ভারত হয়ে রাশিয়ার তেল কেনায় কৌশলী হতে হবে

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে মস্কো বাংলাদেশকে তেল ও গম দিতে আগ্রহী হলেও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ভয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি ঢাকা
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে মস্কো বাংলাদেশকে তেল ও গম দিতে আগ্রহী হলেও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ভয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি ঢাকা

রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের প্রভাবে জ্বালানি তেল আমদানি নিয়ে সমস্যায় পড়েছে বাংলাদেশ। আমদানিনির্ভর জ্বালানি তেল সংগ্রহ করা এবং সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে সংকট তৈরি হতে পারে। রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) হিসেবে সরকারের ভর্তুকি দেওয়ার পরও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় ডিজেল বিক্রিতে লোকসান গুনছে সংস্থাটি। অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি থাকায় ফার্নেস অয়েল আমদানি বাড়াতে হয়েছে সরকারকে। সরকার ফার্নেস অয়েলের দাম চলতি অর্থবছর ছয়বার বাড়িয়েছে। ৪২ টাকার ফার্নেস অয়েল ৭৪ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচও বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতিতেও!

এমতাবস্থায় ভারত হয়ে রাশিয়ার তেল কেনার চেষ্টাটা যৌক্তিক। তবে কৌশলটা গোপনীয় না রেখে সাংবাদিকদের সামনে উন্মুক্ত করার বিষয়টি কৌশলগতভাবে একেবারেই ঠিক হয়নি! এর ফলে পুরো প্রক্রিয়াই আটকে যেতে পারে।

ইউক্রেন আগ্রাসনের পর রাশিয়ার তেল খাত ইউরোপ ও আমেরিকার আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) আপত্তি অগ্রাহ্য করেই ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনছে। রাশিয়াও ভারতকে তেল দিচ্ছে অনেকটাই কম দামে। ভারত যেহেতু বিশ্বের তৃতীয় বড় তেল আমদানিকারী দেশ, তাই রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল কিনে বিদেশি মুদ্রার বিপুল সাশ্রয় করছে দিল্লি। রিফিনিটিভ আইকনের রিপোর্ট উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানাচ্ছে, ভারত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য মে পর্যন্ত ৩৪ মিলিয়ন ব্যারেল তেল আমদানি করেছে রাশিয়া থেকে। ২৪ মিলিয়ন ব্যারেল এসেছে শেষ এক মাসে। অর্থাৎ ভারত রাশিয়ার তেল কেনা বাড়াচ্ছে, কমাচ্ছে না। বিশ্ববাজারে বর্ধিত থাকলেও গত ২১ মে প্রতি লিটার পেট্রল সাড়ে ৯ রুপি ও ডিজেলের দাম ৭ রুপি কমানোর ঘোষণা দিয়েছে ভারত সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কাছে মাথানত না করে মূল্যছাড়ে রাশিয়ার জ্বালানি তেল কেনায় ভারতের প্রশংসা করেছেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তাঁর দাবি, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের মাধ্যমে তাঁর সরকারও এ ব্যাপারে কাজ করছিল।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে মস্কো বাংলাদেশকে তেল ও গম দিতে আগ্রহী হলেও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ভয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি ঢাকা। যেহেতু রাশিয়া-ইউক্রেন উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেও রাশিয়া থেকে জ্বালানি কিনতে পারছে ভারত, এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশও রাশিয়ার কাছ থেকে তেল-গম কিনবে কি না, এ বিষয়ে দিল্লির কাছে ‘বুদ্ধি’ চেয়েছে ঢাকা।

যুক্তরাষ্ট্র ভারতের মানবসম্পদের ওপর ব্যাপক অর্থে নির্ভরশীল বলে ভারত স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি চর্চা করতে পারছে। বিপরীতে বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‍্যাব মানবাধিকার ইস্যুতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়ে অস্বস্তিতে রয়েছে। এমতাবস্থায় সরাসরি রাশিয়া থেকে আমদানি সম্ভব না হলে ভারত থেকে আমদানি বৃদ্ধিই অধিক যুক্তিযুক্ত। ভারত-বাংলাদেশের বিদ্যমান ব্যবসার ছকেই ভারত থেকে জ্বালানি ও গম উভয়টিই আমদানি বাড়ানো যায়।

মে মাসের শেষ সপ্তাহে ভারত থেকে ফেরার পর সাংবাদিকদের বিষয়টা এমন খোলাখুলিভাবেই জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। প্রশ্ন হচ্ছে, কৌশলগত বিষয় এভাবে ফাঁস করে দেওয়া কি ঠিক হলো! যেখানে বাংলাদেশের ওপর মার্কিন ও ইউরোপীয় পক্ষগুলো খুব সতর্ক দৃষ্টি জারি রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের মানবসম্পদের ওপর ব্যাপক অর্থে নির্ভরশীল বলে ভারত স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি চর্চা করতে পারছে। বিপরীতে বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‍্যাব মানবাধিকার ইস্যুতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়ে অস্বস্তিতে রয়েছে। এমতাবস্থায় সরাসরি রাশিয়া থেকে আমদানি সম্ভব না হলে ভারত থেকে আমদানি বৃদ্ধিই অধিক যুক্তিযুক্ত। ভারত-বাংলাদেশের বিদ্যমান ব্যবসার ছকেই ভারত থেকে জ্বালানি ও গম উভয়টিই আমদানি বাড়ানো যায়।

এক. বাংলাদেশ আগে থেকেই ভারত থেকে জ্বালানি তেল কিনছে

গত ১২ জানুয়ারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি বিপিসি কর্তৃক মেয়াদি চুক্তির আওতায় ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান নুমালীগড় রিফাইনারি লিমিটেডের (এনআরএল) কাছ থেকে ৯০ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল ৫১২ কোটি ৪৮ লাখ টাকায় আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এনআরএল শিলিগুড়ি মার্কেটিং টার্মিনাল থেকে ইন্দোবাংলা ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের পার্বতীপুর ডিপোতে ডিজেল আমদানির বিষয়ে ২০১৫ সালের ২০ এপ্রিল বিপিসি ও এনআরএলের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যে বিপিসি ও এনআরএলের মধ্যে ১৫ বছরের জন্য ফিক্সড প্রিমিয়ামে (৫ দশমিক ৫০ /বিবিএল) সেলস অ্যান্ড পারচেজ অ্যাগ্রিমেন্টও স্বাক্ষরিত হয় ২০১৭ সালে।পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৩১ কিলোমিটার, বাংলাদেশ অংশে ১২৬ কিলোমিটার এবং ভারতের অংশে থাকবে ৫ কিলোমিটার। পাইপলাইন স্থাপিত হলে প্রথম পর্যায়ে বছরে ডিজেল আসবে পাঁচ লাখ টন, পর্যায়ক্রমে যা ১০ লাখ টনে উন্নীত হবে।

দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্যিক সুসম্পর্কের বিষয় বিবেচনা করে পাইপলাইন নির্মাণের আগে অন্তর্বর্তীকালে এনআরএল থেকে রেল ওয়াগনের মাধ্যমে ২০১৬ সাল থেকে ডিজেল আমদানি করা হচ্ছে। ২০২০ সালে অনুমোদিত ৬০ হাজার মেট্রিক টন ডিজেলের মধ্য থেকে ডিসেম্বর ২০২০ সময় পর্যন্ত ১৩টি পার্সেলে প্রায় ২৮ হাজার ৮৮৩ মেট্রিক টন ডিজেল আমদানি সম্পন্ন হয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে ভারত থেকে ৩০ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল আমদানি করেছে সরকার।

যেহেতু বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই ভারত থেকে পরিশোধিত ডিজেল আমদানি করছে, তাই বিদ্যমান চুক্তির রূপরেখায় ডিজেল আমদানি বাড়ানো যায়। ভারত কোথা থেকে অপরিশোধিত তেল সংগ্রহ করে, সেটা আমদানিকারক হিসেবে বাংলাদেশের ঘটা করে বলার প্রয়োজন নেই।

