ভিআইপি উৎপাদনে রেকর্ডের দেশে

ভিআইপি কথাটার মানে কী আসলে? বাংলাদেশে ভিআইপি কারা? বাংলাদেশে কি কোনো ভিআইপি আইন আছে?

আমরা জানি, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও জাতির পিতার পরিবার এসএসএফের নিরাপত্তা ও সুবিধা পান। কারাগারে কারা ডিভিশন পেতে পারেন, তার আইন বা নিয়ম নিশ্চয়ই আছে। বাংলাদেশ বিমানে কারা কারা বিজনেস ক্লাসে ‘আপগ্রেডেড’ হতে পারেন, তারও একটা নিয়ম বানানো হয়েছে। সিআইপি কথাটার মানে আছে, আমরা জানি। ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে প্রশাসনিকভাবে কতজন এই ভিআইপির সুবিধা পান, তার সঠিক হিসাব দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ২০০৭ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত এই ১০ বছরে ১ হাজার ২৩৮ জনকে সিআইপি মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।’

ভুক্তভোগী এবং সুবিধাভোগী—দুই অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, বাংলাদেশে কেবল কোটিপতির উৎপাদন বেড়েছে তা-ই নয়, বাংলাদেশে ভিআইপি উৎপাদনও বেড়ে গেছে ব্যাপকভাবে। ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা বলার আগে সুবিধাভোগীর অভিজ্ঞতা বলে নিই। বেসরকারি বিমানে ভ্রমণের সময় আমার সাদাপাকা চুল, আজানুলম্বিত পাঞ্জাবি এবং চোখে চশমা দেখে অনেক সময় আমার বোর্ডিং পাসে সিল দেওয়া হয় ভিআইপি। তখন আর বাসে উঠতে হয় না, একটা কার এগিয়ে আসে, উড়োজাহাজের দোরগোড়া পর্যন্ত আমাকে বহন করে নিয়ে যায়। খুব একটা পুলক যে হয় ভেতরে-ভেতরে, এটা একদমই অস্বীকার করব না।

এই গোবেচারা টাইপ চেহারা দেখিয়ে একবার মারাত্মক একটা সুবিধা পেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্যে একটু ওয়াশরুমে যাওয়ার দরকার পড়ল। গিয়ে দেখি, বিশাল লাইন। আমাকে দেখামাত্রই সুজন জনতা বলতে লাগল, আপনি আগে যান, আপনি আগে যান, বলে বলে তারা ঠেলে দিল লাইনের সামনে। চুলপাকা লোকের ওয়াশরুমে যাওয়ার অগ্রাধিকার সর্বত্রই স্বীকৃত হওয়া উচিত। বিআরটিএতে গাড়ির লাইসেন্স করতে গিয়ে ফটোবুথে ঢুকতেই ওরা বলল, আপনি এই লাইনে এসেছেন কেন, ভিআইপিতে যেতেন। তেমনিভাবে কোভিডের টিকা নিতে গিয়ে দেখলাম, একটা বুথ আছে আলাদা করা, এটা ভিআইপিদের জন্য। এইখানে আমার প্রশ্ন, এই ভিআইপি কারা? মন্ত্রীরা? এমপিরা? সচিবেরা? বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা? সিআইপিরা?

মিজানুর রহমান খানের অভাব অনুভব করছি। বাংলাদেশে ভিআইপি কারা, এই বিষয়ে কোনো আইন কি আছে? তিনি নেই, কে এই প্রশ্নের উত্তর আমাকে দেবেন?

এতক্ষণ বলছিলাম ভিআইপি হলে কী ধরনের সুবিধা পাই। কিন্তু ভিআইপি না হওয়ায় কী ধরনের অসুবিধায় পড়ি? একটা বাস্তব কিন্তু দৈনন্দিন অসুবিধা আছে। যানজট। এর অনেক কারণ আছে, একটা কারণ হলো গুরুত্বপূর্ণ, অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের চলাচল। কারণ, ঢাকার ট্রাফিক সিগন্যাল স্বয়ংক্রিয় নয়। পুলিশ হাত দিয়ে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে এবং বাংলাদেশের অগণিত ভিআইপির একজন যদি কোনো সড়কে ওঠেন, তখন ওই সড়কটা ‘ক্লিয়ার’ করে দেওয়ার জন্য অন্য রাস্তাগুলো আটকে দেওয়া হয়। এটা যে শুধু মন্ত্রীর জন্য করা হয় তা নয়, বরং মন্ত্রীদের জন্য হয়তো করাও হয় না, করা হয় বিশেষ পেশায় চাকরিরত কর্মকর্তাদের জন্য। আমার কথা বিশ্বাস না হলে আপনি ট্রাফিক পুলিশে কর্মরত যেকোনো ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। আমি এমনি দু-তিনজন প্রত্যক্ষ-সংশ্লিষ্টর কাছেই শুনেছি, ঢাকার রাস্তায় যানজটের অন্যতম কারণ ভিআইপি মুভমেন্ট। এর মধ্যে কতগুলো আছে খুবই যুক্তিযুক্ত, যেমন ধরা যাক, বিদেশি ক্রিকেট টিমের বাস সোনারগাঁও হোটেল থেকে মিরপুর যাবে, ওই রাস্তা তো পরিষ্কার রাখতেই হবে, তেমনি বিদেশি প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি এলে তাঁদের চলার পথ তো নির্বিঘ্ন রাখতেই হবে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন শত শত ভিআইপি, হাজার হাজার ভিআইপি এবং ভিআইপি সংস্কৃতিতে দেশ জেরবার।

আপনি হাসপাতালে যাবেন, ভিআইপিদের জন্য আলাদা কেবিন, ট্রেনে আলাদা কম্পার্টমেন্ট, আলাদা ওয়েটিংরুম, বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ।

তখনই প্রশ্ন, ভিআইপি কাহারা? কাহাকে বলে ভিআইপি? মনে পড়ে আমজাদ হোসেনের গোলাপী এখন ট্রেনে সিনেমার সংলাপ। গোলাপী চাল নিয়ে ট্রেনের কামরায় উঠবে, যাত্রী বলছে, এটাতে উঠো না, এটা ফার্স্ট ক্লাস। গোলাপী, মানে আমাদের ববিতা ম্যাডাম বললেন, ‘ফার্স্ট ক্লাস? বাংলাদেশে কোনো ফার্স্ট ক্লাস নাই। বাংলাদেশে একটাই ক্লাস!’

ভিআইপি যদি কেউ থেকে থাকেন, তিনি হলেন বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক। প্রত্যেকে এবং আলাদা করে ভিআইপি। সরকার কিন্তু এই ব্যাপারে কোথাও কোথাও জোরও দিয়েছে। প্রত্যেক করদাতাকে সম্মানিত করদাতা বলা হচ্ছে। কোভিডের টিকা গ্রহণকারীকেও সম্মানিত টিকা গ্রহণকারী বলা হচ্ছে। বহু জায়গায় সেবাদানকারীকে বলে দেওয়া হয়েছে সেবা গ্রহণকারীকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতে।

গণতন্ত্র মানে কী? ধরা যাক দুজন মানুষ। একজন নিরক্ষর। আরেকজন পিএইচডিধারী। পিএইচডি থিসিসের বিষয় ছিল গণতন্ত্র, ক্ষমতা, রাষ্ট্র। ভোটকেন্দ্রে দুজনেরই একটা করে ভোট। আপনি গণতন্ত্র পড়ান, আমি লেখাপড়াই জানি না বলে আপনার ভোট এক শটা, আর আমার একটা, তা নয়। একজন প্রতিবন্ধী, রাস্তায় পড়ে থেকে ভিক্ষা করেন, আরেকজনের বাবার দুই হাজার কোটি টাকা, দুজন ভোটকেন্দ্রে যাবেন, দুজনেরই একটা করে ভোট। একেবারে মৌলিক মানবাধিকারের ঘোষণা, এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ সমান। আবার বলি, প্রতিটি মানুষ সমান। নারী-পুরুষ, উচ্চবিত্ত-বিত্তহীন, সাদা-কালো, প্রতিবন্ধী-চৌকস, হিন্দু-মুসলিম কোনোভাবেই কোনো দুজন মানুষকে আলাদা করা যাবে না, তাদের মধ্যে বৈষম্য করা যাবে না। আমাদের সমাজে মৌলিকতম এই মূল্যবোধটারই অস্তিত্ব নেই, আমরা মনে করি না যে প্রতিটি মানুষ সমান।

আমরা মনে করি, আমি কবিতা লিখি, তাই রাষ্ট্রের ব্যাপারে কথা বলার এবং তা থেকে কিছু অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়া আমার অধিকার। একটুখানি ‘ফাঁক’ পেলেই আমরা ভিআইপি হতে চাই। পাড়ার ক্লাবের সেক্রেটারি, স্কুল কমিটির সভাপতি, অ্যাপার্টমেন্ট সমিতির সভাপতি, ক্ষমতাসীন দলের গঠনতন্ত্রবহির্ভূত কোনো পাড়া কমিটির সাধারণ সম্পাদক থেকে শুরু করে সাড়ে তিন শ এমপি, মন্ত্রী-সচিব থেকে শিল্পকলা একাডেমির জেলা সংগঠক, সাপ্তাহিক কটকিপাড়ার সাব-এডিটর, দারোগা, অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার—এই দেশে সবাই এখন ভিআইপি। আর আছেন কোটিপতিরা।

ভিআইপি চেনার একটা উপায় আছে। তঁাদের গাড়িটা হয় ফোর-হুইল ড্রাইভ। আর তাঁদের হর্নটা হয় আলাদা। এগুলোর কি কোনো আইন আছে? কার গাড়িতে ভিআইপি হর্ন লাগানো যাবে, কারটায় যাবে না? আবারও মিজানুর রহমান খানের শূন্যতা অনুভব করছি।

বাংলাদেশে আমরা কথায় কথায় বলি, ‘তুই আমারে চিনস?’ না চিনলে চেনানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। একটা টিভি বিজ্ঞাপনে রসিকতা করা হয়েছিল, খেয়া নৌকায় চেয়ার নিয়ে বসে একজন বলছেন, তুই আমার স্ট্যাটাস জানিস? নিরীহ যাত্রী বলছেন, আপনার স্ট্যাটাস জানব কী করে, আপনি কি আমার ফেসবুকে আছেন?

বলি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সব মানুষ সমান—এসব বলে লাভ নেই। বরং ‘ভিআইপি’ আইন চালু করুন। তারপর ভিআইপিদের জন্য একটা বিশেষ ধরনের ‘ক্যাপ’ চালু করুন। এই ক্যাপের রং থাকবে। ধরা যাক, লাল হলে ভিভিআইপি, নীল হলে ভিআইপি, হলুদ ভিআইপি-২। তা যদি না করেন, তাহলে বলে দিন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ছাড়া সবাই সমান। রাস্তায় কেউই অতিরিক্ত সুবিধা পাবে না। কারও জন্য লেন পরিষ্কার করা হবে না, কারও জন্য ফেরি দাঁড়িয়ে থাকবে না। শুধু মুক্তিযোদ্ধারা বিশেষ রকমের সম্মান পাবেন। আমেরিকায়-ইউরোপে মন্ত্রীরা যখন চলেন, কেউ টেরও পায় না। তাঁরা গণপরিবহনে উঠে চলাচল করেন।

আর এমপিরা কেন সরকারি প্লট বা বিনা শুল্কের গাড়ি পাবেন? যুক্তিটা কী?

গণতন্ত্র মানে কেবল ভোট নয়। গণতন্ত্র মানে হলো রাষ্ট্র তার প্রতিটি নাগরিককে সম্মান করছে কি না, মর্যাদা দিচ্ছে কি না। আমি জানি না, বাংলাদেশের মতো পৃথিবীতে আর কোথাও এত ভিআইপি আছেন কি না! আপনারা যাঁরা প্রথম বিশ্বে থাকেন, তাঁরা একটু জানাবেন তো, ওই সব দেশে ভিআইপি কে, কারা, কতজন, কীভাবে চলেন, কীভাবে বলেন, কীভাবে নড়েন, কীভাবে চড়েন। কী কী প্লট বা গাড়ি পান!

রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলে রাখি:

হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,

অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!

মানুষের অধিকারে

বঞ্চিত করেছ যারে,

সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,

অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।


আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক