স্কুলের রচনা প্রতিযোগিতায় একবার ভাষা নিয়ে আমাদের লিখতে বলা হয়েছিল, ‘ভাষার প্রয়োজন’ অথবা ‘ভাষার বিবর্তন’—এ ধরনের কোনো শিরোনামে। বিষয়টা কঠিন ছিল। লিখতে গিয়ে মনে হয়েছিল পুরস্কার জেতা দূরে থাক, স্যারের তিরস্কার যাতে না জোটে, অন্তত সেই চেষ্টাটাই করতে হবে। পুরস্কার পেয়েছিল আমার এক বন্ধু, যার হাতের লেখা ছিল সুন্দর, লিখতও গুছিয়ে, আর শুরুও করেছিল ভাষার দু–এক সংজ্ঞা দিয়ে। স্যার অবশ্য সামান্য তিরস্কার করেছিলেন তাকে, যেহেতু সে ভাষা বলতে মানুষের ভাষাকেই বুঝিয়েছিল। প্রাণীরও ভাষা আছে, পাখিদেরও। স্যার বলেছিলেন, নীরবতাও একটা ভাষা। স্যারের নাম ছিল নাসিরুদ্দিন আহমেদ। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে এসে একটা বই লিখেছিলেন আটলান্টিকের ওপার হতে। তাঁর বর্ণনার ভাষা ছিল আকর্ষণীয়, ব্যাকরণ ছিল নির্ভুল। তিনি ‘ওপার’ এবং ‘হতে’ শব্দ দুটির নির্ভুল উচ্চারণ করতেন, ‘চোর’ এবং ‘গোল’কে কখনো ‘চুর’ এবং ‘গুল’ বলতেন না। কিন্তু যখন রেগে যেতেন অথবা বিরক্ত হতেন এবং সিলেটি ভাষায় প্রত্যাবর্তন করতেন, তাঁর মুখে সিলেটি নিজস্ব সব রং–রস মেলে ধরত।
যুক্তরাষ্ট্রে তাঁকে ইংরেজিতে কথা বলতে হয়েছে। ইংরেজিতে তিনি অনর্গল বলতে পারতেন। ইংরেজিটা অবশ্য আমাদের শেখাতেন হামিদ স্যার। তিনি গর্ব করে বলতেন, বল সাহেব থেকে তিনি ভাষাটি শিখেছেন। বল সাহেব কে, আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু হামিদ স্যারের নিখঁুত ইংরেজি উচ্চারণ শুনে নিশ্চয় মি. বল প্রীত হতেন।
আমি পড়তাম যে স্কুলে, তাতে একটি ছোটখাটো লাইব্রেরি ছিল। বৃহস্পতিবার বই নিয়ে বাড়ি যেতাম। স্কুলে প্রতিবছর একটা ম্যাগাজিন ছাপা হতো। ম্যাগাজিনের দায়িত্ব পাওয়ার পর স্যার আদেশ করায় একবার আমাকে একটা লেখা দিতে হয়েছিল, গ্যাগারিনের মহাকাশ ভ্রমণ বিষয়ে। লেখা না দিলে মার খেতে হবে, স্যার এ রকম একটা ধারণা দিয়েছিলেন।
ভাষা নিয়ে রচনা লেখার প্রশ্নে স্কুলের স্যারদের হাতে মার খাওয়া পর্যন্ত চলে যাওয়াটা নিশ্চয় ভালো লেখার লক্ষণ নয়, কিন্তু একটা প্রাসঙ্গিকতা এর আছে। সে বিষয়ে একটু পরে যাওয়া যাবে। তার আগে ভাষা নিয়ে আরও দুটি কথা বলা যায়। স্যার যেমন বলেছিলেন, পশু-পাখির ভাষা আছে, নীরবতাও, সে রকম ভাষা আছে অনেক ক্রিয়াকর্মেরও, বিমূর্ত চিন্তারও যেমন বিপ্লবের, গণতন্ত্রের অথবা প্রতিবাদের। পুরস্কার জেতা আমার সেই বন্ধু যেমন লিখেছিল, একজনের চিন্তাভাবনা অন্যের বোধগম্য করে তোলা যায় যা দিয়ে, তা–ই ভাষা। ভাষার শ্লীল ও অশ্লীল দুটি রূপই আছে, ফলে চিন্তাভাবনাকে বোধগম্য করে তোলাই শুধু নয়, সেটি করতে গিয়ে রুচির একটি প্রকাশও জরুরি, সংস্কৃতির একটি চর্চাও জরুরি। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আমাদের যাবতীয় ভাষা ব্যবহারে এই ‘বোধগম্য করে তোলা’র ব্যাপারটা আমরা জটিল করে ফেলছি, সৌন্দর্য ও রুচির বিষয়টাকেও অবহেলা করছি। এ জন্য আমাদের ভাষা আমরা ক্রমাগত সীমাবদ্ধ করে ফেলছি, এলোমেলো করে ফেলছি, একে দূষণের ভেতরে ফেলে দিচ্ছি।
প্রতিবাদের ভাষার কথাই বলি। একসময় সেই পঞ্চাশ-ষাটের সুবর্ণ সময়ে আমাদের প্রতিবাদের ভাষা ছিল বলিষ্ঠ ও তীব্র, কিন্তু একই সঙ্গে সুন্দর। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলি খেয়ে প্রাণ দিয়েছেন তরুণেরা, মিছিলে–স্লোগানে প্রকম্পিত হয়েছে রাজপথ, কিন্তু কোনো মিছিল থেকে কোনো গাড়িতে কি কেউ পেট্রলবোমা ছুড়েছে? গাড়ি ভেঙেছে কেউ? রিকশা উল্টে ফেলেছে যাত্রী ও চালকসহ?
না। প্রতিবাদের সেই প্রবল কিন্তু মহিমাদীপ্ত ভাষা আর নেই। এখন প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছে উগ্র, সহিংস ও অশ্লীল।
আমাদের রাজনীতির ভাষা? শোনা যায় না, কানে হাত দিতে হয়। গণতন্ত্রের ভাষা? সহ্য করা যায় না, কারণ এ ভাষা জুড়ে আছে দমন আর দহনতন্ত্রের বিষ। ব্যবসা–বাণিজ্যের ভাষা? শুনে বোকা বনতে হয়, যেহেতু সেই ভাষা জুড়ে আছে মানুষ ঠকানোর যত চালাকি, ছলচাতুরী। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ভাষা? কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এ ভাষায় আছে ভুলভ্রান্তি, চমক আর তাৎক্ষণিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উপরিতলসর্বস্বতা। আমাদের ‘একাডেমিক’ ভাষা? ‘একাডেমিক’ ও ‘ভাষা’র ইংরেজি–বাংলা মিশেলের মতোই এ ভাষায় আছে ইংরেজির কাছে অকারণ হাত পাতার একটা বিষয়, ভাষা নিয়ে একটা সংশয়। আমাদের উচ্চশিক্ষার ভাষা যে বাংলা হয়নি এত দিনেও, তার একটি বড় কারণ এই সংশয়। এবং সংশয় থেকে জন্ম নেওয়া ইংরেজির প্রতি পক্ষপাতিত্ব।
আর আমাদের শিক্ষিত শ্রেণির ভাষা? এই ভাষাটি এখন একটি ভয়ানক জগাখিচুড়ি ভাষা। ধরুন টেলিভিশনে রাজনীতি নিয়ে টকশো শুনছেন অথবা ফাটকা বাজার অথবা আবহাওয়ার পরিবর্তন নিয়ে কোনো বক্তব্য। খেয়াল করলে দেখবেন, বক্তার বাংলায় বিশেষ্য ও বিশেষণের ক্ষেত্রে ৪০% থেকে ৬০% নেওয়া হচ্ছে ইংরেজি থেকে। অথচ সেসব শব্দের পরিবর্তে ব্যবহারের জন্য সুন্দর বাংলা শব্দ আছে।
আমরা শিক্ষিতজনেরা যখন বাংলা বলি, খুব কমই (১০% ক্ষেত্রে) একটি বাক্য যথাযথভাবে শেষ করি। যদি কেউ আবহাওয়া পরিবর্তন নিয়ে ১০ মিনিট কথা বলি এবং সেগুলো লিখে ফেলা যায়, তাহলে দেখা যাবে মাত্র ১০-২০% বাক্য ব্যাকরণ মেনে যথাযথভাবে শেষ হয়েছে। আমি মাঝেমধ্যে একটি টিভি চ্যানেলে ‘আমাদের কথা’ নামে আমজনতার বক্তব্য শুনি। এখানেও একই অনুপাতে তাঁরা শুদ্ধ বাক্য বলেন। আমাদের তিন ফুটবল খেলোয়াড়ের কথা শুনলাম। তিন মিনিটের মতো বললেন। একটি বাক্যের সঙ্গে আরেকটির কোনো মিল নেই। খাপছাড়া কথা, বাক্যগুলোও নড়বড়ে। বাক্যাংশই বললেন বাক্যের বদলে। টেলিভিশন সংবাদের প্রতিবেদক যখন সরাসরি অনুষ্ঠানে কথা বলেন, ‘কিন্তু’ এবং ‘আসলে’ শব্দ দুটি এত অসংখ্যবার বলেন, যেন সেগুলোর হাত ধরে তিনি চলছেন। আর এফএম রেডিওর কথা বাদই দিলাম। ভাষার নামে আমরা যা করছি, তাকে একধরনের অরাজকতাই বলা যায়।
২.
যে জাতির ভাষায় শৃঙ্খলা নেই, সৌন্দর্য নেই। তার কাজকর্মেও কোনো শৃঙ্খলা অথবা সৌন্দর্য থাকে না। যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে মনের ভাবটি প্রকাশ করতে অপারগ, তার পক্ষে বড় কল্পনা করা এবং সৃজনশীলতার উচ্চতায় যাওয়াটা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
আমরা যে বাংলা বলি, তা এক বিপন্ন প্রজাতির বাংলা। এর ভিত্তি দুর্বল, এটি মার খায় ইংরেজির কাছে। আজকাল হিন্দিও ঢুকছে বাংলায়, বোধ করি উর্দুও। বিয়ের শাড়ি যেদিন বদলে লেহেঙ্গা হয়ে গেল, গায়েহলুদের অনুষ্ঠান হয়ে গেল মেহেন্দি মাহফিল, সেদিন আমরা নিজেদেরই যেন একটা বাণী দিলাম: ভাষা নিয়ে আমাদের একটা আবেগ আছে বটে, কিন্তু ভাষা নিয়ে কোনো পরিশ্রম করতে আমরা রাজি নই। আরও একটা বাণীও আমরা নিজেদের শোনালাম: আমরা সৃজন থেকে অনুকরণে বেশি পারদর্শী। অনুকরণটা আবার তৃপ্তির হয়, যদি তা হয় টেলিভিশনে ভেসে আসা চটকদার কোনো কিছুর।
ভাষার রাস্তাটা তৈরি করে দিয়েছিলেন আমাদের ভাষাশহীদেরা। স্বাধীনতা তাকে রাজপথে পরিণত করল। কিন্তু এই রাজপথ আরও প্রশস্ত ও মসৃণ করতে আমাদের যেসব উদ্যোগ নেওয়ার কথা ছিল, তা আমরা নিইনি। অপব্যবহারে এর পিচ নষ্ট হয়ে খোয়া বেরিয়ে গেছে। এখন ইংরেজির আলকাতরা দিয়ে ঢেকে কতটা একে চলাচলযোগ্য করা যায়?
ষাটের দশকে যেভাবে এগোচ্ছিলাম আমরা, ভাষার রাস্তা দিয়ে, সে রকম এগোনোর ইচ্ছাটাও যেন এখন নেই। বাংলা ভাষা এখন শ্রীহীন হচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে অন্যান্য সব ভাষার ক্ষেত্রে। আমাদের প্রতিবাদের বা রাজনীতির ভাষাও তো এখন বর্ষায় মুগদাপাড়া অথবা নূরেরচালার পানিকাদা জমা, আবর্জনা উপচে পড়া রাস্তার মতো।
একটা আরেকটাকে টেনে তোলে। আমরা যদি আমাদের মাতৃভাষাটা সেভাবে ব্যবহার করতাম, যেমন করে চেকরা অথবা জাপানিরা করে তাদের ভাষাটি, তাহলে আমাদের সব ভাষাই সুন্দর হতো।
৩.
ভাষা নিয়ে রচনা লেখা প্রসঙ্গে স্যারদের হাতে মার খাওয়া পর্যন্ত যে গিয়েছিলাম, তার একটি কারণ আছে এবং তা নিশ্চয় এতক্ষণে পরিষ্কার হয়েছে। ভাষাকে যদি আমরা একটা মর্যাদা, শুদ্ধতা এবং শক্তির জায়গায় নিয়ে যেতে চাই, তাহলে আমাদের শুরু করতে হবে সেই স্কুল থেকে, স্কুলজীবনের একেবারে গোড়া থেকে। আমাদের শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে আনতে হবে মনোযোগের মূল কেন্দ্রে। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা এমনভাবে বাড়াতে হবে, যাতে মেধাবী শিক্ষকদের একটা বড় সমাবেশ ঘটানো যায় প্রাথমিক পর্যায় থেকেই। প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যদি বাংলা শেখানো হয় যত্ন নিয়ে, শিক্ষকেরা নিজেরাও যদি সচেতন হন তঁাদের ভাষা নিয়ে, যদি প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি গ্রন্থাগার থাকে, বই পড়ার প্রতিযোগিতা এবং উৎসব হয়, যদি বাংলার প্রতি ভালোবাসাটা আবেগের পথ ছেড়ে পরিশ্রমের পথে যায়, তবেই ভাষাশহীদদের বানানো পথটাকে আমরা দিগন্তছোঁয়া রাজপথের মর্যাদায় উন্নত করতে পারব।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।