তিনটি অঙ্গীকারের জন্য দক্ষিণপন্থী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নিজেদের ‘পার্টি উইথ আ ডিফারেন্স’ বা ভিন্ন ধারার দল বলে দাবি করে। সেই তিন অঙ্গীকারের একটি জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার। লক্ষ্যটি তারা পূর্ণ করেছে। দ্বিতীয়টি অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জায়গায় রামচন্দ্রের মন্দির প্রতিষ্ঠা। দীর্ঘ মামলা শেষে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সেই লক্ষ্যও আর অপূর্ণ থাকবে না। মনে করা হচ্ছে, লোকসভার পরবর্তী ভোটের আগেই মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে যাবে। তৃতীয় অঙ্গীকার ভারতের সবার জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রচলন। তিন তালাক নিষিদ্ধ করে সেই দিকে তারা অনেকটাই এগিয়ে গেছে। এবার নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন এনে পৃথিবীর একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হওয়ার পথে ভারত একটা বড় লাফ দিল।
এই লাফটা তারা কেন মারল, ভারতীয় সংসদের উভয় কক্ষে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তা জানাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। তাঁর ব্যাখ্যায় যত দোষ জওহরলাল নেহরু ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর। দ্বিজাতিতত্ত্ব মেনে তাঁরা দেশ ভাগ না করলে বাহাত্তর বছর পর সেই ‘পাপের’ প্রায়শ্চিত্ত বিজেপিকে করতে হতো না। নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহর বিজেপির চোখে নেহরু এবং কংগ্রেসই যত নষ্টের গোড়া। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা তাদেরই দেওয়া। ধর্মনিরপেক্ষতার নাম করে দশকের পর দশক ধরে ভোট পাওয়ার স্বার্থে সংখ্যালঘু তোষণও তারা চালিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়প্রমাণ এসব ভুল শুধরে বেলাইনে চলা দেশকে ঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব বিজেপিকেই নিতে হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভণিতা না করেই জানিয়েছেন, ১৯৫০ সালে নেহরু-লিয়াকত চুক্তি ঠিকঠাক বাস্তবায়িত হলে আজ তাঁদের এইভাবে নাগরিকত্ব বিল সংশোধন করতে হতো না।
এই সংশোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের যেসব অমুসলমান নাগরিক, ‘ধর্মীয় অত্যাচার’ সইতে না পেরে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁদের সবাইকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। তাঁদের আর ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে চিহ্নিত করা হবে না। তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা থাকলে সেসব প্রত্যাহৃত হবে। তাঁদের ‘সম্মানজনক’ জীবনযাপনের অধিকার দেওয়া হবে। মুক্ত করা হবে ‘নরক যন্ত্রণা’ থেকে। বিরোধীদের কোনো আপত্তিই ধোপে টেকেনি। ‘অত্যাচারিত’ মুসলমান শরণার্থীদের কেন নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না, কেন ধর্মের নিরিখে নাগরিকত্বের বিভেদ করা হচ্ছে, সংবিধান লঙ্ঘিত হচ্ছে, এসব যুক্তি কানেই তোলা হয়নি। লক্ষ্যে অবিচল থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেরুকরণের পথে বিজেপি সরকার গটগট করে এগিয়ে গেছে।
বিস্ময় ও আশ্চর্য এখানেই লেপ্টে রয়েছে। দ্বিজাতিতত্ত্ব মেনে ভারত ভাগের ২৪ বছর পর সেই তত্ত্বকে অসার প্রতিপন্ন করে বাংলাদেশের জন্ম। বাংলাদেশের জন্ম যে অর্থে ওই তত্ত্বের উল্টো পথে হাঁটা, নাগরিকত্ব বিলের সংশোধন সেই অর্থে ওই তত্ত্বকে নতুন করে বুকে আঁকড়ে ধরা। বিজেপির ভারতের পেছন দিকে এগিয়ে চলার এর চেয়ে ভালো নমুনা আর কী হতে পারে?
বিল পাস করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ‘সমাজসংস্কারক’-এর সার্টিফিকেট দিয়েছেন অমিত শাহ। বলেছেন, শুধু রাজনীতি করতে তাঁরা আসেননি; রাজনীতিকেরা রাজনীতিই তো করবেন। তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। সমাজসেবার মোড়কে এটাও যে ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টা, নতুন করে তা বলার কোনো মানে হয় না। কিন্তু সেখানেও একটা বড়সড় ফাঁক থেকে যাচ্ছে। বিলের ‘লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে’ লেখা রয়েছে ‘ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত শরণার্থীদের’ নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা। অথচ মূল বিলের কোথাও তার উল্লেখ নেই! এর আগে বিলটি বিবেচনার সময় সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্তা দেশে ‘ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত শরণার্থীদের’ সংখ্যা জানাতে পারেননি। ভারতের গোয়েন্দাপ্রধান সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এসে একবার জানিয়েছিলেন, তিন দেশ থেকে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে চলে আসা ৩১ হাজার ৩১৩ জন ‘সংখ্যালঘু’ ভারতের নাগরিকত্ব চান। বিস্মিত সাংসদেরা জানতে চেয়েছিলেন, মাত্র এই কজন? বাকিরা? তাঁর উত্তর ছিল, অন্যরা নানা উপায়ে নাগরিকত্ব পেয়ে গেছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য এই ব্যাখ্যা মানতে চাননি। রাজ্যসভায় তিনি বলেন, শরণার্থীরা নানা কারণে নিজেদের পরিচয় গোপন করেন। সবচেয়ে বড় কারণ এই বিল এত বছর না আসা। এখন দেখা যাবে, লক্ষ-কোটি মানুষ নাগরিকত্ব পেতে দরবার করছেন। রাজনীতি এখানেই। সংখ্যাগরিষ্ঠের এই মেরুকরণে।
বহু আইনজ্ঞের মতো বিরোধীদেরও বিশ্বাস, এই আইন বিচার বিভাগের মান্যতা পাবে না। কারণ, যে বিলটি পাস করা হলো, তা সংবিধানবিরোধী। দেশের সুপ্রিম কোর্ট কী করবেন, সেই অনুমান অর্থহীন। আইনজ্ঞরাও সর্বোচ্চ আদালতের সাম্প্রতিক কিছু ভূমিকায় সংশয়ী ও সন্দিহান। সরকারের কাশ্মীর-সিদ্ধান্ত সংবিধানসম্মত কি না, আজও তা বিবেচিত হয়নি! তাই বলে সেই সিদ্ধান্তের রূপায়ণ কিন্তু থেমে নেই! সুপ্রিম কোর্ট ইদানীং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় দিয়েছেন ‘মুখবন্ধ খামে’ দাখিল করা তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে। রাফাল মামলা তার অন্যতম। নিজেদের বেঁধে দেওয়া নিয়ম অগ্রাহ্য করে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে আনা শ্লীলতাহানির অভিযোগ অসত্য প্রতিপন্ন করা হয়েছে। কাজেই নাগরিকত্ব বিলের সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্নটি বিবেচিত হলে সুপ্রিম কোর্ট কী ব্যাখ্যা দেবেন, তা অনুমান করা ঠিক নয়।
বিলের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে গিয়ে অমিত শাহ তিন দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর ‘অমানুষিক অত্যাচারের’ উদাহরণ দেখিয়েছেন। তবে কিছুটা ‘কূটনৈতিক শিষ্টাচারের’ নমুনা রেখেছেন ‘বিশ্বস্ত ও বন্ধুদেশ’ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম করে বলেছেন, যত দিন তিনি জীবিত ছিলেন, তত দিন সংখ্যালঘুরা নিরাপদ ছিলেন। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাও সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষায় কঠোর। অত্যাচারের কথা বলতে গিয়ে তিনি নাম নিয়েছেন বিএনপির। কোথায়, কবে, কীভাবে এবং কত সংখ্যালঘু অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হয়েছেন, সেই ফিরিস্তি শুনিয়েছেন। বেশ বোঝা যায়, এই বিল নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কহানি করতে সরকার রাজি নয়।
তা হয়তো নয়, কিন্তু বাস্তবিক অবস্থাটা কী? তিন প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এনআরসি ও নাগরিকত্ব বিল নিয়ে সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় বাংলাদেশ। সেই দুশ্চিন্তা, আশঙ্কা ও উদ্বেগের কথা ‘বিশ্বস্ত’ ওই দেশ বারবার প্রকাশও করেছে। কিন্তু লাভ হয়নি। রাজনৈতিক লক্ষ্যে বিজেপি সরকার অবিচল।
শেখ হাসিনার বাংলাদেশের চোখে এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো কেমন? ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলেন তারিক এ করিম। শেখ হাসিনার অত্যন্ত কাছের এই সাবেক কূটনীতিকের লেখা এক সাম্প্রতিক নিবন্ধ তার ইঙ্গিতবাহী। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের বহু মানুষ এখন মনে করছেন, ভারত ধর্মনিরপেক্ষতার রাস্তা থেকে সরে এসে দ্বিজাতিতত্ত্বকে মান্যতা ও বৈধতা দিচ্ছে। গত অক্টোবরে দিল্লিতে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ইন্ডিয়া ইকোনমিক সামিটে দেওয়া শেখ হাসিনার ভাষণের কিছুটা অংশ তারিক এ করিম তাঁর নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন। শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘু মানসিকতা থেকে বের হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার উচিত আঞ্চলিক, জাতিগত ও ভাষাগত বিভিন্নতা আঁকড়ে এগিয়ে চলা। শত শত বছর ধরে বহুত্ববাদই দক্ষিণ এশিয়ার প্রকৃত শক্তি।’ নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ধর্মনিরপেক্ষতা ঝেড়ে ফেলে দ্বিজাতিতত্ত্বের দিকে ঝুঁকে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে ভারতের এই এগিয়ে চলা বাংলাদেশিদের মনে যদি এই প্রশ্নের জন্ম দেয় যে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ থেকে কী লাভ, তাহলে?
নাগরিকত্ব বিলের আইনি স্বীকৃতি পাওয়া এখন স্রেফ সময়ের ব্যাপার। সারা দেশের জন্য নাগরিক তালিকা তৈরির অঙ্গীকারের কথাও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে দৃপ্তকণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছেন। দুটি সিদ্ধান্তই শেখ হাসিনার বাংলাদেশকে বিরাট এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে। তিনটি বিষয় কিন্তু ভুললে চলবে না। প্রথমত, বাংলাদেশে এখনো ১ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু বসবাস করছেন। দ্বিতীয়ত, ঐতিহাসিকভাবে সেই দেশে ভারতবিরোধীদের সংখ্যা প্রবল। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্রমোন্নতি সত্ত্বেও বিরোধিতা বাড়ছে। এবং তৃতীয়ত, প্রতিটি ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। ভারতীয় শাসকদের এই তথ্যাদি না জানার কথা নয়।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি