দেশহীন মানুষের কথা

ভালো থেকো মার্থা টুডু

অলিভিয়া হেমব্রম ও মার্থা টুডু সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ। অলিভিয়াকে নিশ্চয় মনে আছে আপনাদের। যাঁরা সাঁওতালদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর পড়েছেন, সোশ্যাল মিডিয়া ও টিভিতে দেখেছেন, তাঁরা জানেন দ্বিজেন টুডু গত বছরের ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর একটি চোখ এখন পুরোপুরি অন্ধ। অন্য চোখে একটু ঝাপসা দেখতে পান। অলিভিয়া দ্বিজেন টুডুর স্ত্রী। মার্থা দ্বিজেন টুডুর বোন। তিনি ঢাকার শেরেবাংলা নগর চক্ষু হাসপাতালে ভাইয়ের পাশে ছিলেন। তাঁরা গোবিন্দগঞ্জ ফিরে গেছেন।
মার্থাকে ফোনে জিজ্ঞেস করলাম, এখন কেমন আছেন? কীভাবে চলছে সংসার? হাসিমুখী থাকতেন মার্থা হাসপাতালে। ফোনেও বুঝতে পারলাম হাসছেন। কিছু বলছেন না। সহজে নিজের দুঃখ-কষ্টের কথা তাঁরা বলতে চান না। নিশ্চয় আপনাদের মনে আছে, তাঁরা অভাবী মানুষ হলেও সরকারি ত্রাণ ঘৃণাভরে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
ঢাকায় যখন হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম, অভিভূত হয়েছিলাম তাঁদের কথা শুনে। প্রথম দিন যখন যাই, বলেছিলেন এই শহরের মানুষ অনেক ভালো। কষ্ট করে এখানে এসে খাবার দিয়ে যাচ্ছেন। সম্ভবত টিভিতে খবর দেখে ও পত্রিকায় সাঁওতালদের করুণ কাহিনি জেনে সহানুভূতি জন্মেছিল কিছু বাঙালির মনে। জিজ্ঞেস করলাম, তাঁদের নাম কী? দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, হায়, নাম তো জিজ্ঞেস করিনি। দ্বিজেন টুডুকে যেদিন গাইবান্ধার পুলিশ এসে নিয়ে যায়, সেদিন এই মানুষের সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়নি। মার্থা আমাকে বলেছেন, ওনাদের জন্য তাঁরা অপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু দেখা হয়নি। আমি বললাম, কোনো দিন যদি আমার সঙ্গে দেখা হয়, আমি তাঁদের আপনাদের কথা বলব।
সাঁওতালি জীবনে শোষণ ও বঞ্চনা নিয়তির মতো জড়িয়ে থাকে। ব্রিটিশ গেল। এখন পাকিস্তানি শাসন নেই। আমরা আছি ৪৬ বছরের স্বাধীন দেশে। কিন্তু দ্বিজেন টুডু, অলিভিয়া হেমব্রম ও মার্থা টুডুদের জীবন থেকে হাহাকার গেল না। তবে আনন্দের খবর হলো, দ্বিজেন টুডু জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তাঁরা একসময় ভেবেছিলেন, কোথাও কেউ নেই তাঁদের জন্য। এখানে নিরাপত্তা নেই, সম্মান নেই। কিছু নেই। কিন্তু হাসপাতালে এসে মনে হয়েছে, এই শহরের মানুষের মধ্যেও মায়া-মমতা আছে।

>সাঁওতালি জীবনে শোষণ ও বঞ্চনা নিয়তির মতো জড়িয়ে থাকে। ব্রিটিশ গেল। এখন পাকিস্তানি শাসন নেই। আমরা আছি ৪৬ বছরের স্বাধীন দেশে। কিন্তু দ্বিজেন টুডু, অলিভিয়া হেমব্রম ও মার্থা টুডুদের জীবন থেকে হাহাকার গেল না

দ্বিজেন বললেন, অনেক ভালো মানুষ আছে। চিকিৎসা ও হাসপাতাল নিয়েও তাঁদের কোনো অভিযোগ ছিল না। পাহারায় তিন পুলিশ সদস্য ভালো ব্যবহার করেছেন। যেদিন সন্ধ্যায় প্রথম হাসপাতালে যাই, দ্বিজেনের ছোট বোন মার্থা দাঁড়িয়ে ছিলেন। বিছানার পাশে টিফিন ক্যারিয়ার ছিল। সাইডটেবিলে কোনো খাবার বা ফলমূল দেখিনি। নিঃস্ব, রিক্ত পরিবার। বাংলাদেশ সগৌরবে মধ্যম আয়ের দেশ হতে চলেছে, মার্থা টুডুদের দেখে এটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না।
মার্থাকে জিজ্ঞেস করলাম, পানি খান কোথা থেকে? টেবিলে প্লাস্টিকের একটা বড় বোতল দেখিয়ে বললেন, এখানে মসজিদের পাশে টেপ থেকে বোতলে ভরে আনি। খুব ভালো পানি। সবাই ওখান থেকে খায়। জিজ্ঞেস করলাম, রাতে কী খাবেন? মার্থা বললেন, ওই যে দুপুরের খাবার আছে। টিফিন ক্যারিয়ার দেখালেন। আমি বললাম, থালা কোথায়? মার্থা ও দ্বিজেন টুডু দুজনেই হাসলেন। লজ্জা পেলেন। মার্থা বললেন, এক রোগী এসেছিল তার বাবার সঙ্গে, বাঙালি। তাদের সঙ্গে কিছুই ছিল না। ছোট ছেলে ভাত খাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করছিল। আমাদের মতোই গরিব। আমরা থালা দিলাম। গতকাল চলে গেল। থালাটাও নিয়ে গেল।
মার্থা বললেন, ভেবেছিলাম যাওয়ার সময় থালাটা রেখে যাবে। পরে মার্থা ও দ্বিজেন দুজনই হাসলেন, কোনো অসুবিধা নেই, আমরা টিফিন ক্যারিয়ারে খাই। আমার স্ত্রী দেখেছিল কী নেই তাদের। রাতে ফিরে এসে পরদিন আমরা থালা, শাড়ি, লুঙ্গি, মশারি, গ্লাস, একটা ফ্লাস্ক, কিছু খাবার ইত্যাদি নিয়ে আবার গিয়েছিলাম।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কর্মী বন্ধু রেজোয়ানকে তাঁদের কথা বলেছিলাম। পরে তাঁরা নিজেরা হাসপাতালে গিয়ে শুধু দ্বিজেন টুডু নয়, আরও দুজনকে সাহায্য করেছিলেন। সংবাদমাধ্যমে খবর দেখে আমেরিকা থেকে কয়েকজন বাঙালি বন্ধু কিছু টাকা পাঠিয়েছেন ব্যক্তিগতভাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক আমাকে ফোন করে কিছু কম্বল দিয়েছেন। কতজন যে কতভাবে সাঁওতালদের সাহায্য করেছেন, তার তালিকা দীর্ঘ হবে। মাননীয় প্রধান বিচারপতি আমাদের সবাইকে অবাক ও আশাবাদী করে ঘোষণা দিয়ে সাঁওতালদের আর্থিক সাহায্য করেছেন। অতীতে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের জীবনে এমন ঘটনা ঘটেছে কি না আমি জানি না। সাঁওতালরা আমাকে ফোন করে জানিয়েছেন, তাঁরা কত খুশি হয়েছেন।
নিহত শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডুর স্ত্রী ও সন্তানেরা ঢাকায় এসেছিলেন। এই অধমের কাছেও এসেছিলেন। আমার সামনে এসে বসেছিলেন। ভাষাহীন সবাই। কী বলা উচিত আমিও ভেবে পাচ্ছিলাম না। সামনে বসে তিন স্বামীহারা নারী নীরবে চোখের জল ফেলছেন, এ দৃশ্য যেন আর কোনো দিন দেখতে না হয়। বিধাতার কী লীলাখেলা, সব মানুষের চোখের জলের রং এক। গরিবের চোখের জল, ধনীর চোখের জল অভিন্ন।
তারপরও কিছু মানুষ অন্যকে দুঃখ দিয়ে সুখ পায়। রাষ্ট্র দিন দিন ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের প্রতি সংবেদনহীন ও নির্মম হয়ে উঠছে। রাষ্ট্রের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। মার্থাকে বললাম, দিনমজুরি কি সব সময় মেলে? বললেন, কাজ তেমন নেই। এখন আলু তোলার মৌসুম। সারা দিন আলু তুললে সাত কেজি আলু পাই। এটাই মজুরি। খোঁজ নিয়ে জানলাম, দিনাজপুরে আলু তোলার মজুরি দৈনিক তিন থেকে পাঁচ কেজি আলু। আলুর দর কত? গ্রামে কেজি প্রতি ১২ থেকে ১৫ টাকা। তাহলে এখন মার্থা টুডুদের মতো গরিব মানুষের পরিবার কীভাবে চলে? দেশ নাকি মধ্যম আয়ের সীমানা পেরিয়ে উন্নত দেশ হয়ে উঠবে? ব্যাংক থেকে তিন-চার হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে বসে আছেন যে লুটেরা, তাঁর সঙ্গে যদি দিনাজপুরের আলুখেতের দিনমজুর একজন সাঁওতালের রোজগারের গড় বের করা হয়, তখন কী অবস্থা দাঁড়াবে?
নির্মম সত্য হচ্ছে, অন্ধপ্রায় দ্বিজেন টুডু এখন রোদের মধ্যে আলুখেতে কাজে যেতে পারছেন না। তাঁর স্ত্রী অলিভিয়া টুডু জানিয়েছেন, চৈতালি ধান রোপণের মৌসুম চলছে দিনাজপুরে। দৈনিক মজুরি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। একা কাজ করে তিন সন্তানকে কীভাবে মানুষ করবেন? আর প্রতিনিয়ত যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষকে তার ভূমি, বন, সংস্কৃতি, আত্মপরিচয় ও জীবনরক্ষার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়, তার কাছে মধ্যম আয়ের দেশের সংজ্ঞা কী?
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।