝলাম, এটা কারওয়ান বাজার। আমার হাতের মোবাইলটা ছোঁ মেরে কে যেন নিয়ে গেল।

আমিও বাংলার আকাশে চোখ রাখার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে গেলাম, এটা বাংলাদেশ। ঢাকার কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা গেল, এটা ঢাকা। কী করে? কারণ পুরো ঢাকা ধোঁয়াশা আর ধুলাশায় ঢাকা। ভিজিবিলিটি প্রায় জিরো। শঙ্কা হলো, প্লেন আবার ফিরে কাতার চলে যাবে না তো? ঢাকায় নেমেছি সকাল সাড়ে ১০টায়। এয়ারপোর্ট থেকে বেরোলাম বেলা সাড়ে ১১টায়। পুরো ঢাকা কুয়াশা, ধোঁয়াশা, ধুলাশায় বিবর্ণ। মলিন।

প্রথম আলো ১০ ডিসেম্বর শেষ পৃষ্ঠায় বড় বড় করে লিখেছে, ঢাকায় ভূমধ্যসাগরের কুয়াশা। ঢাকার কুয়াশা নাকি ভূমধ্যসাগর থেকে মেঘে মেঘে গড়িয়ে গড়িয়ে আসা। বিজ্ঞানীরা বলেছেন। তাঁরা কত–কী কিছুই তো বলেন।

বাসায় এসে দেখি, প্রতিটা কোনায়, বইয়ে, পত্রে, টেবিলে, বিছানায় ধুলার আস্তর। বারান্দায় গাছের পাতাগুলো দুই ইঞ্চি ধুলার নিচে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরমর। পানি এনে গাছের পাতায় ঢালতেই মেরিনার চিৎকার, ‘কাদা হবে তো!’ আমি বললাম, ‘আলবত হবে, গাছের পাতায় দুই ফুট ধুলা, তাতে পানি ঢাললে তো কাদাই হবে। হোক। তবু ধুলায় ঢাকা গাছের পাতা অসহ্য।’

ভূমধ্যসাগর থেকে মেঘ আসতে পারে, আপনি ঢাকার যেকোনো গাছের দিকে একবার তাকান। আপনি মানুষ হলে আপনার কান্না পাবে। ধুলা আর ধুলা। ঢাকাকে ঘিরে রেখেছে ইটের ভাটা শত শত। আমাদের নির্মাণকাজ মানেই ধুলা ওড়ানোর উৎসব। ঢাকার বাতাসের মানকে ‘হ্যাজারডাস’ বলা হচ্ছে। অবশ্যই এটা শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এই রকম বায়ুমানের শহরে মারা যাওয়ার জন্য কোভিড লাগে না। আমরা এমনিতেই প্রতিবছর শ্বাসরোগে নিউমোনিয়ায় হাজারে হাজারে মরি।

ঢাকার বাতাস এবং বাংলাদেশের বাতাসের মান ভালো করার জন্য একটা কর্মসূচি নেওয়া জরুরি। নির্মাণকাজে পৃথিবীব্যাপী মেনে চলা বিধিমালা মানতে বাধ্য করা, ইটের ভাটা ইত্যাদির জ্বালানির মান, দূষণের মান নিয়ন্ত্রণে রাখা, অকারণে ময়লার স্তূপে, খড়ের গাদায় আগুন না লাগানো—নানা রকমের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

ডেইলি স্টার-এ কার্টুন দিয়েছে, বাতাসে দূষণ দেখে একজন টাকার গন্ধ পাচ্ছেন, নতুন প্রজেক্ট আসছে। খুশিতে তিনি বাগবাগ।

করোনা এসেছে। করোনা চলে যাবে। তবে মাস্ক পরে থাকতেই হবে। ঢাকার বাতাসে করোনার চেয়েও ভয়াবহ সব উপাদান গিজগিজ করছে, থকথক করছে। আর? আর? আর আমাদের বাতাস দূষিত, এয়ারপলুশন আমাদের সমস্যা। এর কারণ আমাদের দূষণ আসলে আমাদের বিবেকে। ধুলার আস্তর পড়ে আছে আমাদের দুই চোখে। আমাদের প্রকল্প আর কর্মসূচি মানেই পুকুরচুরি। প্রকল্প আসে প্রকল্প যায়, ঢাকার যানজট দূর হয় না, জলজট দূর হয় না। বাতাস দূষিত থাকে।

মনে বাবলাগাছের কষ লেগেছে, তোমরা ভেবে করবে কী? গুরু আমার মনের কালি ঘুচবে কেমনে?

কাজেই এই দূষণ, এই কুয়াশা, এই মেঘ, ভূমধ্যসাগর থেকে আসা নয়, আমাদের খাসলতের মধ্য-সাগর থেকে আসা। খাসলত কখন মরে! স্বভাব যায় না ম’লে! আমরা করোনায় মরব, নিউমোনিয়ায় মরব, হাঁপানিতে মরব, শ্বাসকষ্টে মরব, তবু আমাদের স্বভাব ভালো হবে না। ভূমধ্যসাগরের মেঘ কেটে যাবে, ঢাকার আকাশ পরিষ্কার হবে না হবে না হবে না। করোনা চলে যাবে, প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সঙ্গে ঠিকই, কিন্তু রমনায় গিয়ে তারা শ্বাস নিতে পারবে না পারবে না পারবে না।


আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক