এ মাসের শুরুতে আন্তর্জাতিক মহলের সমালোচনা উপেক্ষা করে ভারত সরকার সাতজন রোহিঙ্গা অভিবাসীকে প্রথমবারের মতো মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে। তারা বেআইনিভাবে ভারতে প্রবেশ করার কারণে আসামের শিলচর কেন্দ্রীয় কারাগারে ২০১২ সাল থেকে আটক ছিল। গত বছর ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়েছিল যে ভারতে বসবাসকারী প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গাসহ সব অবৈধ অভিবাসীকে বিতাড়ন করা হবে। ২০১৭ সালের আগস্টে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে এই মর্মে প্রতিটি রাজ্য সরকারের কাছে সুস্পষ্ট নির্দেশনাও পাঠানো হয়েছিল। বিজেপি নেতারা কোনো প্রমাণ ছাড়াই বলছেন, অবৈধ অভিবাসীরা, বিশেষ করে রোহিঙ্গারা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। আসলে অধিকাংশ রোহিঙ্গা দিনমজুর, রিকশাচালক ইত্যাদি কাজ করে। যেসব রোহিঙ্গা অভিবাসী জাতিসংঘের রেজিস্টার্ড শরণার্থী ক্যাম্পে রয়েছে, তাদেরও ‘অবৈধ অভিবাসী’ বলার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৭ সালে করা একটি রিট আবেদন শুনানিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র বলেছিলেন, কোনো শরণার্থীকে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিকে অবশ্যই শরণার্থীদের মানবাধিকারের সঙ্গে একত্রে বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু ভারত সরকার সাত রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর মাধ্যমে তাদের সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করল।
সাত রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া বন্ধ করতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে আরেকটি রিট আবেদন করা হয়েছিল, কিন্তু নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈর নেতৃত্বে গঠিত একটি বেঞ্চ আবেদনটি খারিজ করে দেন। প্রধান বিচারপতির যুক্তি, বিষয়টি কেন্দ্রের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, তাই আদালত এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবেন না। রিটের আবেদনকারী আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ আদালতে যুক্তি উপস্থাপন করেন যে এভাবে রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং সরকারের এই আদেশের বৈধতা যাচাই করার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের ওপর বর্তায়। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, আদালত থেকে বলা হয়েছিল যে এই সাত রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার সরকার নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু আসলে তাদের শুধু পরিচয়পত্র ও এক মাসের জন্য ভ্রমণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মহল যখন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূলের অভিযোগ তুলছে, সেই মুহূর্তে ভারত এই সাতজন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাল। এমন কোনো দৃষ্টান্ত এখন পর্যন্ত মেলেনি, যাতে মনে হতে পারে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে।
স্পষ্টতই এভাবে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনের একটি মূল প্রথাগত নীতি ভঙ্গ করা হয়েছে। এই নীতিকে বলা হয় ‘নন-রেফুলমো’ (non–refoulement); অর্থাৎ কোনো দেশে আশ্রয়প্রার্থী কোনো ব্যক্তিকে এমন স্থানে ফেরত পাঠানো যাবে না, যেখানে তার প্রাণনাশ, নির্যাতন বা অন্য গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি রয়েছে। এই নীতি কোনো বিশেষ আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষরের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে প্রতিটি রাষ্ট্রই এই নীতি মেনে চলতে বাধ্য। এই প্রথাগত নীতির প্রতি সম্মান জানিয়েই বাংলাদেশ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছে, যদিও বাংলাদেশও ভারতের মতো শরণার্থীদের সুরক্ষাসংক্রান্ত কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি।
সাতজন রোহিঙ্গা অভিবাসীকে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াটি যে সরকারি আদেশক্রমে হয়েছে, তাতে যেহেতু বলা রয়েছে যে সব অবৈধ অভিবাসীকেই ফেরত পাঠানো হবে, তাই ধরে নেওয়া যায়, ভারতে বর্তমানে বসবাসরত প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গার সবাইকেই ভারত থেকে বিতাড়ন করা হবে। ইতিমধ্যে ভারতীয় পত্রপত্রিকা বলছে, আরও একটি রোহিঙ্গা দলকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। যেহেতু মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের খুব দ্রুত ভাগ্য পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই, এই ৪০ হাজার লোককে যখন মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে, তারা যে আবারও মিয়ানমার থেকে পালানোর চেষ্টা করবে না—এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, বরং বিপরীতটা হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। আর তা যদি হয়, তবে তারা আশ্রয় নেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে উপযুক্ত মনে করবে। তাই এ বিষয়টি বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশ কি আরও ৪০ হাজার মানুষকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিজের সীমানায় আশ্রয় দিতে প্রস্তুত?
আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হলো, রোহিঙ্গাদের ‘অবৈধ অভিবাসী’ আখ্যা দিয়ে যখন ভারত থেকে বিতাড়নের প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত হচ্ছে, তখন আসামে অবৈধ অভিবাসী শনাক্তকরণ এবং নাগরিকত্বের নতুন তালিকা তৈরির বিতর্ক তুঙ্গে। আসামের এই নাগরিকত্বের খসড়া তালিকায় আপাতত ৪০ লাখ ব্যক্তিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই পুরো প্রক্রিয়া ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ও তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হচ্ছে। ২০১৪ সালের একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট আসামে নাগরিকত্বের তালিকা হালনাগাদ করার নির্দেশ দেন। এই আবেদনে ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫–এর ধারা ৬(এ)–কে অসাংবিধানিক বলে দাবি করা হয়। ধারা ৬(এ) নাগরিকত্ব লাভের ক্ষেত্রে শুধু আসামের জন্য একটি বিশেষ সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়, যা কিনা আসাম চুক্তি অনুযায়ী ধরা হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চকে। ধারাটিকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে সমগ্র ভারতের জন্যই একটি অভিন্ন সময়সীমার কথা বলা হয় আবেদনটিতে। আদালত নাগরিকত্ব হালনাগাদ করার নির্দেশ দিয়ে ধারা ৬(এ)–এর বৈধতার প্রশ্নটিকে একটি যথাযোগ্য সাংবিধানিক বেঞ্চের মাধ্যমে নিষ্পত্তির আদেশ দেন। ধারা ৬(এ)–এর বৈধতার প্রশ্নটি এখন শুনানির অপেক্ষায় আছে। তবে যদি ভবিষ্যতে সুপ্রিম কোর্ট ধারাটিকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেন, তাহলে বর্তমান আসামের এই নাগরিকত্ব হালনাগাদের পুরো প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। যেসব ব্যক্তি ১৯৭১-এর মার্চের আগেই আসামে প্রবেশ করেছিল বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে, তারাও নতুন করে নাগরিকত্বের তালিকা থেকে বাদ পড়বে। তাতে তালিকা তৈরির প্রক্রিয়াটি ইতিমধ্যে আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় শান্তি সুরক্ষায় যে নেতিবাচক প্রভাবের ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা না কমে বরং সংকট আরও বাড়বে।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের যে বেঞ্চটি আসামে নাগরিকত্বের তালিকা হালনাগাদের নির্দেশ দেন, সেটির বিচারক ছিলেন আসামের রঞ্জন গগৈ, যিনি খুব সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।
উল্লেখ্য, প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈর নেতৃত্বে গঠিত বেঞ্চই সাতজন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া বন্ধের আবেদন নাকচ করে দিয়েছিলেন। দেখার বিষয় যে নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আগামী দিনগুলোতে ভারতে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে আখ্যাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ভাগ্য নির্ধারণে সুপ্রিম কোর্টের বিচারিক মনোভাবে কী ধরনের পরিবর্তন আসে।
তাসলিমা ইয়াসমীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।
taslima47@yahoo.com