ধর্মবাদী রাজনীতি প্রতিনিয়ত নতুন ইস্যু খোঁজে। দক্ষিণ এশিয়া তার ভালো সাক্ষী। এ রকম খোঁজাখুঁজি মাত্রই বিষাক্ত করে তোলে ঐতিহাসিক আন্তধর্মীয় সম্পর্ক। তাতে ধর্মে-ধর্মে বিভেদ ও বিবাদ বাড়ে। নাগরিক স্বাধীনতার পরিসরও ক্রমে ছোট হয়।
ভারতের বিভিন্ন স্থানে এ বিভেদবাদ নতুন হট্টগোল তুলেছে। এবারের বিষয় আন্তধর্মীয় বিয়ে। ধর্মকে বিশুদ্ধ রাখতে হবে। শুমারিতে ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যাও কমতে দেওয়া যাবে না। তাই এ রকম বিয়ে আইন করে বন্ধ করতে চাওয়া হচ্ছে।
বিজেপি তাদের নিয়ন্ত্রিত রাজ্যগুলোয় এ রকম আইন তৈরিকে রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে নিয়েছে।
স্বাধীনভাবে জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের অধিকার থাকছে না
হিন্দু নারীদের সঙ্গে অন্য ধর্মের পুরুষদের বিয়ে নিয়ে ‘রাজনীতি’ ভারতে নতুন নয়। এত দিন গুটিকয়েক সাম্প্রদায়িক সংগঠনের ‘কর্মসূচি’ ছিল এসব। এখন তাতে মূলধারার দলগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছে। মধ্যপ্রদেশ সরকার সম্প্রতি জানিয়েছে, তারা ভিন্নধর্মে প্রেমের বিয়েকে জামিন–অযোগ্য মোকদ্দমার বিষয় করতে চায়। এ নিয়ে বিধানসভায় বিলও উঠেছে সেখানে। ‘বিয়ের নামে জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণ’-এর শাস্তি হিসেবে পাঁচ বছর কারাবাসের প্রস্তাব করা হয়েছে বিলে। কর্ণাটক ও হরিয়ানার সরকারও এ রকম আইন তৈরির ঘোষণা দিয়েছে। আসাম ও উত্তর প্রদেশেও একই রকম আইন তৈরির আওয়াজ আছে। এসব রাজ্যে ক্ষমতায় বিজেপি। বোঝা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় বিজেপির সবুজ সংকেত আছে এই আয়োজনে।
ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশে প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর পছন্দমতো বিয়ের সুযোগ আছে। আন্তধর্মীয় বিয়ের বিরোধিতাকারীরা সেই আইনি পাটাতন বদলাতে চাইছে, যা আসলে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের স্বাধীনভাবে জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের অধিকার কেড়ে নেওয়ার নামান্তর।
বিয়ে রুখতে ধর্মীয় বিদ্বেষ
বিভেদবাদ যে সম্প্রীতির পরিসর কমাতে চাইবে, সেটা নতুন নয়। আন্তধর্মীয় বিয়ে হয় সাধারণত প্রেম ও ভালোবাসার ফল হিসেবে। নগরায়ণ, উচ্চশিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের যৌথ অংশগ্রহণ যত বাড়ছে, এ রকম বিয়ের ঘটনাও বিশ্বজুড়ে তত বাড়ছে। এটা যেকোনো সমাজে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতিরও নিদর্শন।
দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে শত শত বছর ধরে এ রকম বিয়ের নজির আছে। বলিউডের বিখ্যাত দম্পতিরা অনেকে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের। উপমহাদেশের সমাজের স্বাভাবিক সামাজিক শক্তির জায়গা ছিল এসব। তবে এ রকম সমাজে ধর্মে-ধর্মে কাজিয়া লাগানো কঠিন। সেই বিবেচনা থেকেই হয়তো এ রকম বিয়ের বিরোধিতার ইতিহাসও বেশ পুরোনো।
বিরুদ্ধবাদীরা আন্তধর্মীয় বিয়েকে বলছে ভালোবাসার নামে একধরনের জিহাদি কার্যক্রম। ধর্মীয় আবরণ দিয়ে একে বলা হচ্ছে ‘লাভ জিহাদ’। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, বিশেষ এক ধর্মকে ইঙ্গিত করেই এ রকম নামকরণ।
সচরাচর আন্তধর্মীয় বিয়ে বিরোধীদের মূল টার্গেট নিজ নিজ ধর্মের নারীরা। ভয় ছড়ানো হয়, কোনো ধর্মে নারীরা এভাবে বিয়ে করতে থাকলে লোকগণনায় ওই ধর্মের হিস্যা কমে যাবে। সংখ্যায় কমা মানেই শুমারিতে নিচে পড়ে যাওয়া। আর ভোটের অঙ্কে হেরে যাওয়ার শঙ্কা।
শুমারিতে সংখ্যা কমে যাওয়ার ভীতি ছড়ানো হয়
আন্তধর্মীয় বিয়ে নিয়ে সরাসরি রাজনীতি না হলেও সামাজিক টানাপোড়েন আছে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশে। আপাতত এটা আরএসএস শিবিরের বড় এক রাজনীতি হয়ে উঠলেও নীরবে এ রকম বিয়ের বিরোধিতা আছে অন্যান্য ধর্মেও। বিরোধিতাকে ন্যায্যতা দিতেই এ রকম প্রেমের বিয়েকে ধর্মবিরোধী ষড়যন্ত্রের আবরণও দেওয়া হয়। বলা হয়, এসব বিয়ে মানেই কোনো এক ধর্মের জনসংখ্যা কমানোর অপচেষ্টা!
সচরাচর আন্তধর্মীয় বিয়ে বিরোধীদের মূল টার্গেট নিজ নিজ ধর্মের নারীরা। ভয় ছড়ানো হয়, কোনো ধর্মে নারীরা এভাবে বিয়ে করতে থাকলে লোকগণনায় ওই ধর্মের হিস্যা কমে যাবে। সংখ্যায় কমা মানেই শুমারিতে নিচে পড়ে যাওয়া। আর ভোটের অঙ্কে হেরে যাওয়ার শঙ্কা।
এ রকম ভীতি ছড়িয়েই পুরো ধর্মের অভিভাবক হিসেবে নিজেদের জাহির করে আন্তধর্মীয় প্রেম ও বিয়ের বিরুদ্ধবাদীরা। এ রকম বিয়ে রোখা তাদের কাছে ‘নিজেদের ভগ্নী ও কন্যাদের সম্মান’ রক্ষার চেষ্টাতুল্য। স্বঘোষিতভাবে তারা নারীর সম্মান রক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে।
বাস্তবে এটা নতুন মোড়কে পুরোদস্তুর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। ভারতে এমনও আতঙ্ক তোলা হয়েছে, আন্তধর্মীয় বিয়ে চলতে থাকলে ‘জনগণকে স্থায়ীভাবে মুসলমান প্রধানমন্ত্রী দেখতে হবে’। এসব ভীতি বেশ ভালো কাজে দিচ্ছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানবিক বিকাশের সুযোগ না পাওয়া মানুষ অনেক সময় এ রকম ভীতিতে প্রভাবিত হতে শুরু করে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে কেউ চায় নাÑনিজ ধর্মের মানুষের সংখ্যা কমে যাক।
একই রকম ভীতি ছড়ানো হতো আগে ‘ধর্মান্তকরণ’-এর কথা বলে। ফল হিসেবে ভারতের আটটি রাজ্যে ইতিমধ্যে ধর্মান্তকরণ কঠিন করে আইন হয়েছে।
ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সেই বিশ্বাসের পরিবর্তন স্বেচ্ছাধীন বিষয় হলেও রাজ্যে রাজ্যে আইনের মাধ্যমে তাতে ফৌজদারি অপরাধের স্পর্শ দেওয়া হচ্ছে। একইভাবে পছন্দমতো বিয়ে ভারতীয় সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ সম্মত হলেও তাকে এখন ফৌজদারি আইন সাপেক্ষ করা হচ্ছে।
টার্গেট যখন নারী
আন্তধর্মীয় বিয়ে বিরোধী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রধান শিকার নারী সমাজ। সচরাচর ধরে নেওয়া হয়, প্রেমের বিয়ে নথিবদ্ধ হওয়ার সময় ‘কনে’ ধর্মীয় পরিচয় পাল্টায় বা পাল্টাতে বাধ্য হয়। সুতরাং শুমারি দলিলে অবস্থান ধরে রাখতে এবং ব্যালট বাক্সে কিছু রাজনীতিবিদের বিজয় নিশ্চিত করতে ভিন্নধর্মে বিয়ে করতে পারবে না নারী। তাকে পছন্দের অধিকার ছাড়তে হবে। সম্প্রদায়ের বিবেচনাকে এখানে নারীর পছন্দের ওপরে স্থাপন করা হচ্ছে।
মহামারিকালে যে কারণে এ বিশেষ ‘রাজনীতি’ গতি পেল
আন্তধর্মীয় বিয়ে বা ভিন্নধর্মের নারী-পুরুষের মধ্যকার প্রেমে আপত্তি একধরনের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বেরও প্রকাশ। সামাজিক ন্যায়বিচার, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে ইতিবাচক কিছু আর দিতে পারছে না দক্ষিণ এশিয়ার অনেক রাজনৈতিক শক্তি। এরাই এখন জাতিগত পরিচয়, ধর্মীয় পরিচয়, জনসংখ্যার হিস্যা, আঞ্চলিকতা ইত্যাদিকে রাজনীতির বিষয় করে তুলতে চাইছে। মূলধারার রাজনীতির আদর্শিক সেই সংকটের বড় এক প্রকাশ প্রেমের বিয়ের বিরোধিতা।
বহু স্থানে এটা কেবল বিরোধিতা আকারেও নেই। বিয়ের বরকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনাও অনেক। প্রকাশ্যেই এ রকম খুনকে বৈধ বলা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেসব উত্তেজক ভিডিওতে লাখ লাখ ‘লাইক’ পড়ছে। তাতে এ রকম বিয়ে অনেক কমে যাচ্ছে। তারপরও এমনভাবে প্রচারণা চালানো হয় যেন ভিন্নধর্মের হাজার হাজার তরুণ-তরুণী হামেশা বিয়ে করে ফেলছে। এ রকম প্রচার রাজনৈতিক দাঙ্গায় জ্বালানি হিসেবেও কাজ করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে এসব ঘৃণাবাদী প্রচারণার বড় পাটাতন হিসেবে ব্যবহার করা যাচ্ছে সহজে। বিজেপিশাসিত ভারতীয় রাজ্যগুলোয় মহামারিতে অর্থনীতি যত বেসামাল হচ্ছে, ততই রাজনৈতিক শোরগোল বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এ রকম সামাজিক ইস্যুতে।
মানবাধিকারকর্মী এবং বিজেপিবিরোধীরা এর মধ্যে একধরনের কর্তৃত্ববাদী মতলব খুঁজে পাচ্ছেন। নাগরিক কী খাবে, কী পরবে, কাকে বিয়ে করবে ইত্যাদি যখন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া হয়, সেটা ক্রমে সমাজকে একধরনের ফ্যাসিবাদী মরুভূমিতে নিয়ে যেতে পারে। তাদের ভয়, এভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের তালিকা আরও বাড়তে থাকবে।
মধ্যপ্রদেশে এ–সংক্রান্ত বিলের নাম দেওয়া হয়েছে, ‘ধর্ম স্বতন্ত্রীকরণ বিল-২০২০’। হিসাব খুব সহজ—ধর্মের নামে এ রকম কর্মসূচি এগিয়ে নিতে সুবিধা।
তবে যেকোনো ধর্মের পরিসরে নিয়ন্ত্রিত সমাজের জন্ম মানেই প্রতিক্রিয়া হিসেবে অপর ধর্মের পরিসরেও একই রক্ষণশীলতার জন্ম হওয়া। আপাতত দিকে দিকে তারই আলামত। ব্যক্তিস্বাধীনতার এ রকম আয়োজনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন সামাজিকভাবে। এটা উপমহাদেশে আন্তধর্মীয় দূরত্ব বাড়াবে আরেক দফা।
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক