কয়েক দিন আগে ভারত সরকার ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করায় ভারতজুড়ে এক তোলপাড় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তার আঁচ লেগেছে বর্তমানে ভারতে সফররত বাংলাদেশি পর্যটকদের ওপরও। বাংলাদেশি নাগরিকদের এক প্রিয় গন্তব্য ভারত। প্রধানত দুই কারণে বাংলাদেশের নাগরিকেরা ভারতে যান। ১) চিকিৎসা ও ২) পর্যটন। এ ছাড়া ’৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া হিন্দু পরিবারের সদস্যরাও স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে থাকেন।
বর্তমানে ভারত সফররত বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রায় ৯০ শতাংশই ভারতীয় নোট বাতিলের কারণে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তাঁদের সহায়তা করার জন্য কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনের কোনো উদ্যোগ নেই। একমাত্র সোনালী ব্যাংকের কলকাতা শাখা ত্রাতা হিসেবে এগিয়ে এসেছে।
এবার ভারতে গিয়ে বাংলাদেশিরা নানা সমস্যায় পড়েছেন। যাঁদের হাতে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট ছিল (বেশির ভাগ ব্যক্তির হাতেই তা থাকে), তাঁরা শুধু হাসপাতালের বিল মেটাতে পেরেছেন। প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে ওষুধ কিনতে পেরেছেন। প্লেনের টিকিট কিনতে পেরেছেন। এ রকম আরও কয়েকটি ব্যাপারে সরকারের ‘ছাড়’ ছিল। হোটেল বা গেস্ট হাউসের বিল মেটাতে পারছেন না বলে হোটেল বা গেস্ট হাউস ছাড়তে হয়েছে সপরিবারে। বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়েছেন বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে। কলকাতা বা অন্য কোনো শহরে বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি বা কেনার সব দোকানই বন্ধ। কারণ, দোকানির হাতে ভারতীয় কোনো নগদ টাকা নেই। অর্থাৎ, তাঁরা নগদ ২০০০ ও ১০০ টাকার নোটের বড় অঙ্ক ব্যাংক থেকে সংগ্রহ করতে পারছেন না। বিভিন্ন ব্যাংক বাতিল নোটের বদলে নতুন ২০০০ বা পুরোনো ১০০ টাকার নোট দিচ্ছে। তা-ও নির্দিষ্ট পরিমাণে ও ভোটের মতো ডান হাতে কালি দিয়ে, যাতে দ্বিতীয়বার নোট বদলাতে আসতে না পারে। আর এই সামান্য টাকাও বিনিময় করতে হচ্ছে ব্যাংকে প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে।
বাংলাদেশি বা অন্য বিদেশি নাগরিকদের এই সুবিধা দেওয়া হয়নি। নোট বদলানোর সুবিধা পেয়েছেন শুধু ভারতীয় নাগরিকেরা। কাজেই বাংলাদেশের যেসব নাগরিক ডলার নিয়ে ভারতে গেছেন, তাঁদের ডলার কোনো কাজে আসছে না। ডলার ভাঙানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশি টাকাও বদল করা যাচ্ছে না। বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচার সব দোকানই তো বন্ধ। কবে খুলবে তা কেউ জানেন না। এই সুযোগে একশ্রেণির মুদ্রা ব্যবসায়ী কালো পথে ডলারপ্রতি ৩০-৪০ রুপি (প্রকৃত মূল্য ৬৬ রুপি), বাংলাদেশি ১০০০ টাকার বদলে ভারতীয় ৫০০ রুপি দিচ্ছে। কোথাও–বা আরও কম দিচ্ছে। এসব টাকাও লেনদেন হচ্ছে অতি গোপনে। তাঁরা কেউ প্রকাশ্যে আসেন না। দু-তিনজনের হাত ঘুরে এই অবৈধ লেনদেন হচ্ছে। কিন্তু অনেক অসহায় বাংলাদেশি এই রেটেও ভারতীয় রুপি লুফে নিচ্ছেন। কারণ, তাঁদের হাতে ভাত খাওয়া বা ট্যাক্সি ভাড়া দেওয়ার মতো কোনো রুপি নেই। পুরো পরিবার নিয়ে অনেকে অভুক্ত থাকছেন। কলকাতার পত্রিকায় পড়েছি, কোনো কোনো হাসপাতাল এলাকার রেস্টুরেন্ট, গেস্ট হাউস, মুদির দোকানের মালিক বাংলাদেশিদের ধারে খাওয়াচ্ছেন, হোটেলে রাখছেন। তাঁদের বক্তব্য, এই বাংলাদেশিদের জন্যই তো আমরা ব্যবসা করে খাচ্ছি। আজ তাঁরা বিপদে পড়েছেন, আমরা তাঁদের দেখব না তো কে দেখবে?
যেসব বাংলাদেশি ব্যাংকের ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড ব্যবহার করেন, তাঁরা অনেকটা রক্ষা পেয়েছেন। কারণ, প্লাস্টিক টাকা সবখানে সচল। তবে বাস, মেট্রো বা ট্যাক্সি ভাড়া কার্ডে দেওয়া যায় না। ছোট রেস্টুরেন্টে খাওয়ার বিল কার্ডে নেওয়া হয় না। এসব জায়গায় কার্ডধারীরাও সুবিধা করতে পারছেন না। এটিএম মেশিনেও সীমিত টাকা পাওয়া যায়। বেশির ভাগ এটিএম মেশিন নগদ টাকার অভাবে বন্ধ।
কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনের উচিত ছিল, এ সময় জরুরি প্রয়োজন বা আমন্ত্রণ ছাড়া বাংলাদেশি নাগরিকেরা যাতে ভারত বা কলকাতা সফর না করেন—এই মর্মে বাংলাদেশে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা। শুধু কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশন কেন, দিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনেরও এ ব্যাপারে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা উচিত ছিল। আসলে এই সরকারি অফিসগুলো সরকারি মন্ত্রী, এমপি, ভিআইপি বা আমলাদের বিষয় ছাড়া সাধারণ মানুষের সমস্যা সম্পর্কে তেমন আগ্রহী নয়। একমাত্র ভিসা দেওয়া ছাড়া।
প্রশংসনীয় কাজ করছে সোনালী ব্যাংক কলকাতা শাখা। তারা এই দুঃসময়ে ভ্রমণরত প্রত্যেক বাংলাদেশি নাগরিককে পাসপোর্টপ্রতি ১০০ ডলারের বিনিময়ে ভারতীয় মুদ্রা দিচ্ছে। জরুরি প্রয়োজন প্রমাণ করতে পারলে দু-তিন শ ডলারের বিনিময়েও রুপি দিচ্ছে। এই ১০০ ডলার ভাঙানোর জন্য ভোর ছয়টা থেকে হো চি মিন সরণিতে সোনালী ব্যাংক শাখায় বাংলাদেশি নাগরিকেরা লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রুপি দেওয়া হচ্ছে। সোনালী ব্যাংকের সীমাবদ্ধতার কথা ব্যাংকের সিইও আলী মর্তুজা জানালেন, তাঁরা চাহিদামতো ভারতীয় রুপি (১০০ টাকার নোট) ‘রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’ থেকে পাচ্ছেন না। ফলে সোনালী ব্যাংক পর্যটকদের চাহিদামতো ডলারও বিনিময় করতে পারছে না।
ভারত সরকার নোট বাতিলের পাশাপাশি অনেক রকম ‘ছাড়’ দিয়েছে, যাতে সাধারণ মানুষ একেবারে অসহায় হয়ে না পড়েন। প্রতিদিনই নতুন নতুন ‘ছাড়’ ঘোষণা করা হচ্ছে। এগুলো প্রশংসনীয়। কিন্তু আমরা জানি, ভারত একটি ‘পর্যটনবান্ধব’ দেশ। ভারতের অনেক শহরে প্রায় সারা বছর পর্যটকে গিজগিজ করে। নোট বাতিলের এই আকস্মিক ঘোষণায় অনেক পর্যটক বড় রকম সমস্যায় পড়েছেন। অনেকে ভারত ছেড়ে দ্রুত অন্য দেশে চলে যাচ্ছেন। ভারত সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিদেশি পর্যটকের কথা একেবারেই ভাবেননি। বাতিল নোট-সংক্রান্ত নানা ‘ছাড়ের’ মধ্যে ভারতে পর্যটনরত (ও চিকিৎসার জন্য) গত কয়েক মাসের মধ্যে যাঁরা ভারতে প্রবেশ করেছেন, (পাসপোর্ট দ্রষ্টব্য) তাঁদের প্রতি শহরের একটি নির্দিষ্ট ব্যাংকে অন্তত ৫০০ ডলার বদলানোর সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। এতে বহু পর্যটকের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হতো, পর্যটকেরা ভারত সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ হতেন না। তবে বেশির ভাগ (প্রায় ৯০ শতাংশ) বিদেশি পর্যটকের (বাংলাদেশি কম) নানা রকম প্লাস্টিক কারেন্সি থাকে, সেটাই রক্ষা।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।