ভারতে যখন বাহুবলীর জিগির, তুরস্কে তখন এরতুগরুল–এর জয়জয়কার। দুটি দেশেই চলছে ধর্মঘেঁষা জাতীয়তাবাদের উত্থান। কাজেই যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে—সিনেমার পর্দা কাঁপাচ্ছেন ধর্মযোদ্ধা নায়কেরা আর রাজনীতি মাতাচ্ছেন ধর্মযোদ্ধা নেতাগণ। সিনেমার কাহিনির সঙ্গে মিথ ও ইতিহাস একাকার হয়ে যাচ্ছে। সিনেমা বাস্তবের ধার কম ধারলেও বাস্তবে কী চাইতে হবে, দর্শককে অনেক সময় সিনেমা তা শেখাতে বসে। সিনেমা হল ও টিভি তাই বিনোদনের ছলে জনতার নৈতিক কম্পাসটা ঠিক করে দেয়।
ক্ষমতার ব্যাপারীরা চুপিসারে এ ধরনের সিনেমাকে মদদ দিয়ে থাকেন। তুরস্কের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত হচ্ছে এরতুগরুল সিরিয়াল আর ভারতে বাহুবলীর প্রথম পর্ব ২০১৬ সালের জাতীয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে। বাহুবলী-টু পাচ্ছে আরও বেশি কিছু—বিজেপিপন্থীদের সংবর্ধনা। ওদিকে সামরিক ক্যু সামলে ওঠা এরদোয়ানের বিজয়ের প্রতিফলন টিভির পর্দায়ও ভাসছে। এরতুগরুল সিরিয়ালের এক পর্বে দেখা যায়, বিদেশি শত্রু আর স্বজাতির গাদ্দারদের হারিয়ে দিয়ে এরতুগরুল আরও অপ্রতিরোধ্য হচ্ছে। অভ্যুত্থান–পরবর্তী তুরস্কের সঙ্গে খুব মিলে যায় না? সুলতান সুলেমান সিরিয়ালেও সেনাবিদ্রোহ দমন করে সুলেমানের আরও শক্তিমান হয়ে ওঠার গল্প বাংলাদেশের দর্শকেরাও দেখেছে।
মহাবীর বাহুবলী ধর্মহীন ভিলেনের কাছ থেকে রাজ্য ও ধর্ম দুটিই রক্ষা করেন। বাহুবলীর দ্বারা বিশাল শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা, শিংয়ে আগুনজ্বলা গোবাহিনী দিয়ে শত্রুসেনা হঠানো তো আছেই; নকল রাজাকে সরিয়ে ধর্ম-মাতা-রাজত্ব অর্জন ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতীকও কম নয়। বাহুবলীর কাহিনিও মহাভারতের ছক অনুসরণ করে। মহাভারতের পাঁচ পাণ্ডব ভাইয়ের শক্তির প্রতীক একা এক বাহুবলী। পাণ্ডবদের মতোই তিনি রাজ্য হারিয়ে ভবঘুরে অবস্থা থেকে অলৌকিক ক্ষমতার বলে শেষমেশ ধর্মরাজ্য কায়েম করেন। বিজেপির নেতারা দাবি করেন, পৌরাণিক আমলে ঋষিরা ড্রোন ওড়াতেন, আর বাহুবলীতে উড়ন্ত নৌকা দেখা যায়। বাহুবলীর রাজ্যে অন্য কোনো ধর্মের লোক দেখা যায় না। পশ্চিম বাংলার আনন্দবাজার পত্রিকায় বিশ্বজিৎ রায় লিখেছেন, ‘এই চাওয়াটা যে ভারতের অজস্র মানুষের মনে সুপ্ত ও প্রকাশ্য তা রাজনীতিতেও স্পষ্ট, পর্দায়ও। ২০১৫ সালে বাহুবলী যে এক স্বপ্নের সূত্রপাত করেছিল, ২০১৭ সালে বাহুবলী–টু সেই স্বপ্নকে পরিণতি দিল।...এই চাওয়ার সঙ্গে হিন্দুরাজ্যের কল্পনা কেমন একাকার হয়ে যাচ্ছে।’
বাহুবলীর মহেশমতী ও কুন্তল রাজ্য ইতিহাসে নেই। না তামিল অঞ্চলে, না অন্য কোথাও। তবে দক্ষিণ ভারতের চোলা সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাহুবলীর মহেশমতী রাজ্যের কিছু মিল থাকতে পারে। সেই আমলের বিশাল বিশাল মন্দিরের আদলে নির্মিত হয়েছে বাহুবলী সিনেমার কম্পিউটারে বানানো সেট।
