যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে ধর্মীয় স্বাধীনতায় যেসব দেশ বাধা দেয়, সেই ধরনের শীর্ষস্থানীয় ১০টি দেশের নাম সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ঘোষণা করেছেন। বিস্ময়কর বিষয় হলো, সেই তালিকায় ভারতের নাম নেই। যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিদলীয় ও স্বায়ত্তশাসিত কেন্দ্রীয় প্যানেল ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডমের (ইউএসসিআইআরএফ) একটি সুপারিশের জবাবে ব্লিঙ্কেন এই নামগুলো বলেন।
ভারতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতাসংক্রান্ত বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুই বছর ধরে ইউএসসিআইআরএফ ১৩টি দেশের সঙ্গে ভারতের নামও কান্ট্রি অব পার্টিকুলার কনসার্ন (সিপিসি) হিসেবে নথিবদ্ধ করতে সুপারিশ করে আসছে। গত বছর তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ভারতকে সে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এ বছর বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেনও ভারতকে সেই তালিকায় ফেলতে রাজি হলেন না।
এটি গোপন কোনো বিষয় নয় যে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে তার গুরুত্বপূর্ণ মিত্র মনে করে থাকে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বলা আছে, ভারত হলো যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রধান প্রতিরক্ষা সহযোগী’ এবং দুই দেশই নৌ সীমানার নিরাপত্তা, তথ্য বিনিময়সহ বিভিন্ন ইস্যুতে একে অপরকে বন্ধু ভাবে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হওয়া সত্ত্বেও বছরের পর বছর সৌদির নাম সিপিসির তালিকায় থাকছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, সৌদি সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘দীর্ঘদিনের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক’ রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সরঞ্জাম ক্রেতাদের মধ্যে সৌদি আরব এক নম্বরে রয়েছে। সেই সৌদি আরবকে এই তালিকায় রাখা হয়। অন্যদিকে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার ও ধর্মীয় অধিকার হরণের বিস্তর অভিযোগ থাকার পরও কেন তার নাম সিপিসিতে নেওয়া হয়নি এবং ইউএসসিআরআইএফের সুপারিশ মেনে কেন ভারতের বিভিন্ন সংস্থা ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় না, সেটি এক গুরুতর প্রশ্ন।
ভারতকে সিপিসিভুক্ত করার সুপারিশ প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে মার্কিন প্রশাসন তার স্ববিরোধী চেহারা সবার সামনে নিয়ে এসেছে। মাত্র সাত মাস আগে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈশ্বিক ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক প্রতিবেদনে ভারতকে ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণকারী দেশের সামনের সারিতে দেখানো হয়। ওই প্রতিবেদনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের মন্ত্রিসভা এবং তাদের আদর্শিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সদস্যরা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর, বিশেষ করে মুসলমান নাগরিকদের ওপর অত্যাচার–নির্যাতন করেন বলে উল্লেখ করা হয়।
গত মার্চে ব্লিঙ্কেন বৈশ্বিক মানবাধিকার নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিলেন। তাতে ভারতে পুলিশের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মামলা ছাড়াই দীর্ঘদিন আটক করে রাখা, সংখ্যালঘুদের হত্যা ও নির্যাতন করা, সাংবাদিকদের বেআইনিভাবে আটক করে রাখা, গণমাধ্যমকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, সরকারের সমালোচনা করা ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেওয়াসহ বহু অভিযোগ উঠে এসেছে। এরপরও প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গদিতে বসার কয়েক সপ্তাহ পরই বিশ্বের প্রথম কোনো নেতার সঙ্গে বৈঠক করার জন্য মোদিকেই বেছে নিলেন। আরও তামাশার বিষয় হলো বাইডেন-মোদি ভার্চ্যুয়াল বৈঠকের আগমুহূর্তে ফ্রিডম হাউস নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ভারতের গণতন্ত্র ‘মুক্ত’ থেকে ‘আধা মুক্ত’ পর্যায়ে নেমে এসেছে।
এর এক সপ্তাহ পরই মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে দিল্লিতে গেলেন। সেখানে তিনি মোদির সঙ্গে ‘দ্বিপক্ষীয় লক্ষ্য’ নিয়ে কথা বললেন, কিন্তু মানবাধিকার নিয়ে কিছুই বললেন না। এরপর সেপ্টেম্বরে ভারতে নিযুক্ত মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স অতুল কাশ্যপ (যিনি একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন) আরএসএসের প্রধান মোহন ভাগতের সঙ্গে দেখা করেন। মোহন ভাগত ভারতের কোনো সরকারি পদে আসীন না হলেও ক্ষমতাসীন দলের প্রধান আদর্শিক পরামর্শদাতা তিনিই। তিনি বরাবরই ভারতকে একটি বিশুদ্ধ হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার কথা বলে আসছেন।
গত সেপ্টেম্বরে হোয়াইট হাউসে বাইডেন-মোদি বৈঠকে মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা ও সহিষ্ণুতা নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা হয়েছে। সেখানে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস মোদিকে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত একজোট হয়ে ‘গণতন্ত্রকে রক্ষা’ করবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাইডেন, হ্যারিস, অস্টিন, ব্লিঙ্কেন ও কাশ্যপ গণতন্ত্রের ওপর ভারতের আঘাত নিয়ে মোদি, মোদির পররাষ্ট্রমন্ত্রী, মোদির প্রতিরক্ষামন্ত্রী, শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় কূটনীতিক, মোহন ভাগত—কারও সঙ্গেই দ্বিপক্ষীয় সংলাপে বসতে পারেননি।
৯ থেকে ১০ ডিসেম্বর বাইডেন প্রশাসনের ডাকা গণতন্ত্র সম্মেলনে মোদি যোগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। সেখানে মোদি অনেক কিছু বলবেন এবং তাঁর দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন, সাংবাদিক নির্যাতন, ছাত্র ও ভিন্নমতাবলম্বী রাজনীতিকদের ওপর জুলুমের কথা তিনি চেপে যাবেন। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের নিজের প্রতিবেদনেই দেখা যাচ্ছে, ভারতের ক্ষমতাসীন সরকার লাগামহীন কর্তৃত্ববাদী আচরণ করে ও দমন–পীড়ন চালিয়ে গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে, সেখানে এই সম্মেলনে গণতন্ত্র নিয়ে মোদিকে বক্তৃতা করতে দেওয়া ভণ্ডামির শামিল।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
● সুনীতা বিশ্বনাথ নিউইয়র্কে হিন্দুজ ফর হিউম্যান রাইটসের সহপ্রতিষ্ঠাতা
● রেভারেন্ড পিটার কুক নিউইয়র্ক স্টেট কাউন্সিল অব চার্চেসের পরিচালক
● রশিদ আহমেদ ইন্ডিয়ান আমেরিকান মুসলিম কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক