গত শনিবার (২৫ জুন) সাভারের আশুলিয়ায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী। ২৭ জুন ভোরে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই শিক্ষকের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় ওই ছাত্রসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলার এজাহারে শিক্ষার্থীটির বয়স দেখানো হয়েছে ১৬ বছর। কিন্তু জন্ম সনদ ও নবম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশন অনুযায়ী তাঁর বয়স ১৯ বছর ৬ মাস। মামলার বাদী নিহতের ভাই অসীম কুমার সরকার বলেছেন, ‘মামলায় অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বয়স উল্লেখ করা হয়েছে ১৬ বছর, প্রকৃত বয়স উল্লেখ করা হয়নি। প্রকৃত বয়স উল্লেখ না করলে ওই ছাত্রের বিচার হবে কিশোর আদালতে, আর প্রকৃত বয়স উল্লেখ করলে বিচার হবে সাধারণ আদালতে’ (২৯ জুন, ডেইলি স্টার অনলাইন)।
তবে শুরুতে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মামলাটি শিশু আদালতে পাঠালে ওই কিশোরের নানা সনদ পর্যালোচনা করে তাকে প্রাপ্তবয়স্ক সাব্যস্ত করা হয়। ফলে সেই মামলা শিশু আদালত থেকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফেরত পাঠানো হয়। এরপর উভয়পক্ষের শুনানি শেষে অভিযুক্তের পাঁচ দিনের রিমান্ড দেন আদালত।
এর আগে চলতি বছরের মার্চ মাসে মাদারীপুরে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) বিরুদ্ধে এক এসএসসি পরীক্ষার্থীর বয়স বাড়িয়ে তাঁকে হত্যা মামলার আসামি করার অভিযোগ উঠেছিল। সানি বেপারি নামে ওই পরীক্ষার্থীর পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছিলেন, তাঁর বয়স ১৬ থেকে বাড়িয়ে ১৯ বছর দেখানো হয়েছে। সেই সময় তাঁর এক স্বজন বলেছিলেন, এসএসসির রেজিস্ট্রেশনে তাঁর বয়স ১ জুলাই, ২০০৬। জন্ম নিবন্ধনেও তাই। তবুও পুলিশ এসব বাদ দিয়ে সানির বয়স তিন বছর বাড়িয়ে তাঁকে আদালতে পাঠিয়েছে।
কিশোর-তরুণদের বিরুদ্ধে মামলার ক্ষেত্রে বয়স নিয়ে ‘কারসাজি’ নতুন কিছু নয়। কখনো আসামি বা অভিযুক্তের বয়স কমিয়ে দেখানোর অভিযোগ ওঠে, আবার কখনো বয়স বাড়িয়ে দেখানো হয়। বয়স কমানো-বাড়ানোর সঙ্গে সাজা বা দণ্ডের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। ১৮ বছরের নিচে যে কেউ কোনো অপরাধ করলে তাঁর বিচার হয় শিশু আইন, ২০১৩ অনুসারে। শিশু আইনে বেশ কিছু গুরুতর সাজা বা দণ্ডের ব্যাপারে বিধি-নিষেধ রয়েছে। অপরদিকে ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে এ রকম ব্যক্তির অপরাধের বিচার হয় প্রচলিত আইন অনুসারে এবং সাধারণ আদালতে। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনে উল্লেখিত যেকোনো সাজা বা দণ্ড প্রযোজ্য হতে পারে। সুতরাং কিশোর-তরুণদের বিরুদ্ধে মামলার ক্ষেত্রে বয়স কমানো-বাড়ানো কোনো ‘নিরীহ’ বিষয় নয়, এর সঙ্গে ন্যায়বিচারের প্রশ্নটিও জড়িত।
নানা রাজনৈতিক-সামাজিক কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান হচ্ছে এবং একই সঙ্গে কিশোর অপরাধীদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৯ সালে বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় ২৪ আসামীর মধ্যে ১৪ জনই ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক বা কিশোর। সেই মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছিলেন, সাজা কম হওয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়ে গডফাদাররা কিশোরদের বিভিন্ন অপকর্মে ব্যবহার করছে। এটা কিশোর অপরাধীর সংখ্যা বৃদ্ধির একটি বড় কারণ।
শিশু আইন, ২০১৩-তে বয়স নির্ধারণ নিয়ে একাধিক ধারায় বলা হয়েছে। ২০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইন, আদালতের রায় বা আদেশে ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের উদ্দেশ্যপূরণকল্পে, অপরাধ সংঘটনের তারিখই হইবে শিশুর বয়স নির্ধারণের জন্য প্রাসঙ্গিক তারিখ।’ ২১ (১) ধারায় আছে, ‘অভিযুক্ত হউক বা না হউক, এমন কোন শিশুকে কোন অপরাধের দায়ে বা কোন শিশুকে অন্য কোন কারণে শিশু-আদালতে সাক্ষ্য দানের উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে, আনয়ন করা হইলে এবং শিশু-আদালতের নিকট তাহাকে শিশু বলিয়া প্রতীয়মান না হইলে উক্ত শিশুর বয়স যাচাই এর জন্য শিশু-আদালত প্রয়োজনীয় তদন্ত ও শুনানি গ্রহণ করিতে পারিবে।’ ২১(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘উপ-ধারা (১) এর অধীন তদন্ত ও শুনানিকালে যেইরূপ সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যাইবে তাহার ভিত্তিতে শিশুর বয়স সম্পর্কে শিশু-আদালত উহার মতামত লিপিবদ্ধ করিবে এবং শিশুর বয়স ঘোষণা করিবে।’ ২১(৩) ধারায় আছে, ‘বয়স নির্ধারণের উদ্দেশ্যে- (ক) শিশু-আদালত যেকোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট হইতে যেকোন প্রাসঙ্গিক দলিল, রেজিস্টার, তথ্য বা বিবৃতি যাচিতে পারিবে’...।
সাধারণত মামলার এজাহার ও অভিযোগপত্রে আসামির নাম, ঠিকানার পাশাপাশি বয়সও উল্লেখ থাকে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা পুলিশ কর্মকর্তারা এই কাজটি করে থাকেন। কিন্তু মামলা দায়েরের সময় বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোন পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। অভিযোগ রয়েছে, এই ধোঁয়াশাকে কাজে লাগিয়েই অনেক সময় পুলিশের সহযোগিতায় বয়স কমানো-বাড়ানোর কাজটি করা হয়ে থাকে। মামলার শুনানি ও বিচারের সময় আদালত আসামি বা অভিযুক্তের বয়স নির্ধারণের জন্য আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিতে পারেন। কিন্তু এ রকম উদাহরণ রয়েছে, সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ সত্ত্বেও সময়ের স্বল্পতা বা অন্য কোনো কারণে এজাহার/অভিযোগপত্রে উল্লেখিত বয়সকেই আদালত আসামি বা অভিযুক্তের প্রকৃত বয়স হিসেবে গণ্য করেছেন। আর এভাবেই হয়তো অপরাধ করা সত্ত্বেও কাউকে সাজা এড়ানো বা দণ্ড লঘু করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, আবার কাউকে হয়তো তাঁর প্রাপ্য আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
নানা রাজনৈতিক-সামাজিক কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান হচ্ছে এবং একই সঙ্গে কিশোর অপরাধীদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৯ সালে বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় ২৪ আসামীর মধ্যে ১৪ জনই ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক বা কিশোর। সেই মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছিলেন, সাজা কম হওয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়ে গডফাদাররা কিশোরদের বিভিন্ন অপকর্মে ব্যবহার করছে। এটা কিশোর অপরাধীর সংখ্যা বৃদ্ধির একটি বড় কারণ।
এ রকম অবস্থায় যদি প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীরাও বয়স কম দেখিয়ে লঘু দণ্ডের সুযোগকে কাজে লাগায় তাহলে তা সমাজের শান্তি, শৃঙ্খলা বিনষ্ট করবে, ন্যায়বিচারকে বিঘ্নিত করবে। অপরদিকে কোনো না কোনোভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের সংশোধনের বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। উভয় ক্ষেত্রেই আইনি বাধ্যবাধকতা মেনে আসামি/অভিযুক্ত শিশু বা কিশোরের প্রকৃত বয়স নির্ধারণ এবং সেই অনুযায়ী তাদের বিচার করাটা খুবই জরুরি। এই বয়স নির্ধারণে কেউ যাতে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে না পারে বা মিথ্যার আশ্রয় নিতে না পারে সেই জন্য আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আইন-আদালতের সঙ্গে যুক্ত সব পক্ষকে সচেষ্ট থাকতে হবে।
মনজুরুল ইসলাম সাংবাদিক