অন্যদিকে দুর্ধর্ষ এরতুগরুল দিশেহারা যাযাবর কায়ি গোত্রকে খ্রিষ্টান বাইজেনটিয়ান সাম্রাজ্য উচ্ছেদ করে ওসমানিয়া সালতানাত প্রতিষ্ঠার পথ দেখান। তাঁর ধার্মিকতা অতুলনীয়। কৌম ও পরিবারের প্রতি তাঁর ভক্তি অটল। তাঁর স্ত্রীও বাহুবলীর স্ত্রী’র মতো বুদ্ধি, ত্যাগ ও তরবারি চালনায় তুখোড় এক নারী। তবে এরতুগরুল গাজি মহেন্দ্র বাহুবলীর মতো কাল্পনিক চরিত্র নন। এরতুগরুলের পৃথিবীতে অন্য ধর্মের মানুষের আশ্রয় আছে।
১২৫৫ সালে। মধ্য এশিয়ার এক তৃণভূমিতে তাঁবু শহর গেড়েছে কারিগর ও যোদ্ধাদের এক গোত্র। দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া, মঙ্গোলদের থাবা ও অন্তর্ঘাতী ক্রুসেডারদের হুমকির মুখে তারা খুঁজছে বসতি করার জমি। প্রচণ্ড আত্মমর্যাদাশীল এই গোত্রের প্রধান সুলেমান শাহ—এরতুগরুলের পিতা—সিরিয়ার আলেপ্পোর আরব আমিরের সাহায্য চাইছেন। কোনোদিকে কোনো আশা নেই। তাঁদের সহায় শুধু মধ্যযুগের প্রখ্যাত সুফি ইবনে আরাবির আধ্যাত্মিক শক্তি। একসময় তাঁরা ঘুরে দাঁড়াবেন, ঘোড়া ছোটাবেন কনস্টান্টিনোপলের (ইস্তাম্বুল) বাইজেন্টিয়ান দুর্গের উদ্দেশে। তখন তাঁদের নেতা হবেন এরতুগরুলের সন্তান ওসমান বে। সুলতান ওসমান শাহের নেতৃত্বেই তুর্কমেনিস্তানের যাযাবর তুর্করা ইউরোপের নাকের ডগায় মুসলমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। অনেকের বিশ্বাস, এর মধ্য দিয়ে মহানবী (সা.)–এর আমলের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয় যে একদিন বাইজেনটিয়ান মুসলমান অধিকারে আসবে আর তা শাসন করবেন ন্যায়বান মুসলমান আমির।
কিন্তু এই ইতিহাসকে কেন এরদোয়ান ওরফে রিদওয়ানের দরকার হলো? তাঁর দরকার অটোমান সাম্রাজ্য পুনরুজ্জীবনের স্বপ্নে তাতিয়ে তুলে ক্ষমতা সংহত করা। তুর্কি ভাষায় ‘দিরিলিস: এরতুগরুল’-এর মানে ‘পুনরুজ্জীবন: এরতুগরুল’।
ট্যাগলাইনে লেখা, ‘এক জাতির জাগরণ’। ষাটটি দেশে এই সিরিয়াল চলেছে। এরতুগরুল–এর প্রতি এরদোয়ানের ভালোবাসা গোপন থাকেনি। তিনি সরাসরি এর সেট পরিদর্শনে যান, হাত মেলান অভিনেতাদের সঙ্গে। অন্যদিকে এর আগে তুমুল জনপ্রিয় সুলতান সুলেমান বিষয়ে গোস্যা হয়েছিলেন, সমালোচনা করেছিলেন।
হিটলারের আমলে বিশাল গথিক স্থাপত্য দেখিয়ে জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা দর্শকমনে চারিয়ে দেওয়া হতে
থাকে। বাহুবলীতে দেখানো হয় কম্পিউটারে বানানো প্রাসাদশৈলী। এসব ব্যাপারে হলিউড সবার গুরু। আজব-জবর সুপারহিরো পয়দা করায় তারাই এক নম্বরে। সোভিয়েত আমলে আফগান যুদ্ধের সময়কার মুজাহিদ বন্ধু র্যাম্বো কিংবা কমিউনিস্ট শত্রু জেমস বন্ড আসলে পশ্চিমা শক্তির সশস্ত্র দূত—তাদেরই প্রচারক।
হলিউডের থ্রি হানড্রেড চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় বুশের আমেরিকার সঙ্গে আহমাদিনেজাদের ইরানের উত্তেজনার সময়। দেখানো হয়, ইরান হলো বর্বর আর স্পার্টার যোদ্ধারা হলো সভ্যতার প্রহরী। ইরাক-আফগানিস্তান আক্রমণের সময়ও বোঝানো হয়েছিল, এটা পাশ্চাত্য বনাম প্রাচ্য ওরফে সভ্যতা বনাম বর্বরতার যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র হলো আজকের স্পার্টা আর পাশ্চাত্য হলো আলোকিত গ্রিস। ভূরাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠা তুরস্ক ও ভারত তাদের স্বপ্নের মাপে নায়ক বানাচ্ছে। আর হলিউড বানিয়েছে পাশ্চাত্যের ভয়ের মাপের গল্প: গেম অব থ্রোনস। বিশ্বনেতার আসন দখলে পরাশক্তিগুলোর দলাদলির সঙ্গে খুব মেলে এর গল্পটা। পরাশক্তির খেলায় প্রভাবশালী বিনোদন-অস্ত্র খুবই উপযোগী।
মিথ ও ইতিহাসের এমন ফিরে আসার কারণ বর্তমান রাজনীতি ও বিশ্ব পরিস্থিতি। জাতীয়তাবাদ মিথ থেকে শক্তি নেয়, জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিরও দরকার সুপারহিরো। মোহাবেশ সৃষ্টিকারী নেতার ভাবমূর্তি ফোটানো হয় সিনেমার সুপারহিরোর মধ্যে। তারা যতই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখাক, জনতা নিজেকে ততই ক্ষুদ্র-তুচ্ছ ভাবে। ভিডিও গেমে ভীরু মানুষটি দুর্ধর্ষ কোনো যোদ্ধার ভূমিকায় খেলতে পছন্দ করে। দেশ-জাতি-সম্প্রদায় নিয়ে উদ্বিগ্ন মানুষ স্লোগান দেয় স্বৈরতান্ত্রিক কোনো নেতার নামে, ভালোবাসে সুপারহিরো ফিল্ম।
বালক এরদোয়ান ইস্তাম্বুলের রাস্তায় লেবুর শরবত বেচতেন। আর নরেন্দ্র মোদি চা বিক্রি করতেন আহমেদাবাদে। ভারতে মহেন্দ্র/অমরেন্দ্র বাহুবলীর মধ্যে অনেকে দেখছেন নরেন্দ্র মোদিকে। ওদিকে তুর্কি দর্শকেরা এরতুগরুলের মধ্যে পাচ্ছে প্রেসিডেন্ট রিদওয়ানকে। তবে এরদোয়ানের রাজনীতিকে জনতুষ্টিবাদী বলা হলেও সাম্প্রদায়িকতার কলঙ্ক তাঁর ভাবমূর্তিতে নেই। তুরস্ক কুর্দিদের দমন করে এলেও, সাম্প্রদায়িক কর্মসূচি সে দেশে হালে পানি পাচ্ছে না। তুরস্কের শাসকেরা সম্প্রদায়গত, সাম্প্রদায়িক নন।
বাস্তবতা থেকে রং চড়ানো কাহিনির জন্ম হয়, তাই কাহিনির মধ্যে বাস্তবতা পাওয়া সম্ভব। আমরা জানি সিনেমার গল্পটা সত্য নয়, কিন্তু দেখতে দেখতে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠি, নায়কের বিজয় চাইতে থাকি, তাকে ভালোবেসে ফেলি। এই ভালোবাসার ঝরনা বিনোদনের জলাশয় উপচে চলে আসে রাজনীতির নদীতে। ভারতে বিজেপির প্রথম উত্থানের সময় (বাবরি মসজিদ ঘটনার কালে) দূরদর্শনে রামায়ণ চলছিল, বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট যেবার বিজয়ী হয়, সেবার টিভিতে চলছিল মহাভারত। দেখা যাক জনপ্রিয় সংস্কৃতি থেকে শক্তি নিয়ে দুই দেশের দুই রাষ্ট্রনেতা জনগণকে কোথায় নিয়ে যান, আর জনগণই বা সিনেমার কল্পনা থেকে কীভাবে বাস্তবের মাটিতে অবতরণ করে। আধুনিক সময়ে সিনেমা যতটাই বিনোদন, ততটাই রাজনীতি; আর কখনো কখনো তা আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে উসকেই দেয়। দাঙ্গা, জাতিবিদ্বেষ, যুদ্ধ আর সন্ত্রাসবাদের পৃথিবীতে নির্মল বিনোদন বলে আর কিছু নেই।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
faruk.wasif@prothom-alo.info