কলকাতার চিঠি

ভারতে ভোটযন্ত্রে ভোট এবং রাজনীতিকদের ভাবনা

১৯৯৯ সালে ভারতে প্রথম ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। তবে এর আগে ১৯৮২ সালে ভারতে প্রথম ইভিএম ব্যবহৃত হয় কেরালা রাজ্যের উত্তর পারাভুর বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে। তবে সে সময় মাত্র কয়েকটি ভোটকেন্দ্রে ব্যবহৃত হয়েছিল সেই ইভিএম। মূলত ১৯৯৯ সাল থেকে ভারতে ভোটযন্ত্রে ভোট নেওয়ার বিধি চালু করে ভারতের নির্বাচন কমিশন। পৌর ভোট থেকে রাজ্য বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনে এই ভোটযন্ত্রে বা ইভিএমে নেওয়া হয় ভোট। তবে মাঝে মাঝেই এই ভোটযন্ত্রে ভোট কারচুপির অভিযোগ ওঠে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন আগাগোড়াই বলে আসছে ভোটযন্ত্র বা ইভিএমে ভোট কারচুপির অবকাশ নেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা? হারলে ভোটযন্ত্রে কারচুপির অভিযোগ আনেন বিজিতরা। আর জিতলে ভোটযন্ত্র নিয়ে মুখ খোলেন না বিজয়ীরা। বন্ধ রাখেন তাঁদের মুখ।

গত ফেব্রুয়ারি-মার্চে অনুষ্ঠিত পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর এই ভোটযন্ত্র নিয়ে সোচ্চার হয় বিরোধীরা। অভিযোগ তোলে ভোটযন্ত্রে ব্যাপক কারসাজি করে, ভোট কারচুপি করে জিতেছে বিজয়ীরা। ভারতে লোকসংখ্যার দিক থেকে বৃহত্তম রাজ্য উত্তর প্রদেশে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এ বছর। পাঞ্জাব, উত্তরাখন্ড, মণিপুর ও গোয়া বিধানসভার নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছে।

উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর দেখা যায়, বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে বিজেপি। বিধানসভার ৪০৩টি আসনের মধ্যে ৩১২টিতে জয়ী হয় বিজেপি। অথচ ওই রাজ্যে শক্ত ঘাঁটি হিসেবে নাম ছিল মুলায়ম সিং যাদবের সমাজবাদী পার্টি (এসপি) এবং মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টির (বিএসপি)। বিজেপির এই জয়কে মেনে নিতে না পেরে নির্বাচনের ফল ঘোষণার দিনই বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতী অভিযোগ তোলেন, ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) কারচুপির মাধ্যমে বিপুল ভোটে জিতেছে বিজেপি। জনগণ বোতাম টিপে তাঁদের দলকে ভোট দিলেও ভোট পড়েছে বিজেপির প্রতীকে। একই দাবি তোলেন আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালও।

পাঞ্জাব বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয় কংগ্রেস। এখানে জয়ের সম্ভাবনা ছিল আম আদমি পার্টির। ফলে কেজরিওয়ালও
দাবি তোলেন ভোট কারচুপির। ভোটযন্ত্রে কারচুপির এই অভিযোগ আসে সমাজবাদী পার্টি, এনসিপি, কংগ্রেস, ডিএমকে, জনতা দল (সংযুক্ত), বাম দলসহ এক ডজন রাজনৈতিক দল থেকে। তারা আগের পদ্ধতিতে ভোট দেওয়ার দাবি তোলে। অর্থাৎ ব্যালট পেপারে সিল দিয়ে ভোট করাতে হবে। কিন্তু তাতে সায় দেয়নি কেন্দ্রীয় সরকার বা ভারতের নির্বাচন কমিশন। এসব ঘটনায় ভোটযন্ত্র নিয়ে মানুষের মনে সংশয় দেখা দেয়। মানুষ ভাবতে থাকে তবে কি ক্ষমতার অলিন্দে থাকা রাজনৈতিক দল ভোটযন্ত্রে কারচুপি করে জয়ের পথ প্রশস্ত করছে?

ভোটযন্ত্রে কারচুপি নিয়ে অভিযোগ ওঠে খোদ নির্বাচন কমিশনেও। মামলাও হয়। কিন্তু নাছোড়বান্দা জাতীয় নির্বাচন কমিশন। তারা বারবার বিবৃতি দিয়ে জানায়, ভোটযন্ত্রে কারচুপির অবকাশ নেই। তাতেও সন্তুষ্ট হতে পারেনি ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।

এরপরই ভারতের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নাসিম জাইদি ভোটযন্ত্র বা ইভিএম চ্যালেঞ্জের দিন ঘোষণা করেন। তারিখ নির্ধারিত হয় ৩ জুন। বলা হয়, ওই দিন নির্বাচন কমিশনে এসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রমাণ করে দেখাক এই ইভিএম মেশিন দিয়ে ভোট কারচুপি করা যায়। বদলানো যায় ভোটের ফলাফল। এই লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন দিনও নির্ধারণ করে। এরপরই মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ভারতের ৭টি জাতীয় রাজনৈতিক দল এবং ৪৯টি আঞ্চলিক দলকে আমন্ত্রণ জানান ভোট মেশিন হ্যাক করে কীভাবে ভোট কারচুপি করা যায় তা দেখানোর জন্য। এ জন্য বিধানসভা ভোটে ব্যবহৃত পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখন্ডের ১৪টি ইভিএম মেশিন রাখা হয় নির্বাচন কমিশনে। কিন্তু নির্ধারিত দিনে সিপিএম এবং এনসিপি উপস্থিত হয়ে চ্যালেঞ্জ জানায়নি। বরং তারা ভোটযন্ত্রে ভোট গ্রহণ পদ্ধতি দেখে সন্তোষ প্রকাশ করে। আর ওই দিন অন্য কোনো দল নির্বাচন কমিশনে হাজির হয়ে নির্বাচন কমিশনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেনি। যদিও নির্বাচন কমিশন চ্যালেঞ্জ রেখেছিল, ইভিএমে এবার বিরোধী দল দেখাক এই ইভিএম কীভাবে হ্যাক করা যায়। কিন্তু সেই ডাকে কেউ সাড়া দেননি। অধিকাংশ দলই চ্যালেঞ্জ করতে নির্বাচন কমিশনের চৌকাঠও মাড়ায়নি। তারপরই মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জানিয়ে দেন, ভোটে স্বচ্ছতা আনতে এবার ইভিএম মেশিনের সঙ্গে ভিভিপ্যাট বা ভোটার ট্রেল মেশিন লাগানো হবে। এতে করে ভোটার পরীক্ষা করে দেখতে পারবেন ঠিক জায়গায় তাঁর ভোটটি পড়েছে কি না? এতে করে ভোটদানের গোটা প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আসবে। তিনি আরও জানিয়ে দেন, আর পেছনে গিয়ে ব্যালটে ভোট করানোর সুযোগ নেই। তিনি এ কথাও বলেন, ভোট দেওয়ার ৭ সেকেন্ডের মধ্যেই ভিভিপ্যাট থেকে একটি স্লিপ বেরিয়ে আসবে, সেই স্লিপ দেখেই ভোটাররা নিশ্চিত হতে পারবেন তাঁরা ঠিক জায়গায় ভোট দিয়েছেন কি না। যদিও ভিভিপ্যাটের সেই স্লিপ নিয়ে ভোটাররা অবশ্য বাইরে যেতে পারবেন না। ভোটকেন্দ্রে থাকা নির্দিষ্ট একটি বাক্সে ফেলতে হবে সেই স্লিপটি। তাই নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দেয় ভবিষ্যতের নির্বাচন হবে ভিভিপ্যাটযুক্ত ইভিএমে। আর এই পদ্ধতিতে এ বছরের শেষের দিকে ভারতের গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশের বিধানসভার নির্বাচন হবে। এর আগে অবশ্য ২০১৪ সালের সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে দেশের ৫৪৩টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ৮টিতে ভিভিপ্যাটযুক্ত ইভিএমে ভোট নেওয়া হয়েছিল।

নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, ১৬ কোটি ১৫ লাখ ভিভিপ্যাট কিনতে খরচ হবে ৩ হাজার ১৭০ কোটি রুপি। আর আগামী ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে এই নতুন মেশিন দেওয়া হবে। অর্থাৎ ভিভিপ্যাটযুক্ত ইভিএম।

তাই বলতে হয়, বিরোধীরা ইভিএম নিয়ে অভিযোগ তুলে শেষ পর্যন্ত সেই অভিযোগকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেনি নির্বাচন কমিশনে। বরং বলতে হয়, নির্বাচন কমিশন যেভাবে জোর দিয়ে বলেছে ইভিএম ঠিক। এতে ভোট কারচুপি করার অবকাশ নেই। সে কথাই শেষ পর্যন্ত সঠিক বলে প্রমাণিত হলো।

এবার দেখা যাবে ২০১৯ সালে ভারতের জাতীয় বা লোকসভা নির্বাচনে এই ভিভিপ্যাটযুক্ত ইভিএমে কীভাবে ভোটযুদ্ধ সম্পন্ন হয়। তখন কি পরাজিতরা ফের অভিযোগ তুলবেন ভিভিপ্যাটযুক্ত ইভিএম ঠিক নয়, কারচুপি করা যায়? দেখা যাক কী ঘটে সেই নির্বাচনে।

অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।