দুই. আমদানি করা জ্বালানি আন্তর্জাতিক মানে পরিশোধিত হওয়া চাই

ভারত অপরিশোধিত বা ক্রুড তেল উৎপাদনকারী দেশ নয়। তবে পরিবহন সহজলভ্যতার বিবেচনায় ভারত থেকে পরিশোধিত ডিজেল কেনা বাণিজ্যিক দিক থেকে ফিজিবল। এখানে ভারতের রপ্তানি করা ডিজেলের কতটা সঠিক মানে ও মাত্রায় পরিশোধিত, তা বিবেচনায় থাকা চাই। অর্থাৎ সালফারসহ অন্যান্য পরিবেশদূষণীয় অনাকাঙ্ক্ষিত ধাতু আন্তর্জাতিক মানে পরিশোধন করা কি না, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কি না, তা যাচাই-বাছাই করা উচিত। অন্যথায় মানহীন ডিজেল বাংলাদেশের বাতাস ও পরিবেশদূষণের নতুন কারণ হয়ে উঠতে পারে। ডিজেলে সালফারের মাত্রাসূচক পিপিএমের হিসাব করা হয়। ডিজেলে পিপিএম মাত্রা যত কম, পরিবেশদূষণ তত কম হবে। বিশ্বের ১০০টা শীর্ষ দূষিত শহরের মধ্যে ৪৬টিই হচ্ছে ভারতের, তাই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। নুমালীগড় তেল পরিশোধনাগারের ১০-৫০ পিপিএম মাত্রার ইউরোপিয়ান গ্রেডের তেল পরিশোধনের সক্ষমতা যদি না থাকে, বাংলাদেশের উচিত হবে, এমন কারিগরি সক্ষমতা তৈরির জন্য ভারতকে চাপ দেওয়া এবং তারপর তেল আমদানি করা। আমদানি খরচ গ্রহণযোগ্য হলে ক্রস বর্ডার বিদ্যুতের মতো ক্রস বর্ডার ডিজেলও কেনা যাবে। এখানে আরও দুটি দিক খেয়াল করতে হবে—

ক. একক উৎস হিসেবে কোনো দেশের ওপর জ্বালানি বিষয়ে অতিনির্ভরশীল হওয়া চলবে না। অন্যথায় জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য তা হুমকি হয়ে উঠতে পারে। ভারত রাজনৈতিক কারণে নেপালে ডিজেল সরবরাহ অনৈতিকভাবে পুরোপুরি বন্ধ করে দিলে দেশটি বেশ কিছুদিনের জন্য জাতীয় জ্বালানি বিপর্যয়ে পড়ে। বিদ্যুৎ মাস্টারপ্ল্যান (পিএসএমপি-২০১৬) মোতাবেক মোট জ্বালানির ১৫ শতাংশের বেশি একক বিদেশি উৎস থেকে সংগ্রহ করা ঠিক হবে না।

খ. বিশ্ব যখন সবুজ জ্বালানির দিকে ধাবিত (২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট বিদ্যুতের মাত্র ৩ দশমিক ৬ শতাংশ সবুজ), সেখানে ডিজেল ব্যবহারের খাত ধীরে ধীরে সংকোচনের পরিকল্পনায় গিয়ে ডিজেলচালিত গাড়ি ও ফার্নেস তেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কীভাবে সরে আসা যায়, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে বাংলাদেশকে।

তিন. নুমালীগড় রিফাইনারির বিকল্প খোঁজা দরকার

ভারতের আসামে অবস্থিত নুমালীগড় রিফাইনারি থেকে ঢাকার দূরত্ব আনুমানিক ৭০০ কিলোমিটার। সেখানে অপরিশোধিত তেল পরিবহন করে শোধনের পর পুনরায় ফিরতি পথে বাংলাদেশে আমদানি করা পরিবহন ব্যয় ও সময়ের দিক থেকে সাশ্রয়ী নয়। বরং বাংলাদেশ বিহারে অবস্থিত ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশনের বারাউনি রিফাইনারি কিংবা আরও সুবিধাজনক পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া রিফাইনারি থেকে পরিশোধিত জ্বালানি কেনার চেষ্টা করতে পারে। দূরত্ব ও পরিবহন খরচের বিবেচনায় হলদিয়ার পরিশোধিত তেল ক্রয় বেশি সম্ভাবনাময়। হলদিয়া রিফাইনারির তেল পায়রা বন্দর হয়ে বাংলাদেশে আসতে পারে, পরবর্তীকালে পায়রা থেকে নৌপথে কিংবা নির্মিতব্য পায়রা-পদ্মা রেলের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে আসতে পারে। এর বাইরে সরকারের হাতে রয়েছে আরও একটি বিকল্প। অতি দ্রুত নবনির্মিত মহেশখালী-মাতারবাড়ি তেল ডিপো–সংলগ্ন রিফাইনারি তৈরির কাজ সম্পন্ন করা গেলে বাংলাদেশ ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও অপরিশোধিত তেল কেনার চেষ্টা চালাতে পারবে। একদিকে বাংলাদেশকে কৌশলী হতে হবে, অন্যদিকে জ্বালানির উৎস বহুমুখী, ঝুঁকিমুক্ত ও সবুজ করতে হবে।

  • ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর’, ‘অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা’, ‘উন্নয়ন প্রশ্নে বাংলাদেশের কিছু সংকট ও সম্ভাবনা’। faiz.taiyeb@gmail.com