ক্ষমতায় থাকার জন্য কর্তৃত্ববাদীরা বিশ্বজুড়ে এখন অচিন্তনীয়ভাবে বেপরোয়া। হাসি-ঠাট্টা-কৌতুক-কার্টুন ইত্যাদি নিষিদ্ধ করার আন্তমহাদেশীয় বিবরণ দেওয়া হয়েছিল প্রথম আলোতে ১৫ ডিসেম্বরের এক লেখায়। ব্যাপারগুলো কৌতুককর তবে টিকে থাকার মরণকামড়ও বটে। রাজনীতির তরফ থেকে এ রকম কৌতুকভরা আচরণ থেমে নেই। ভারতের ক্ষমতাসীন দল সেই তালিকায় যুক্ত করল এবার ডিম নিষিদ্ধ করার আয়োজন।
দোকানে, রাস্তাঘাটে ডিম দেখা গেলে বিপদ!
গরু ও তার শরীর নিঃসৃত নানান উপাদান বহুকাল ভারতে রাজনীতির হট আইটেম হিসেবে আছে। বিজেপির সফলতার অন্যতম ভিত্তি ‘গরু’। বহু রাজ্যে মাংস নিষিদ্ধ করে এবং মাংস খাওয়া নাগরিকদের পিটিয়ে ভোটের অঙ্ক বিপুলভাবে বাড়াতে পেরেছে তারা। সফলতার সেই অধ্যায়ে এবার ডিম যুক্ত করতে চাইছে দলটি। বিজেপি সচরাচর যেকোনো নতুন প্রকল্পের নিরীক্ষা শুরু করে গুজরাট থেকে। সে সূত্রে আহমেদাবাদ, সুরাটসহ আশপাশের কয়েক শহরে এবার ডিম বেচা অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে। কেবল খাওয়া নয়, রাস্তাঘাটে, দোকানে দেখানোও যাবে না ডিম।
লক্ষ্য মূলত সাংস্কৃতিক আধিপত্য
বিজেপির থিঙ্কট্যাংক বলছে, ডিম দেখলে ধর্মপ্রাণ মানুষের অনুভূতি আহত হয়। ‘অনুভূতি’র রাজনীতিতে বিজেপি খুব দক্ষ। ২৫ বছর তারা গুজরাটে ক্ষমতায় আছে এসব করে। গরু জবাই নিষিদ্ধ ছিল অনুভূতির রাজনীতির বড় এক পদক্ষেপ। ২০১৭ থেকে এই রাজ্যে এখন সব আমিষ নিষিদ্ধ করার চেষ্টায় আছে আরএসএস পরিবার। ‘গুজরাট মডেল’কে অনুসরণ করতে চায় তাদের হাতে থাকা অন্যান্য প্রদেশও। একে একে সমগ্র ভারতকে বিজেপি তার খাদ্যনীতিতে আনতে চায়। ডিমে নিষেধাজ্ঞা আপাতদৃষ্টে নিরামিষভোজীদের অনুভূতির দোহাই দিয়ে শুরু হলেও এর মূল লক্ষ্য আমিষভোজী সংখ্যালঘুদের মানসিক ও শারীরিক পীড়নে রাখা। সংস্কৃতির সব পরিসরে নিজেদের চিন্তা ও অভ্যাসের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর আরএসএস।
বিজেপির খাদ্য রাজনীতিতে বিব্রত সেক্যুলাররা
রাজনীতি, সংস্কৃতি থেকে শুরু করে ফুটপাতের খাবারের দোকান পর্যন্ত ধর্মকে টেনে আনার সঙ্গে ভোটের সম্পর্ক প্রবল। সে কারণে বিজেপিবিরোধীরা শক্তভাবে ডিম পছন্দকারী ব্যক্তিদের পক্ষে দাঁড়াবে না বলেই অনুমান করা যায়। গুজরাট কংগ্রেস মৃদু ভাষায় বিজেপির উদ্যোগের বিরোধিতা করলেও ধীরে ধীরে পিছু হটবে বলে ইঙ্গিত মিলছে। স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের কথা—বিজেপি কর্মীরা ডিম বিক্রেতাদের ওপর চাঁদার কোটা বাড়াতে এই কর্মসূচি নিয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, কংগ্রেস ডিম নিষেধাজ্ঞার নীতিগত বিতর্ক এড়িয়ে যেতে চায়। কংগ্রেসের চেয়ে বরং গুজরাট হাইকোর্টের অভিমত এ বিষয়ে যৌক্তিক। রাস্তার আমিষ বিক্রেতা ২৫ হকারের এক আবেদনের সূত্রে ৯ ডিসেম্বর বিচার বিভাগ আহমেদাবাদের মেয়রকে জিজ্ঞাসা করেছে, কে কী খাবে, সেটা কীভাবে আপনি ঠিক করে দিতে পারেন? আদালতে মাননীয় বিচারপতি কৌতুকমেশানো গলায় বলেন, আখের রসে ডায়াবেটিস হয়—রাস্তাঘাটে এটা বন্ধে কি মেয়র উদ্যোগ নেবেন? কিংবা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনায় বনেদি কফি শপগুলো কি বন্ধ করা হবে?
২০১৭ থেকে গুজরাটে সব আমিষ নিষিদ্ধ করার চেষ্টায় আছে আরএসএস পরিবার। ‘গুজরাট মডেল’কে অনুসরণ করতে চায় তাদের হাতে থাকা অন্যান্য প্রদেশও। একে একে সমগ্র ভারতকে বিজেপি তার খাদ্যনীতিতে আনতে চায়। ডিমে নিষেধাজ্ঞা আপাতদৃষ্টে নিরামিষভোজীদের অনুভূতির দোহাই দিয়ে শুরু হলেও এর মূল লক্ষ্য আমিষভোজী সংখ্যালঘুদের মানসিক ও শারীরিক পীড়নে রাখা।
বিচার বিভাগের উদারনৈতিক এই অভিমত সত্ত্বেও রাজ্যে রাজ্যে ইতিমধ্যে ডিম নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে ভারত। কর্ণাটকে সরকার কয়েকটি জেলায় স্কুলে বাচ্চাদের দুপুরের খাবারে ডিম দিতে চাইলে আরএসএস বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে তার বিরুদ্ধে নামিয়েছে। আরএসএস পরিবার সচরাচর সাংস্কৃতিক রাজনীতিকে ‘অরাজনৈতিক’ চরিত্রের সংগঠনগুলোকে দিয়ে প্রথমে সামনে নিয়ে আসে। সেটার চাষবাস গতি পেলে তারপর ‘ইস্যু’টিকে নির্বাচনী ইশতেহারে আনা হয়।
গুজরাট কংগ্রেসের মতো কর্ণাটক কংগ্রেসও ডিম বিতর্কে বিব্রত। তারা বলছে, রাজ্যের লাখ লাখ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। স্কুলের খাবারে ডিম থাকলে বাচ্চাদের শরীর-স্বাস্থ্যের জন্য ভালোই হবে। স্পষ্ট যে তারাও মানুষের পছন্দসই খাবারের অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে ভোট কমার ঝুঁকি নিতে চাইছে না।
অনুভূতির রাজনীতি বনাম ডিমের অর্থনীতি
ডিম নিয়ে বিজেপির চলতি রাজনীতির ভেতর কৌতুক কিংবা ভবিষ্যৎ ভীতির পাশাপাশি আছে করুণ এক অর্থনৈতিক শঙ্কাও। ভারত ডিম উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় পরাশক্তি। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরই তার অবস্থান। ১১৫ বিলিয়ন ডিম উৎপাদন করে এই দেশ। জনপ্রতি বছরে প্রায় ৯০টা ডিম খায় এ দেশের মানুষ। ডিমের সংখ্যা বাড়াতে বিপুল বাণিজ্যিক বিনিয়োগ হয়েছে গত দশকে এ দেশে। কিন্তু বিজেপির ধর্মবাদী খাদ্যনীতি ওই বিনিয়োগকারীদের ঝামেলা বাড়াচ্ছে। বিপদে ফেলছে খুদে চাষি পরিবারগুলোকেও। হিসাবটি খুব সহজ। প্রতি ডিমের দাম ৫০ পয়সা কমা মানে উৎপাদকদের প্রায় ৬০ বিলিয়ন রুপি হারিয়ে যাওয়া।
ভারতে ডিমের দামে পতন বাংলাদেশেও দূরবর্তী খারাপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে। যে পাঁচ রাজ্যে বেশি ডিম উৎপাদিত হয়, তাতে পশ্চিমবঙ্গও আছে। বিনিয়োগ ও মুনাফা ধরে রাখতে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের এ মুহূর্তে একটাই বিকল্প, আশপাশের দেশে বাজার বাড়ানো। বাংলাদেশ অবশ্যই তাদের জন্য বড় এক বাজার।
যেহেতু বিজেপি কেবল ডিম নয়, সব আমিষই বাদ দেওয়াতে চায়, সে কারণে হাঁস-মুরগি পালনই তাতে নিরুৎসাহিত হবে। ‘অনুভূতি’ ও অর্থনীতির এ রকম সমন্বয়হীনতায় দেশটির নাগরিকদের অবস্থা বোঝা যায় মূল্যস্ফীতির সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে। জিনিসপত্রের দাম ১৪ দশমিক ২৩ ভাগ বাড়ার কথা বলছে দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ২০১১-এর পর এটা দাম বাড়ায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। ২০২০ নভেম্বরেও প্রতিদিনকার জিনিসপত্রের দাম বেড়েছিল মাত্র ২ শতাংশ। সম্প্রতি বেশি বেড়েছে সবজির দাম, যা থেকে দরিদ্রদের অবস্থা অনুমান করা যায়। বার্তাটি স্পষ্ট, বিজেপি যখন ডিম নিয়ে সমাজকে সিদ্ধ করছে, তখন দেশটিতে সাধারণ পরিবারগুলোতে সেদ্ধ ডিমের মতো খাবার পাওয়া জরুরি হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারে এটা সস্তায় প্রোটিনের বড় উৎস।
