মতামত

ভাইরাল হলে শুধু বিচার কেন

ধর্ষণের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বিক্ষোভ চলছে
ছবি: প্রথম আলো

আমি পড়াশোনার কারণে বছর পাঁচেক ইংল্যান্ডে ছিলাম। সেখানে মাঝেমধ্যে পত্রিকায় নৃশংস অপরাধের বিবরণ ছাপা হতো। কম হলেও ধর্ষণের সংবাদ থাকত। কিন্তু কোনো দিন দেখিনি যে ধর্ষকের পরিচয় হচ্ছে সে ক্ষমতাসীন দলের (বা কোনো অঙ্গ সংগঠনের) সদস্য এবং এ কারণে তার বিরুদ্ধে কেউ মামলা করতে সাহস পাচ্ছে না।
আমাদের দেশে পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে ধর্ষক কোনো না কোনো ভাবে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংযুক্ত কেউ। ব্যতিক্রম কিছু যে নেই, তা নয়। ধর্মীয় অঙ্গনে বিকৃত যৌনাচারের, মজনুর মতো ভবঘুরে ধর্ষক বা কোনো বাহিনীর বা বিরোধী দলের কিছু ধর্ষকের খবরও আসে। কিন্তু মোটামুটি ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষকের পরিচয় ক্ষমতাসীন দলের কেউ সে। সুবর্ণচর, এমসি কলেজ বা অতি সাম্প্রতিক বেগমগঞ্জের পাশবিক ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা চট করে আমাদের তা মনে করিয়ে দেয়।
আমরা এসব ঘটনায় মর্মাহত হই। ফেসবুক আমাদের প্রত্যেকের কণ্ঠস্বর হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে সেখানে প্রতিবাদ করি। নৃশংসতার ঘটনা ভাইরাল করি, তাতে মূলধারার পত্রিকা ও সরকারের টনক নড়ে কখনো কখনো। ভাইরাল হওয়া ‘ধর্ষক’ অনেক সময় গ্রেপ্তার হয়। ভাইরাল হলেই শুধু বিচার শুরু হয়, এমন একটা বাস্তবতা এভাবে দাঁড়িয়ে গেছে সমাজে।

ফেসবুকে ভাইরাল করে আমরা কেবল এ অপরাধী চক্রের ফুট সোলজারদের বিচার নিশ্চিত করতে পারি। ফেসবুকে বা পত্রিকায় জি কে শামীম, প্রদীপ, মিঠু, সাহেদ, দেলোয়ার—এঁদের পর্যন্ত লিখতে পারি। এঁদের ব্রিডিং গ্রাউন্ডটা কাদের হাতে, কাদের ভরসায় তাঁরা হীন অপরাধ করতে দ্বিধা করেন না, তা আমরা জানতে পারি না অনেক সময়।

শুধু ধর্ষণের ক্ষেত্রে না, হত্যা (আবরার ও মেজর সিনহা হত্যা), দুর্নীতি (সাহেদ, সাবরিনার ঘটনা) ও ব্যাংক লুটের মতো (হল-মার্ক) ঘটনার ক্ষেত্রেও এটা দেখা যায়। বেগমগঞ্জে অচিন্তনীয় বর্বরতার ঘটনাটি ঘটেছিল মাসখানেক আগে, একজন ইউপি সদস্যকে তা জানানো হয়েছিল, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এলাকায় দুর্বৃত্ত হিসেবে সুপরিচিত ছিল। কিন্তু তারা বিচারের আওতায় এসেছে শুধু ফেসবুকে তাদের পাপাচারের ঘটনা ভাইরাল হওয়ার পর।
ফেসবুকে ভাইরাল হলে যে অবশ্য সব ক্ষেত্রে বিচার শুরু হয়, তা নয়। ভাইরাল হওয়া ঘটনায় চুনোপুঁটি ধরনের কেউ জড়িত হলে এটি হয়। অপরাধীরা ক্ষমতাশালী হলে বা তাদের সঙ্গে সরকারের কোনো না কোনো শ্রেণি স্বার্থ যুক্ত থাকলে বিচার হয় না, এটি আমরা অনেক ঘটনাতে দেখি (যেমন সাগর রুনি, তনু, ত্বকী হত্যা)। তারপরও বলা যায়, ফেসবুকে ভাইরাল হলে অনেক সময় বিচার হয়। যে কারণে আমরা ফেসবুকে একটা বড় অঘটন পরের বড় অঘটনে চাপা পড়ে গেলে আশঙ্কায় পড়ি। ধরেই নিই যে ফেসবুকে শোরগোল অব্যাহত না রাখতে পারলে বিচার হবে না এ দেশে।
এ প্রতিবাদকে সম্মান করি। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, বিচার হতে হলে কেন মিডিয়ায় ভাইরাল করতে হবে কিছু? এ দেশে সংবিধান, আইন সব জায়গায় বিচারটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে হওয়ার কথা। নাগরিক নজরদারি ছাড়া বিচারকার্য হবে না, তাতো কোথাও বলা নেই। তাহলে কেন এটি না হলে মামলা, গ্রেপ্তার, বিচার কিছু হয় না অনেক সময়?

২.
আধুনিক রাষ্ট্র ধারণার অন্যতম ভিত হচ্ছে বিচারব্যবস্থা। দুর্বৃত্তদের থেকে নাগরিকদের নিরাপত্তা দেবে পুলিশ; নিরাপত্তাহানি বা অপরাধ ঘটলে বিচার করবেন আদালত; বিচারে সাহায্য করবেন পুলিশ, গোয়েন্দা ও সরকারি উকিলেরা। এ কাজগুলো তাঁরা দয়া করে করেন না। নাগরিকদের করের টাকা দিয়ে এ জন্য তাঁদের আয়-রোজগার ও সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়। বিনিময়ে তাঁরা অপরাধের বিচার নিশ্চিত করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। সমস্যাটা হয় যখন তাঁরা দায়িত্বটা পালন করেন না বা করতে পারেন না।
আমাদের মতো দেশে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার প্রধান কারণ হচ্ছে এঁদের ওপর ক্ষমতাসীন সরকার ও দলের খবরদারি। সরকার যাদের বিচার চায় না, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় না, এমনও দেখা যায়। ধর্ষণ বা যেকোনো ধরনের অপরাধের ব্যাপকতার একটি মূল কারণ এটি।
এ সত্যকে আড়াল করার জন্য কেউ কেউ ‘হীন অপরাধের জন্য আমরা সকলে দায়ী’ এ ধরনের ঢালাও কথা বলেন। কিন্তু আমাদের দায়টা শুধু সেখানেই যে আমরা সরকারের দোষ দেখি না, অপরাধগুলোর পেছনের বৃহত্তর চিত্র দেখার চেষ্টা করি না।
৩.
দেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশে এবার অবশ্য প্রশ্ন উঠেছে যে ধর্ষণ কি যৌন বিকার নাকি ক্ষমতার বিকার? ধর্ষণের সঙ্গে যৌন বিকারের অবশ্যই সম্পর্ক আছে। যেমন ব্রিটেনের মতো দেশেও প্রতিবছর ৮৫ হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হন। এর পেছনে মূল কারণ যৌন বিকার। সেখানেও বিভিন্ন সামাজিক কারণে ধর্ষণের ঘটনা অনেকে পুলিশকে জানান না। কিন্তু এটি জানালে পুলিশ মামলা নেবে না, অপরাধীকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করবে না, বিচার হলে সরকারের হস্তক্ষেপ হবে, এসব কল্পনাও করা যায় না।
আমাদের দেশে ধর্ষণ শুধু যৌন বিকার নয়, এটি ক্ষমতার বিকারও। বিশেষ করে এ ক্ষমতার উৎস সাধারণ জনগণ না হয়ে সন্ত্রাসী বা অপরাধী চক্র হয়ে ওঠে যখন। যে নির্বাচনে জনগণ না, গুন্ডা-পান্ডার শক্তি নির্বাচকের ভূমিকা পালন করে, সেখানে গুন্ডা-পান্ডার ধর্ষণ বা অন্য কোনো অপরাধের বিচার হতে পারে না। যাঁরা সন্ত্রাসী চক্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তাঁরা তাদের রক্ষা করার চেষ্টা করবেন। যে পুলিশকে দেশের আইন না, এ সন্ত্রাসী চক্রকে রক্ষায় নিয়োজিত করা হয়, সেই পুলিশ তাদের সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধবে। আমাদের দেশে এখন তা-ই হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে।

ফেসবুকে ভাইরাল করে আমরা কেবল এ অপরাধী চক্রের ফুট সোলজারদের বিচার নিশ্চিত করতে পারি। ফেসবুকে বা পত্রিকায় জি কে শামীম, প্রদীপ, মিঠু, সাহেদ, দেলোয়ার—এঁদের পর্যন্ত লিখতে পারি। এঁদের ব্রিডিং গ্রাউন্ডটা কাদের হাতে, কাদের ভরসায় তাঁরা হীন অপরাধ করতে দ্বিধা করেন না, তা আমরা জানতে পারি না অনেক সময়। জানলেও লিখতে পারি না মামলা ও নানা ধরনের বিপদের আশঙ্কায়। কিন্তু দেশে পুলিশি ব্যবস্থা আর বিচারব্যবস্থা ঠিকমতো চললে এটা হতো না। এসব ব্যবস্থা ঠিকমতো কাজ করলে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি পর্যন্ত বিচারের সম্মুখীন হন, এমন উদাহরণ আমরা বিভিন্ন উন্নত দেশে দেখি।
এসব ব্যবস্থা ঠিকভাবে চলার মূল শর্তই জবাবদিহিমূলক সরকারব্যবস্থা। আর এমন সরকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন। বাংলাদেশে আগে যখন ঠিকমতো নির্বাচন হতো, তখন আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার কাজ অনেকটুকু করতে পেরেছিলাম, পুলিশের সংস্কার ও স্থায়ী সরকারি কৌঁসুলি নিয়োগের প্রস্তুতির কাজও অনেক দূর এগিয়েছিল। এখন এসব হিমাগারে। ধর্ষণ, দুর্নীতি আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ তখনো হতো, কিন্তু আজকের মতো এতটা না। প্রতিবাদ আর ভিন্নমতকে তখনো দমন করা হতো, কিন্তু এখনকার মতো সর্বাত্মক মাত্রায় না।
প্রকৃত নির্বাচন হলে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকে, সরকারের জবাবদিহি অনেক বেশি থাকে, ফলে বিচারহীনতার আশঙ্কা কম থাকে। এসব কারণে সরকারের ধারে-কাছে থাকলে ধর্ষণের মতো হীন অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে, এ ধরনের মনোবৃত্তি সমাজে কম থাকে।
৪.
ধর্ষকের বিরুদ্ধে আমরা অবশ্যই ফেসবুকে সোচ্চার হব, আন্দোলন করব। দেশে পর্নোগ্রাফি আর মাদকের বিস্তার রোধ করার কথা বলব। দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচারের জন্য আইনি সংস্কারের কথা বলব। কিন্তু একই সঙ্গে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতার কথাও বলতে হবে। বলতে হবে সমাজে বিরাজমান অসহ্য বিষময় পরিস্থিতির সঙ্গে সরকারের দায়মুক্তির সমর্থকের কথাও। বলতে হবে প্রকৃত নির্বাচন হচ্ছে জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে মৌলিক শর্ত।
বলতে হবে, শুধু ফেসবুকে ভাইরাল হলে বিচার কেন? বিচারের জন্য জনগণকে সারাক্ষণ লেগে থাকতে হবে কেন? আমাদের ট্যাক্সের টাকার বিনিময়ে কী সেবা পাই আমরা সরকারের কাছ থেকে?

আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক।