কোভিড-১৯ টিকার জন্য দেশগুলো যখন কাড়াকাড়ি করছে, বিশ্ব শব্দভান্ডারে শোনা যাচ্ছে ‘টিকাজাতি’ আর ‘টিকাজাতীয়তাবাদ’-এর মতো কুৎসিত সব শব্দ, তখন ভিন্ন এক পথে হাঁটছে ভারত। ‘টিকামৈত্রী’ প্রচারণার আওতায় কোটি কোটি টিকা তৈরি করে তারা ৬০টির মতো দেশকে পাঠিয়েছে।
ওষুধ তৈরিতে ভারত একটা পরাশক্তি। যত ধরনের ওষুধ দুনিয়ায় আছে, তার ২০ শতাংশই উৎপাদন করে তারা। তার মধ্যে আছে মোট টিকার ৬২ শতাংশ। কোভিড-১৯ টিকা আবিষ্কারের আগেই ভারত ১০০-এর মতো দেশকে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ও প্যারাসিটামল সরবরাহ করে, ৯০টির মতো দেশে পাঠিয়েছে ওষুধ, টেস্টকিট ও অন্যান্য সরঞ্জাম। এমনকি অনুমোদন পাওয়ার আগেই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা তৈরি করার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন বেসরকারি মালিকানাধীন সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার (এসআইআই) প্রধান আদর পুনাওয়ালা। আর অনুমোদন যখন মিলেছে, ঘরে-বাইরে ব্যবহারের জন্য লাখ লাখ ডোজ তৈরি করে সরকারকে দিয়েছে তারা।
আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, মিয়ানমার আর নেপালসহ প্রতিবেশী অধিকাংশ দেশ এবং আরও দূরের সিসিলি, কম্বোডিয়া, মঙ্গোলিয়া এবং প্যাসিফিক আইল্যান্ড, ক্যারিবীয় ও আফ্রিকান দেশসমূহে গেছে ভারতীয় টিকা। টিকা বাংলাদেশের সঙ্গে টানটান সম্পর্ক মেরামতে সাহায্য করেছে, মজবুত করেছে মালদ্বীপের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।
নিজেদের টিকার প্রচার চীন, রাশিয়াও করছে আর পশ্চিমা ওষুধ কোম্পানিগুলো তো প্রচারণার মচ্ছব বসিয়ে দিয়েছে। তবে নিজেদের ব্যবহারের জন্য টিকা তৈরির সময় উন্নত বিশ্ব অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলোর টিকা ক্রয় অক্ষমতার বিষয়টা উপেক্ষা করেছে। অন্যদিকে জানামতে ভারতের তৈরি টিকা নিরাপদ, দাম সহনীয় আর অন্যগুলোর মতো এগুলো গুদামজাত ও পরিবহনের জন্য অতি নিম্ন তাপমাত্রা লাগে না।
ভারতের টিকা কূটনীতিকে অবশ্য নিখাদ পরার্থপরতাও বলা যাবে না। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যখন ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অবকাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করেন, তখন মহৎ, মানবিক ও বিশ্বজনীন ভাষায় ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর উদ্দেশ্য। তবে তাঁর উত্তরসূরিরা অনেক দিন থেকেই ভারতের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে জোরদার করতেই তাঁর বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসা দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে আসছে। অধিকাংশ ধনী দেশ যখন টিকা মজুত করার জন্য সমালোচিত, তখন দরিদ্র দেশগুলোতে ৩ কোটি ৩০ লাখ টিকা পাঠিয়ে নজর কেড়েছে ভারত, প্রক্রিয়াধীন আছে আরও কয়েক লাখ।
অকথিত নিহিত আরেকটা দিকও আছে: চীনের সঙ্গে বিরোধ। নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে সস্তা ও সুলভ টিকা সরবরাহকারী হিসেবে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে ভারত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মিয়ানমারকে ৩ লাখ টিকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল চীন, কিন্তু এখন পর্যন্ত তা সরবরাহ করতে পারেনি। অথচ চটজলদি তাদের ১৭ লাখ টিকা সরবরাহ করেছে ভারত। কম্বোডিয়া ও আফগানিস্তানেও একইভাবে চীনকে হারিয়ে দিয়েছে ভারতীয় টিকা।
ব্রাজিলে বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট পড়েছে চীনা টিকা। জরিপে অংশ নেওয়া ৫০ শতাংশ ব্রাজিলীয়ই যখন সিনোভ্যাক টিকা নিতে অনীহা প্রকাশ করে, ভারতের সাহায্যপ্রার্থী হন প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো, আর সেটা আসেও তুরন্ত। টুইটে ধন্যবাদ জানিয়ে রামায়ণের একটি ছবি দিয়ে নিজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন বলসোনারো, ছবিটিতে দেখা যায় জীবনদায়ী ভেষজ সঞ্জীবনী বটী দিতে আস্ত একটা পর্বত লঙ্কায় বয়ে নিয়ে চলেছে হনুমান।
ধনী দেশগুলোতেও যাচ্ছে ভারতীয় টিকা। এসআইআইকে এক কোটি ডোজের অর্ডার দিয়েছে যুক্তরাজ্য। ফোন করে মোদির কাছে ২০ লাখ টিকা চেয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী। কয়েক দিনের মধ্যে প্রথম দফা পাঁচ লাখ সরবরাহও হয়ে গেছে। আবেগে ট্রুডো তো ঘোষণাই করে দিয়েছেন ‘ওষুধ তৈরিতে ভারতের অসাধারণ সক্ষমতা আর সারা দুনিয়ার সঙ্গে তা ভাগ করে নিতে প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বের জোরেই দুনিয়া থেকে কোভিড-১৯ নির্মূল সম্ভব হবে।
সূক্ষ্মভাবে এই সক্ষমতাকে চীনের অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক আধিপত্যের বিকল্প হিসেবে প্রচার করছে ভারত। আর চীন যেহেতু টিকার তথ্য প্রকাশে লুকোছাপা করে, ফলে সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়েও বিতর্ক আছে। আর পুনে ও হায়দরাবাদের ওষুধ কারখানাগুলো দেখানোর জন্য বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে সফরের আয়োজন করে ভারত।
ধনী দেশগুলোর আচরণের বৈপরীত্য চোখে পড়ার মতো। পৃথিবীর ১৬ শতাংশ জনসংখ্যা অধ্যুষিত ধনী দেশগুলো দুনিয়ার মোট টিকার ৬০ শতাংশই নিজেদের জন্য নিশ্চিত করেছে। অন্যদিকে রপ্তানি বন্ধ রাখার জাতীয়তাবাদী পথে না হেঁটে ভারত তার লভ্য টিকা ভাগ করে নিচ্ছে। গরিব দেশগুলোতে বিতরণের জন্য গঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভাক্স কর্মসূচিতে ১.১ বিলিয়ন দেওয়ারও প্রস্তাব করেছে ভারত। নিজের লোককে যত টিকা দিয়েছে ভারত, রপ্তানি করেছে তার তিন গুণ।
বিশ্বশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা ভারতের আছে, টিকা কূটনীতি তার জন্য একটা বর হয়ে দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা রপ্তানি করে একটা দেশের বিশ্ব অবস্থান উল্লেখযোগ্য রকমের উন্নত করা যায় কি না, সেটা এখনো অনিশ্চিত। তবে যদি কখনো নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী আসনের পুনর্বিন্যাস করা হয়, তাহলে কৃতজ্ঞ সরকারসমূহ জানবে কালান্তক জীবাণুর হামলা থেকে দুনিয়াকে বাঁচাতে কে সবচেয়ে বেশি করেছে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শশী থারুর: ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব