ভাষাবৈচিত্র্য আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন

বিশ্বচরাচরের সবই মহান আল্লাহ তাআলার কুদরতের বহিঃপ্রকাশ। ভাষার বৈচিত্র্য আল্লাহর কুদরতের অন্যতম নিদর্শন। কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই রয়েছে বহু নিদর্শন।’ (সুরা-৩০ রুম, আয়াত: ২২)।

মানুষকে বলা হয় ‘হায়ওয়ানুন নাতিক’, অর্থাৎ ‘বাক্‌শক্তিসম্পন্ন প্রাণী’। আপাতদৃষ্টে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে দৃশ্যত পার্থক্য হলো বাক্‌শক্তি বা ভাষাজ্ঞান। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘দয়াময় রহমান আল্লাহ! কোরআন পাঠ শেখালেন; মানুষ সৃষ্টি করলেন; তাকে ভাষা বয়ান শেখালেন।’ (সুরা-৫৫ আর রাহমান, আয়াত: ১-৪)।

সব নবী-রাসুল (আ.)-কে তাঁদের স্বজাতির ভাষায় পাঠানো হয়েছে এবং সব কিতাবও স্থানীয় ভাষায় নাজিল করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের নিকট পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।’ (সুরা-১৪ ইব্রাহিম, আয়াত: ৪)। ‘ইহা (কোরআন) আমি অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায় যাতে তোমরা বুঝতে পারো।’ (সুরা-১২ ইউসুফ, আয়াত: ২)।

সেকালে আরবদের মধ্যে ভাষা ও সাহিত্যচর্চার প্রতিযোগিতা ছিল। কোরআন মাজিদ শেষ নবীর শ্রেষ্ঠ মোজেজা হিসেবে আরবি ভাষা-সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ নমুনা হিসেবে নাজিল হলো, যা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ আরবি ভাষায় মানোত্তীর্ণ ও কালোত্তীর্ণ। মহানবী (সা.)-এর হাদিস তথা বাণীগুলো কোরআনের পরই উৎকৃষ্ট আরবির নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত।

হজরত মুসা (আ.)-কে আল্লাহ তাআলা যখন নবী ও রাসুল হিসেবে ঘোষণা করলেন, তখন তিনি তাঁর ভাই হজরত হারুন (আ.)-কে রাসুল হিসেবে ঘোষণা করার জন্য আল্লাহর সমীপে আবেদন করে বললেন, ‘আমার ভাই হারুন, সে আমার চেয়ে বাগ্মী। অতএব তাকে আমার সহযোগীরূপে (রাসুল হিসেবে) প্রেরণ করুন, সে আমাকে সমর্থন করবে। আমি আশঙ্কা করি, তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলবে। (আল্লাহ তাআলা বললেন) আমি তোমার ভ্রাতা দ্বারা তোমার বাহু শক্তিশালী করব এবং তোমাদের উভয়কে প্রাধান্য প্রদান করব। তারা তোমাদের নিকট পৌঁছাতে পারবে না, তোমরা ও তোমাদের অনুসারীরা আমার নিদর্শন বলে তাদের ওপর বিজয়ী হবে।’ (সুরা-২৮ কাসাস, আয়াত: ৩৪-৩৫; সুরা-২০
ত্ব-হা, আয়াত: ২৫-৩৮)।

ভাব প্রকাশের মাধ্যম হলো ভাষা। ভাষার অলংকৃত রূপই সাহিত্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে নবী (সা.) আমি আপনার প্রতি সর্বসুন্দর কাহিনি বর্ণনা করেছি।’ (সুরা-১২ ইউসুফ, আয়াত: ২)। ভাষার প্রমিত নিয়ম নির্দেশ করে ব্যাকরণ। আরবি ভাষার ব্যাকরণ মুসলমানদের হাতেই রচিত হয়। অনারবরা কোরআন পড়তে সমস্যা হতো বিধায় হজরত আলী (রা.) তাঁর বিশিষ্ট শিষ্য হজরত আবুল আসওয়াদ দুওয়াইলি (রহ.)-কে নির্দেশনা দিয়ে আরবি ভাষাশাস্ত্র প্রণয়ন করান, যা ইলমে নাহু (বাক্যবিন্যাস) ও ইলমে ছরফ (শব্দ প্রকরণ) নামে পরিচিত। মুসলমানদের হাতেই উচ্চতর আরবি ভাষাতত্ত্ব ও অলংকারশাস্ত্র তথা ইলমে বায়ান, ইলমে মাআনি ও ইলমে বাদির উন্নয়ন ঘটে।

সাহিত্যের বিশেষায়িত পর্ব হলো কাব্য বা কবিতা। প্রায় সব মুসলিম মনীষী একাধিক ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন এবং সাহিত্য ও কাব্যচর্চা করেছেন। বিখ্যাত সাহাবি হজরত হাসসান ইবনে সাবিত (রা.) কাব্য রচনা করতেন। নবীর স্ত্রী হজরত আয়েশা (রা.) কাব্যচর্চা করতেন। ইসলামের সব যুগেই বিভিন্ন ভাষায় সাহিত্যচর্চা চলে আসছে। (তাফসিরে ইবনে কাসির)

ভাষা শুদ্ধ লেখা, পড়া ও বলা এবং শিখন ও শেখানো ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বদর যুদ্ধের বন্দীদের শিক্ষিতজনের মুক্তিপণের বিকল্প হিসেবে ১০ মুসলিমকে লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। প্রয়োজনে বিদেশি ভাষাও শেখা যাবে এবং তা শুদ্ধও হতে হবে। মহানবী (সা.) সাহাবিদের বিদেশি ভাষা শেখার নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

smusmangonee@gmail.com