নিত্যদিনের খাবার নিয়ে এ মুহূর্তে সংকটে আছে শ্রীলঙ্কাও। সিংহলা জাতীয়তাবাদ মুসলমানদের হালাল ফুডের দোকান বন্ধে তুমুল রাজনীতি করছে কয়েক বছর। খাবারের প্যাকেটে ‘হালাল’ লোগো তুলে ফেলতে হয়েছে সেখানে প্রভাবশালী ভিক্ষু সংগঠনগুলোর বয়কটের হুমকিতে। এসব আন্দোলনে ভোটের অঙ্কে রাজাপক্ষের পরিবারের দারুণ সুবিধা হয়েছে গত নির্বাচনে। তবে ওই পরিবারের শাসনে গত ছয় মাসের অভিজ্ঞতা হলো বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে দেশটিতে শিশুখাদ্যসহ বহু জরুরি পণ্য দোকানপাটে মিলছে না। তাতে বিপদে পড়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ পরিবারগুলোও।
রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বেও জাতীয়তাবাদ জনপ্রিয়
খাদ্য নিয়ে রাজনীতি কেবল উপমহাদেশের দেশগুলোতেই হচ্ছে, তা নয়। বিশ্বজুড়েই জাতীয়তাবাদ আদর্শিক দেউলিয়াপনায় ভুগছে এখন। ভারতে ডিমের বেচাকেনা ঠেকানো কিংবা শ্রীলঙ্কায় হালাল ফুডের দোকান বন্ধ করা—তার ছোট ছোট নমুনা মাত্র।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশে কোটি কোটি শিশু না খেয়ে কিংবা আধা পেট খেয়ে স্কুলে যায়। সেই সূত্রে অপুষ্টির শিকার তারা। এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কৃষিতে সমৃদ্ধ পাঞ্জাবে ৪০ ভাগ স্কুলগামী শিশু খালি পেটে বই-খাতা নিয়ে বের হয়। অন্য প্রদেশগুলোর অবস্থা নিশ্চিতভাবে এর চেয়ে খারাপ। ওপরে বিজেপির ডিম রাজনীতির অন্যতম পীঠস্থান কর্ণাটকের কথা বলা হয়েছে। ২০১৯-এর শুমারিতে এই রাজ্যে ৩৩ ভাগ শিশুকে স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজনে পাওয়া গেছে।
বহু ক্ষেত্রে ভারতের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ পাকিস্তানের অপুষ্টি পরিস্থিতিও বেশ কাছাকাছি। দেশটিতে ৫ বছরের কমবয়সী প্রতি ১০ শিশুর ৪ জনকে পাওয়া গেছে লম্বা ও ওজনে স্বাভাবিকের চেয়ে কম। ইউনিসেফ দেশটির এই অবস্থাকে বলছে ‘রাইজিং ইমার্জেন্সি’ (ডন, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১)। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে এ বছর তাদের অবস্থান ৯২। ভারত আছে ১০১-এ। বাংলাদেশের অবস্থান ১১৬ দেশের মধ্যে ৭৬। ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশে প্রতি তিন শিশুর মাত্র একটি ভালো করে খেতে পারছে। ৩৬ ভাগ শিশু নানারূপে অপুষ্টিতে ভুগছে (ঢাকা ট্রিবিউন, ২২ সেপ্টেম্বর)। এ রকম বাচ্চাদের জন্য সব আমিষই জরুরি। তবে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় প্রোটিনের ১০-১২ ভাগ মেটাতে পারে একটা ডিম। কিন্তু মাংস-ডিম ইত্যাদি বন্ধ করা ‘অনুভূতি’র জন্য যত জরুরি— ততটা উদ্বেগ দেখা যায় না শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে।
দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে বহু মানুষ খাবারের সংকটে আছে কিংবা শিশুরা রুগ্ণ ও বেঁটে হয়ে যাচ্ছে, এ রকম দুর্যোগ এই অঞ্চলের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নয়। কিন্তু অনুভূতি ও ভাবমূর্তির সংঘাতে তারা উচ্চকিত আছে। কর্মীদেরও তাতে আগ্রহের ঘাটতি নেই। উপমহাদেশজুড়ে মন্দির, নামাজ, ব্লাসফেমি ইত্যাদি বিষয়ে ‘অনুভূতি’তে আঘাত লাগার অস্পষ্ট অভিযোগে বিস্তর দাঙ্গা হলো, প্রচুর মানুষ মারাও গেল এ বছর। তাতে যে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে মানুষের মোহ কাটছে, এমন নয়। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান—কোথাও জাতীয়তাবাদ দুর্দিনে নেই! কর্তৃত্ববাদের মেধার দিক—জ্বালানি হিসেবে মাংস, ডিম, গোবর সব তাদের কাজে লাগছে।
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক