বিশ্বায়নের কাল

ভুয়া খবর, ফেসবুক, টুইটার ও নির্বাচন

যে বছর বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন, সে বছরই ফেক নিউজ কথাটি জোরেশোরে শোনা গেল। বাংলায় এর প্রতিশব্দ ভুয়া বা বানোয়াট খবর। ২০১৬ সালে অক্সফোর্ড ডিকশনারির বিবেচনায় বছরের সবচেয়ে আলোচিত শব্দ ছিল ফেক নিউজ। ২০১৭–তেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কল্যাণে শব্দটি শীর্ষ আলোচিত শব্দাবলির তালিকায় ছিল। তবে পরিহাসের বিষয় হলো যেসব খবরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বা তাঁর পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনদের কেলেঙ্কারির কথা প্রকাশিত হয়, সেগুলোকেই তিনি বানোয়াট খবর বলে উড়িয়ে দেন। বিপরীতে তাঁর অনুসারী কট্টর ডানপন্থী কিছু গোষ্ঠী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অজস্র বানোয়াট তথ্য ব্যবহার করে অপপ্রচার চালায়। আর সেই বানোয়াট খবরের সফল প্রচারই তাঁর নির্বাচনী সাফল্যের অন্যতম কারণ।

ভুয়া খবর ছড়িয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা কীভাবে সম্ভব, এটি এখন আর কোনো প্রশ্ন নয়; বরং প্রশ্ন হচ্ছে এটি কেন মোকাবিলা করা সম্ভব হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানিতে ফেসবুক, টুইটার ও গুগলকে এখন সে জন্য জবাবদিহি করতে হচ্ছে। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে ওই অপপ্রচারে সচেতন বা অচেতনভাবে সহায়তা করারও অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নির্বাচনগুলোতে রাশিয়া থেকে সোৎসাহে এই অপপ্রচারের কাজটি করা হয়েছে বলে জোরালো অভিযোগ আছে এবং সে ধরনের আলামতও মিলছে। ট্রাম্পের প্রচারে দলের কোনো যোগসাজশ ছিল কি না, তা নিয়ে তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কিছু বলা না গেলেও হিলারির বিরুদ্ধে রাশিয়ার ভেতর থেকে বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে অপপ্রচার চালানোর বিষয়টি প্রযুক্তিজগতে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। সামাজিক মাধ্যমে কারও বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কাজটি যে বা যাঁরা করেন, তাঁদের ট্রল বলে অভিহিত করা হয়। এ রকম অজস্র ট্রলের উৎস যে রাশিয়া এবং তার ঘনিষ্ঠ সার্বিয়া,সে বিষয়ে অসংখ্য নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ব্রিটেনের ইউরোপের সঙ্গে বিচ্ছেদবিষয়ক ব্রেক্সিট গণভোটের ক্ষেত্রেও একই আলামতের কথা বলেছেন ব্রিটিশ এমপিদের অনেকেই। অবশ্য তাতে নির্বাচনের ফল পাল্টে গেছে, এমনটি কেউ দাবি করেননি। এ ধরনের অপচেষ্টার বিপদকে তাই গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করা প্রয়োজন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাধারণ ভোটার, বিশেষ করে তরুণ এবং সহস্রাব্দ প্রজন্মের (মিলেনিয়ালস)কাছে পৌঁছানোর জন্য যে এক অভূতপূর্ব মাধ্যম, এটি রাজনীতিক এবং রাজনৈতিক দলের চিন্তকেরা বুঝতে পেরেছেন। ফলে দলের নেতৃত্বের ভাবমূর্তি গড়ায় এই মাধ্যমে তাঁরা নজর দিয়েছেন। ট্রাম্পের আগে এই সুবিধা পেয়ে আলোচিত হয়েছেন যে রাজনীতিক, তিনি নরেন্দ্র মোদি। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার আগেই টুইটারে সর্বাধিক সংখ্যক অনুসারী ছিল তাঁর। এখনো ফেসবুক ও টুইটারে তাঁর অনুসারী প্রায় ১০ কোটি।

তবে পরে জানা গেছে, টুইটারে তাঁর ভক্তের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেশি হওয়ার পেছনে একটা রহস্য আছে। বিষয়টি প্রথম ধরা পড়ে ২০১৪-এর মে মাসে ভারতের নির্বাচনের সময়ে। ওই বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ মে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত ৫ কোটি ৬০ লাখ টুইট ছিল নির্বাচনবিষয়ক। ওই চার মাসে মোদির অনুসারী ২৮ শতাংশ বেড়ে প্রায় ৪০ লাখে পৌঁছায়। ভুয়া অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করতে সক্ষম এক সফটওয়্যারের উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠান সোশ্যালবেকারস তখন জানায় যে তাঁর সমর্থকদের অর্ধেকই সন্দেহজনক। ২০১৩ সালে টাইম সাময়িকী বছরের আলোচিত চরিত্র নির্বাচনের জন্য মোদির টুইটার অ্যাকাউন্ট পর্যবেক্ষণ করে। সে সময় তারা দেখতে পায়, ‘আমি মনে করি, নরেন্দ্র মোদির টাইম-এর বর্ষমানব হওয়া উচিত’—এমন মন্তব্যের হাজার হাজার টুইট আসছে নিয়মিত বিরতিতে। ২৪ ঘণ্টাই একইভাবে তা আসতে থাকে। শিগগিরই তার পাল্টা টুইটও শুরু হয়। (সূত্র: হোয়াই ফেক টুইটার অ্যাকাউন্টস আর এ পলিটিক্যাল প্রবলেম, নিউ স্টেটসম্যান, ২৮ মে ২০১৪)। ইন্টারনেটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সক্ষম কিছু সফটওয়্যার উদ্ভাবন করেছেন প্রযুক্তিবিদেরা, যা বট নামে পরিচিত। এসব বটই ভুয়া সমর্থকের কাজ করে। টুইটার ২০১৪ সালেই স্বীকার করেছিল যে তাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের পাঁচ শতাংশের মতো অ্যাকাউন্ট ভুয়া।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে সম্প্রতি প্রকাশিত খবরেও বলা হচ্ছে, টুইটারে রাজনীতিকদের অনুসারীদের অ্যাকাউন্ট নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, এঁদের বেশির ভাগই ভুয়া। টুইটার অডিট নামের একটি ডেটা-অ্যানালিটিকস বলছে যে অরবিন্দ কেজরিওয়াল, নরেন্দ্র মোদি ও রাহুল গান্ধী—এঁদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এটি ঘটেছে। কেজরিওয়ালের ১ কোটি ২৪ লাখ অনুসারীর ৬৫ ভাগ ও মোদির দুটি অ্যাকাউন্টের ৪ কোটি ৮০ লাখ অনুসারীর ৬৩ শতাংশই সন্দেহজনক। টুইটারে নতুন রাহুল গান্ধীর ক্ষেত্রে আসল অনুসারী প্রায় ৫১ শতাংশ। (ডেকান হেরাল্ড, ২৪ অক্টোবর ২০১৭)। সামাজিক মাধ্যমে অনুসারীর সংখ্যা সব সময় যে জনপ্রিয়তার যথার্থ প্রতিফলন নয়, তা মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু জনপ্রিয়তার প্রতিযোগিতায় বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য তার গুরুত্ব তো মানতেই হবে।

বাংলাদেশে ভুয়া বা বানোয়াট খবরের বিষয়টি একেবারে নতুন নয়। সাংবাদিকতা পেশায় যাঁরা কয়েক দশক ধরে আছেন, তাঁদের কাছে বানোয়াট খবরের একটি নজির খুবই পরিচিত। নব্বইয়ের দশকে ঢাকার নতুন প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু সাড়া জাগানো এক দৈনিকে দেশের প্রধান একটি দলের একজন নেত্রীর একটি সাক্ষাৎকার ছাপানো হয়, যার পুরোটাই ছিল ওই সাংবাদিকের মনগড়া। যে নেত্রীর সঙ্গে যে স্থানে সাক্ষাৎকারটি নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল, সেখানে সেই নেত্রী সেদিন যাননি এবং সেই সাংবাদিকের সঙ্গেও তাঁর সেদিন দেখা হয়নি। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে সেদিন সেই কথিত সাক্ষাৎকারের বিষয়ে ওই নেত্রীর পক্ষ থেকে বা তাঁর দল থেকেও কোনো প্রতিবাদ করা হয়নি। সেই সাংবাদিক এখনো এই পেশায় আছেন।

সম্প্রতি এ রকম একটি ভুয়া খবর ছিল, নোবেল কমিটি শান্তি পুরস্কারের জন্য আগের রাতেই ফোন করে নাকি সম্ভাব্য প্রাপককে পরের দিন সকালে টেলিফোনের পাশে থাকতে অনুরোধ জানিয়েছে। অথচ যাঁরা কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন যে পুরস্কার ঘোষণার আগ পর্যন্ত সেটা গোপন থাকে এবং ঘোষণার সামান্য আগে বিজয়ীকে তা জানানো হয়। সম্প্রতি এমন অনেক খবরই ভুঁইফোড় পোর্টাল ও সামাজিক মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, যেগুলোর সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে মূলধারার কাগজগুলোর সাংবাদিকেরা রীতিমতো গলদঘর্ম হয়েও সেগুলোর কোনো হদিস করতে পারেননি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দেশের সম্পদ পাচার করে সৌদি আরবে বিপণিবিতান কিনে থাকলে অবশ্যই সেই সম্পদ উদ্ধার এবং কথিত দুর্নীতির বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু বিএনপি বলছে, যেসব বিদেশি সংবাদমাধ্যমের খবর বলে তা প্রচার করা হয়েছে, সেগুলো হয় অস্তিত্বহীন, নয়তো তারা কখনোই এ ধরনের কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের রাজনীতিকেরা কয়েক বছর ধরেই যে সমস্যা মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছেন, সেই সমস্যা এখন বাংলাদেশেও আসর করেছে।

এখানে অবশ্য আরও একটি কথা বলে রাখা ভালো যে আমাদের রাজনীতিকেরাও তাঁদের সম্পর্কে বিব্রতকর কোনো তথ্য বা অভিযোগ প্রকাশিত হলে সেগুলোকে বানোয়াট বলে উড়িয়ে দেওয়ায় অভ্যস্ত। আর আমাদের বিচারব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রতা এবং অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে শেষ পর্যন্ত এ ধরনের অভিযোগ আদালতে খুব একটা নিষ্পত্তিও হয় না। ফলে অনেক সময় সত্য হলেও তা আইনি মারপ্যাঁচে শেষ পর্যন্ত বানোয়াটই থেকে যায়। আমার আজকের আলোচ্য অবশ্য অতীত নিয়ে নয়, বরং নির্বাচনের বছরে বানোয়াট তথ্য কীভাবে আমাদের বিভ্রান্ত করতে পারে, সেই বিপদ সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত করা।

দলীয় বক্তব্য প্রচার এবং নেতা-নেত্রীদের ভাবমূর্তি গঠনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কাজে লাগানোর দিকটিতে বড় দলগুলো যে নজর দিয়েছে, সেটা মোটামুটি সহজেই চোখে পড়ে। কিন্তু তা কতটা কার্যকর, বলা মুশকিল। এখানেও সরকারবিরোধীরা যে কিছুটা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়বেন। কেননা, বিদ্যমান ৫৭ ধারা অথবা প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিধানগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দলনিরপেক্ষতার বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিরোধী নেতা-নেত্রীদের সম্ভাব্য চরিত্রহননকারী ভুয়া তথ্য বা অভিযোগের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে তাঁরা কতটা প্রতিকার পাবেন, তা এখনো পরীক্ষিত নয়। কিন্তু সরকারি দলের নেতাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সমালোচনার ক্ষেত্রেও ৫৭ ধারা ব্যবহারের নজির অনেক।

রাজনীতি ও নির্বাচনকে প্রভাবিত করায় ফেসবুক ও টুইটারের ভূমিকা নিয়ে বেশ কিছু অনুসন্ধানমূলক গবেষণা হয়েছে। ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির এ বিষয়ে যে বিশেষ শাখা কার্যক্রম পরিচালনা করে, তার কিছু বিবরণ তুলে ধরেছেন সাংবাদিক স্বাতী চতুর্বেদী তাঁর আই অ্যাম আ ট্রল: ইনসাইড দ্য সিক্রেট ওয়ার্ল্ড অব দ্য বিজেপি’স ডিজিটাল আর্মি নামের বইয়ে। অভিনেতা আমির খান ভারতে সহিষ্ণুতা কমে যাওয়ার বিষয়ে মন্তব্য করার পর তাঁর মডেলিং চুক্তি বাতিলের জন্য স্ন্যাপডিল (অনলাইন মার্কেটিং প্ল্যাটফর্ম) কোম্পানির বিরুদ্ধে এই গোষ্ঠী টুইটারে কী ধরনের হয়রানি করেছিল, তার বিবরণ রয়েছে এই বইয়ে। অনলাইনে এই বিশেষ ধরনের হয়রানিকে প্যাট্রিয়টিক ট্রল (দেশপ্রেমিক হয়রানি) বলে অভিহিত করা হচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউস বলছে, প্যাট্রিয়টিক ট্রলের উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারি ভাষ্যের বাইরে অন্য কোনো ভাষ্য বা ভিন্নমত দমন করা।

ফেসবুক এ ক্ষেত্রে কতটা তৎপর, তার একটা ভয়াবহ চিত্র সম্প্রতি তুলে এনেছে ব্লুমবার্গ (২১ ডিসেম্বর ২০১৭)। ফেসবুকের বৈশ্বিক রাজনীতি ও সরকার ইউনিট বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিকদের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রচারকৌশলের বিষয়ে কাজ করে থাকে। ভারত ছাড়াও ফিলিপাইন ও জার্মানির নির্বাচনে ফেসবুকের সম্ভাব্য ভূমিকার বিষয়ে এই প্রতিবেদনে তুলে ধরে বলা হয়েছে যে এসব বিষয়ে কোনো ধরনের স্বচ্ছতা নেই। ফেসবুক তাদের কার্যক্রমে স্বচ্ছতার দাবি নানাভাবে এড়িয়ে এবং প্রতিহত করে চলেছে। 

বাংলাদেশে নির্বাচনের বছরে অনলাইনে রাজনৈতিক প্রচার বাড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গণতন্ত্রের যে নাজুক দশা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও তার ব্যতিক্রম নয়। বরং এ ক্ষেত্রে বাড়তি ঝুঁকি হচ্ছে প্রযুক্তির বিষয়ে আমাদের সীমিত জ্ঞান, সামর্থ্যের ঘাটতি এবং নীতিমালা প্রশ্নে বিতর্ক ও সমঝোতার অভাব। এ ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক দল, বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক গোষ্ঠীগুলোর দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, যাতে ডিজিটাল জগৎটি গণতান্ত্রিক এবং সমসুবিধার নিশ্চয়তা দেয়।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।